বিদ্যুৎ উৎপাদনে এবার ফার্নেস তেলের সংকট

0
106
জ্বালানি তেল

২৭ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র চলে ফার্নেস তেলে। বিপিসির কাছে ফার্নেস তেলের মজুত আছে আর এক সপ্তাহের।

কয়লার পর এবার ফার্নেস তেলের সংকটে পড়েছে দেশের সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র। বৈদেশিক মুদ্রা ডলারের সরবরাহে ঘাটতি থাকায় তেল আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। এই তেল দিয়ে দেশের ২৭ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র চলে।

জ্বালানি তেল আমদানির একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) সূত্র বলছে, বিপিসির কাছে বর্তমানে ফার্নেস তেলের মজুত এক সপ্তাহের। তবে ফার্নেস তেলের নতুন দুটি জাহাজ আসার কথা রয়েছে। মাসের শেষ দিকে ওই জাহাজের তেল পাওয়া যাবে। এই পরিস্থিতিতে ফার্নেস তেলের অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমবে। এতে বাড়তে পারে লোডশেডিং।

লোডশেডিংমুক্ত হওয়ার বিষয়টি দিগন্তরেখার মতো, ভোক্তার জীবনে এটি আর আসবে না। আর লোডশেডিং দিলেও তা সমতাভিত্তিক করা উচিত, শুধু গ্রামে নয়।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শামসুল আলম

প্রতিদিন গড়ে চার হাজার টন ফার্নেস তেলের চাহিদা আছে বিপিসির কাছে। এর মধ্যে দেশের একমাত্র জ্বালানি তেল পরিশোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল) থেকে দিনে ১ হাজার ১০০ টন করে ফার্নেস তেল পাওয়া যায়। আর বাকিটা আমদানি করতে হয়।

বাড়ছে গরম, বাড়ছে লোডশেডিং, ভোগান্তিতে মানুষ

বিপিসি সূত্র বলছে, গতকাল ১৪ জুন পর্যন্ত বিপিসির কাছে ফার্নেস তেলের মজুত ছিল ১৮ হাজার টন। দৈনিক চাহিদার হিসাবে মজুত আছে ৬ দিনের। সাধারণত এক মাসের মজুত রাখে বিপিসি।

প্রথম জাহাজ আসার পরও কিছুটা চাপ থাকবে, এটা ঠিক। তবে এ মাসে দ্বিতীয় কার্গো জাহাজ আসার পর চাপ কমবে। আগামী বছরের জন্য পিডিবি এখনো মাসওয়ারি চাহিদা দেয়নি। এটি দিলে সে অনুসারে আমদানির পরিকল্পনা করা হবে।
এ বি এম আজাদ, চেয়ারম্যান, বিপিসি

বিপিসির একজন কর্মকর্তা বলেন, ২২ জুনের মধ্যে ২৫ হাজার টন ফার্নেস তেল নিয়ে একটি কার্গো জাহাজ দেশে আসার কথা রয়েছে। জাহাজটি আসার কথা ছিল ১২ জুন। বিল পরিশোধে দেরি হওয়ায় এটা পিছিয়েছে। জাহাজটি বন্দরে পৌঁছার পর বিদ্যুৎকেন্দ্রে তেল সরবরাহ করতে আরও অন্তত ৮ দিন লাগবে। তাই মজুত তেল থেকে এখন চাহিদা পূরণ করা যাবে না। দিনে সরবরাহ কমিয়ে আপাতত চালাতে হবে। তবে ২৫ হাজার টন ফার্নেস তেল নিয়ে ২৬ জুনের মধ্যে আরও একটি জাহাজ আসার কথা রয়েছে।

তরল জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে ডিজেলচালিত ৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ৯৮৬ মেগাওয়াট। সবচেয়ে ব্যয়বহুল বিদ্যুৎ আসে এসব কেন্দ্র থেকে। খরচ কমাতে এগুলো বেশির ভাগ সময় বন্ধ থাকে। আর ফার্নেস তেলচালিত ৬৫টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা আছে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার মেগাওয়াট। কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমায় সর্বোচ্চ চাহিদার সময় রাতে ৫ হাজার মেগাওয়াটও উৎপাদন করা হয়েছে জ্বালানি তেল থেকে। আপাতত এটি আর সম্ভব হবে না।

বছরে প্রায় ৬০ লাখ টন বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি তেল আমদানি করে বিপিসি। এর মধ্যে ৭০ শতাংশই ডিজেল। মাসে এখনো ১০ থেকে ১২টি ডিজেল কার্গো আসছে। ৩০ দিনের চাহিদার সমপরিমাণ ডিজেল মজুত আছে। আর ফার্নেস তেলের কার্গো আসছে মাসে একটি বা দুটি। বছরে ৫০ লাখ টনের বেশি ফার্নেস তেল প্রয়োজন হয় বিদ্যুৎকেন্দ্রে। এর মধ্যে ৪৫ লাখ টন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নিজেরা আমদানি করত।

গ্রামে লোডশেডিং হচ্ছে ১০ ঘণ্টাও

তবে গত বছর থেকে আমদানি কমিয়েছে তারা। এতে বাড়তি চাহিদা পাচ্ছে বিপিসি। চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) সাড়ে ৮ লাখ টনের বেশি চাহিদা এসেছে। আগামী অর্থবছরে এ চাহিদা ১০ লাখ টনের বেশি। এ চাহিদা পূরণে হিমশিম খাচ্ছে বিপিসি।

জ্বালানি তেল আমদানির জন্য ব্যাংকের কাছে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। দফায় দফায় বাংলাদেশ ব্যাংককে জানানো হয়েছে। বিপিসির দুজন কর্মকর্তা বলেন, ১৩ জুন পর্যন্ত জ্বালানি তেলে প্রায় ২১ কোটি ডলার বকেয়া। বকেয়ার কারণে সরবরাহকারীদের কেউ কেউ জ্বালানি তেল দিতে রাজি হচ্ছে না। কেউ কেউ ক্রয়াদেশ বাতিল করে দিচ্ছে, কেউ সময় পেছাচ্ছে।

মধ্যরাতে কেন এত লোডশেডিং

বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ বলেন, প্রথম জাহাজ আসার পরও কিছুটা চাপ থাকবে, এটা ঠিক। তবে এ মাসে দ্বিতীয় কার্গো জাহাজ আসার পর চাপ কমবে। আর আগামী বছরের জন্য পিডিবি এখনো মাসওয়ারি চাহিদা দেয়নি। এটি দিলে সে অনুসারে আমদানির পরিকল্পনা করা হবে।

তবে গত বছর থেকে আমদানি কমিয়েছে তারা। এতে বাড়তি চাহিদা পাচ্ছে বিপিসি। চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) সাড়ে ৮ লাখ টনের বেশি চাহিদা এসেছে। আগামী অর্থবছরে এ চাহিদা ১০ লাখ টনের বেশি। এ চাহিদা পূরণে হিমশিম খাচ্ছে বিপিসি।

তেল কিনতে পারছে না বিদ্যুৎকেন্দ্র

বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নিয়মিত তাদের বিদ্যুৎ বিক্রির টাকা পাচ্ছে না। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কাছে তাদের পাওনা ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এতে তারা ব্যাংকের পাওনা পরিশোধ করতে পারছে না। আর ব্যাংক নতুন করে ঋণপত্র খুলতে রাজি হচ্ছে না। ফলে নিজেদের বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানোর জন্য ফার্নেস তেল আমদানি পিছিয়ে পড়ছে। এতে তারাও বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে পিডিবির কাছ থেকে ফার্নেস তেল চাইছে। আর বিপিসির কাছে বাড়তি চাহিদা জানাচ্ছে পিডিবি। তবে বেসরকারি খাতের কেউ কেউ নিজেরা আমদানি করছে।

বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের পরিচালক ফয়সাল করিম খান বলেন, পিডিবির কাছে ছয় মাসের বিল বকেয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের। তাই বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র তেল আমদানির ঋণপত্র খুলতে পারছে না। এমন কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও বিপিসির চেয়ে বেশি ফার্নেস তেল আমদানি করছে সামিট। বিল পরিশোধে বিলম্ব ও ডলারের বিপরীতে বিনিময় হারে আর্থিক ক্ষতির পরও বিদ্যুৎ উৎপাদন অব্যাহত রাখা হয়েছে।

বাড়তে পারে লোডশেডিং

লোডশেডিং
লোডশেডিং

পিডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, ডলার-সংকটে ছয় মাসের বেশি সময় ধরে কয়লা আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। কয়লার মজুত শেষ হয়ে পড়ায় আপাতত বন্ধ পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র। সক্ষমতার অর্ধেক উৎপাদন করছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ সরবরাহের চার দিনের মাথায় বন্ধ হয়েছে বাঁশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্র। এতে চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে না। কয়লার অভাব থাকায় জ্বালানি তেল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করছে পিডিবি। এখন এটিও কমছে।

মাঝে বৃষ্টির কারণে পাঁচ দিন তাপমাত্রা কম থাকায় তেমন লোডশেডিং করতে হয়নি। গত মঙ্গলবার থেকে লোডশেডিং বাড়তে শুরু করেছে। ওই দিন মধ্যরাতে দুই হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছে। গতকাল বুধবার বিকেল চারটায় সারা দেশে লোডশেডিং হয়েছে ১ হাজার ৯০৫ মেগাওয়াট। তবে ঢাকায় এখনো লোডশেডিং শুরু হয়নি।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শামসুল আলম বলেন, কয়লার পর জ্বালানি তেলও যদি সরবরাহ করা না যায়, বিদ্যুৎ উৎপাদন আরও কমে যাবে। তার মানে লোডশেডিংমুক্ত হওয়ার বিষয়টি দিগন্তরেখার মতো, ভোক্তার জীবনে এটি আর আসবে না। আর লোডশেডিং দিলেও তা সমতাভিত্তিক করা উচিত, শুধু গ্রামে নয়।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.