বিদায়, রিয়াল মাদ্রিদের ‘জাদুকর’

0
171
রিয়াল মাদ্রিদের কিংবদন্তি আমানসিও আমারো (১৯৩৯–২০২৩) ছবি: টুইটার

জাদুকরের মৃত্যুদিনে রিয়ালের দুটি প্রজন্মের মধ্যে একটি যোগসূত্র চোখে ভাসছে। হেন্তো সে বাঁধন। ষাটের দশকে টানা পাঁচ ইউরোপিয়ান কাপজয়ী রিয়ালে ডি স্টেফানো-পুসকাসদের যুগ শেষ হওয়ার পথে। সিউদাদ দেপোর্তিভোয় তত দিনে বেড়ে উঠেছে আরেকটি প্রজন্ম। এই প্রজন্ম পুরোপুরি স্প্যানিশ বংশজাত।

পুসকাস-ডি স্টেফানোদের সেই সোনালি প্রজন্মের সঙ্গে আমারো-পিরিদের ‘মাদ্রিদ ইয়ে ইয়ে’ প্রজন্মের যোগসূত্র ছিলেন হেন্তো। নতুন এই প্রজন্ম নিয়েই জিতলেন ১৯৬৬ ইউরোপিয়ান কাপ। সেটাই রিয়ালের প্রথম দল, যেখানে সবাই ছিলেন স্প্যানিশ। আর ব্রাসেলসের ফাইনালে সার্বিয়ান দল পার্টিজানের বিপক্ষে রিয়ালের ২-১ গোলের জয়ে প্রথম গোলটি ছিল আমানসিওর।

রিয়ালে ১৪ মৌসুম খেলে কিংবদন্তি হয়েছেন আমানসিও আমারিও

রিয়ালে ১৪ মৌসুম খেলে কিংবদন্তি হয়েছেন আমানসিও আমারিও
ছবি: টুইটার

আমানসিওকে বর্তমান প্রজন্ম সেভাবে না–ও চিনতে পারে। রিয়ালের ৭ নম্বর জার্সিটি এখন যে কিংবদন্তিতুল্য, তার শুরুটা কিন্তু রাইট উইংয়ে জাদুর ফোয়ারা ছোটানো আমানসিওর পায়েই। তার আগে জোসেইতো রিয়ালের ৭ নম্বর জার্সি পরেছেন কিছুদিন। কিন্তু আমানসিও আসার পর বদলে যেতে শুরু করল ৭ নম্বর জার্সির গল্প।

রিয়ালের এই ৭ নম্বর ‘অধ্যায়ে’ নামগুলো একবার দেখুন—আমানসিও, হুয়ানিতো (সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর ঘড়িতে সাত মিনিটের মাথায় তাঁকে আজও স্মরণ করা হয়), রেমন্ড কোপা, এমিলিও বুত্রাগুয়েনো, রাউল গঞ্জালেস ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো।

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে রোনালদোর শুরুও রাইট উইঙ্গার হিসেবেই ছিল। গোল করার নেশায় আরও ওপরে উঠে এলেন, রিয়ালের হয়ে সর্বোচ্চ গোলের ইতিহাসও গড়লেন, কিন্তু রিয়ালের স্প্যানিশ সমর্থকেরা ‘ঘরের ছেলে’ রাউলকে কিংবা খাঁটি মাদ্রিদিস্তা আমানসিওকে যতটা ভালোবাসেন, রোনালদোকে কি ততটা ভালোবাসেন? প্রশ্নটা উঠতেই পারে, যেহেতু চাহিদামতো বেতন না পেয়ে রোনালদো ২০১৮ সালে রিয়াল ছাড়ার সময় মাদ্রিদে তাঁর নামে ‘ভাড়াটে যোদ্ধা’র স্লোগানও উঠেছিল।

ছবিটি গত বছরের। রিয়াল তারকা করিম বেনজেমার সঙ্গে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর মাঠে ঢুকছেন আমানসিও আমারো

ছবিটি গত বছরের। রিয়াল তারকা করিম বেনজেমার সঙ্গে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর মাঠে ঢুকছেন আমানসিও আমারো
ছবি: এএফপি

আমানসিওর ব্যাপারটি তেমন নয়। রিয়ালের শোকবার্তাতেই ভালোবাসাটা আন্দাজ করে নেওয়া যায়, ‘টানা পাঁচ ইউরোপিয়ান কাপজয়ী সেই দলের পর পাকো হেন্তোকে নিয়ে আমানসিও রিয়ালের এমন একটি দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যাঁরা ক্লাবের ইতিহাস বিনির্মাণ করেছেন, মূল্যবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন। সব ফুটবলপ্রেমী ও মাদ্রিদিস্তা তাঁকে এই খেলার কিংবদন্তি হিসেবে মনে রাখবেন।’

রিয়ালে প্রায় পুরো ক্যারিয়ার রাইট উইঙ্গার হিসেবে খেলে ৪১৮ ম্যাচে ১৫৫ গোল। নয়বার লা লিগা ও একবার ইউরোপিয়ান কাপ (চ্যাম্পিয়নস লিগ) জয়; আমানসিওর এই পারফরম্যান্সের চেয়েও হয়তো বড় পরিচয় হয়ে থাকবে সত্তরের দশকে রিয়ালকে পথে ফেরানো প্রজন্মের খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন।

স্পেনের করুনায় জন্ম নেওয়া আমানসিও শৈশবে স্থানীয় দল ভিক্টোরিয়ায় খেলতেন। ১৯৫৮-৫৯ মৌসুমে যোগ দেন দেপোর্তিভোয়। দলটি প্রথম বিভাগে উঠে আসার পর সবার নজরে পড়তে শুরু করেন আমানসিও। রাইট উইংয়ে স্পেনের ইতিহাসে অন্যতম সেরা উইঙ্গারকে আবিষ্কারের আনন্দে রিয়াল মাদ্রিদের কিংবদন্তি সভাপতি সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর আর তর সয়নি। ১৯৬২ সালের সেই সময়ে ১ কোটি ২০ লাখ পেসোয় ২৩ বছর বয়সী আমানসিওকে নিয়ে আসেন রিয়ালে। আজ তাঁর মৃত্যুর পর ‘রেডিও মার্কা’য় রিয়ালের বোর্ড সদস্য হোসে ম্যানুয়েল ওতেরো বলছিলেন, ‘২২ বছর বয়সী আমানসিওর দাম হিসাব করা অসম্ভব। অমিত প্রতিভা থাকলে যা হয়।’

আমানসিও আমারো, আলফ্রেড ডি স্টেফানো (মাঝে) ও পাকো হেন্তো। রিয়ালের তিন কিংবদন্তি

আমানসিও আমারো, আলফ্রেড ডি স্টেফানো (মাঝে) ও পাকো হেন্তো। রিয়ালের তিন কিংবদন্তি
ছবি: টুইটার

ডান প্রান্তে ড্রিবলিংয়ে তাঁর পা চলত চাকুর মতো। অসামান্য গতি ও গুরুত্বপূর্ণ সময়ে গোল করার ‘পা যশ’ ছিল আমানসিওর। ৮৩ বছর বয়সে রিয়ালের অনারারি সভাপতি হিসেবে তাঁর মৃত্যুর শোকতপ্ত এ সময়ে অনেকে মনে করতে পারেন সেই সময়কে; ১৯৬০ সালে রিয়াল পঞ্চম ইউরোপিয়ান কাপ জয়ের পর পাঁচ বছরের ব্যবধানে ইউরোপে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট হারিয়েছিল। এই পাঁচ বছরে দুবার ফাইনাল খেলেও মুকুট পুনরুদ্ধার হয়নি।

১৯৬২ ইউরোপিয়ান কাপে পুসকাস, ডি স্টেফানো ও হেন্তোর সঙ্গে রিয়ালের আক্রমণভাগে অভিষেক আমানসিওর। সে বছর ফাইনালে রিয়াল হেরেছিল বেনফিকার কাছে। দুই বছর পর আবারও ফাইনালে উঠে ইন্টার মিলানের কাছ হার দেখেছিলেন আমানসিও। রিয়ালের হয়ে ডি স্টেফানোরও সেটি ছিল শেষ ম্যাচ (’৬৪ ফাইনাল)। এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে পা রাখার মধ্যবর্তী সেই সময়েই আমানসিওর আবির্ভাব।

অভিজ্ঞ ও তত দিনে কিংবদন্তি হয়ে ওঠা হেন্তোর সঙ্গে ছিলেন ঝাঁকড়া চুলের আরও কজন সম্ভাবনাময় তরুণ—হোসে আরাকুইস্তেন, পাচিন, পেদ্রো দে ফেলিপে, পিরি, ইগনাচিও জোকো, র‌্যামন গ্রোসেরা। কিংবদন্তি কোচ মিগুয়েল মুনোজের সেই দলকে ডাকা হতো ‘মাদ্রিদ ইয়ে ইয়ে’।

সবাই স্পেনের সন্তান। ঝাঁকড়া চুলের সঙ্গে জীবনযাত্রা ছিল ‘হিপ্পি’দের মতো। আর সত্তরের সে দশকে দুনিয়া কাঁপাচ্ছিল বিটলস। ব্রিটিশ ব্যান্ডের ‘শি লাভস ইউ’ গানের ‘ইয়ে ইয়ে’ কোরাস থেকে তাঁদের এই নাম দেওয়া হয়েছিল। ১৯৬৬ ইউরোপিয়ান কাপ জিতে আমানসিওদের সেই প্রজন্ম শুধু নাম রক্ষা করেনি, এখন রিয়াল ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতায় যে মানসিকতা নিয়ে মাঠে নামে, সেসবের শিকড়ও বিনির্মাণ করেছে।

রিয়ালের অনারারি সভাপতি হিসেবে শেষ জীবনে দায়িত্ব পালন করেছেন আমারিও

রিয়ালের অনারারি সভাপতি হিসেবে শেষ জীবনে দায়িত্ব পালন করেছেন আমারিও
ছবি: টুইটার

রিয়ালে ১৪ মৌসুম খেলা আমানসিওর স্পেনের জার্সিতে অভিষেক তাঁর প্রাণের ক্লাবে যোগ দেওয়ার বছরই। ১৯৬২ সালে রোমানিয়ার বিপক্ষে অভিষেকের পর ’৭৪ পর্যন্ত খেলে স্মরণীয় সাফল্যও পেয়েছেন। ৪২ ম্যাচে তাঁর ১১ গোলের পরিসংখ্যানে ১৯৬৪ ইউরো সেমিফাইনালে হাঙ্গেরির বিপক্ষে গোলটি মনে থাকবে অনেকের। সেবারই প্রথম ইউরো জিতেছিল স্পেন। ১৯৭৬ সালে অবসরের পর আমানসিও নেমেছিলেন কোচিংয়েও। না, রিয়াল ছাড়া আর কোনো দলকে কোচিং করাননি। ১৯৮৪-৮৫ পর্যন্ত ছিলেন রিয়ালের মূল দলের দায়িত্বে। তার আগে রিয়ালের কাস্তিয়া (বি দল) দলের কোচ হিসেবে জিতেছেন দ্বিতীয় বিভাগ।

১৯৮৪ সালে সেই দ্বিতীয় বিভাগ জিতেও অমর হয়ে আছেন আমানসিও। স্প্যানিশ ফুটবলে কোনো ক্লাবের ‘বি’ দলের দ্বিতীয় বিভাগ জেতার সেটাই একমাত্র নজির হয়ে আছে এখনো। আর সেই দলেই আমানসিওর অধীন বেড়ে উঠেছে রিয়ালের বিখ্যাত ‘কুইন্তা দেল বুইত্রে’—‘শকুনের দল’! এমিলিও বুত্রাগুয়েনো, মিকেল, ম্যানুয়েল সানচেজ, মার্টিন ভাসকুয়েজরা পরে রিয়াল মূল দলের হয়ে আশির দশকে দাপট ছড়িয়েছেন স্প্যানিশ ফুটবলে।

আমানসিও, গত বছর হেন্তো চলে যাওয়ার পর রিয়ালের অনারারি সভাপতির দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কি মাঠে, কি মাঠের বাইরে—রিয়ালকে মনে ধারণ করতেন সব সময়। বুত্রাগুয়েনো-মিকেলরা তাঁকে ‘ফুটবল-পিতা’র আসনে বসিয়েছিলেন। বাবার শেষ সময়ে সন্তানেরা যেমন পাশে থাকতে চায়, তেমনি রিয়ালের সেই বিখ্যাত ‘শকুনের দল’-এর সবাই গত রোববার ছুটে গিয়েছিলেন পুয়ের্তে হিয়েরো বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে।

শুধু মিকেল থাকতে পারেননি, গ্রিসের ক্লাব ফুটবলে ব্যস্ততার জন্য। এথেন্স থেকে ভিডিও কলে যোগ দেন বাকিদের সঙ্গে। সবাই আমানসিওর হাত ধরে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। সেই আশির দশকে আমানসিও তাঁদের ব্যাচের ওপর আস্থা রেখেছিলেন বলেই তো আজ তাঁরা বিখ্যাত ‘কুইন্তা দেল বুইত্রে’!

আর পৃথিবীর আনাচকানাচ থেকে যাঁরা আমানসিওকে ধন্যবাদ জানাতে পারেননি, তাঁরা চাইলে জেমসের গানটি মনে করতে পারেন, ‘কথা নয় মুখে মুখে/ কথা হবে মনে মনে/ দূরে কাছে যত বন্ধু আছে…’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.