বিক্ষোভের মুখে হাইকোর্টের ১২ বিচারপতিকে বিচারকাজ থেকে বিরত রাখা হচ্ছে

0
49
‘দলবাজ’ ও ‘দুর্নীতিবাজ’ বিচারপতিদের পদত্যাগ অথবা তাঁদের অপসারণের দাবিতে হাইকোর্ট ঘেরাও এবং বিক্ষোভ চলাকালে বক্তব্য দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম। গতকাল সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে
‘দলবাজ’ ও ‘দুর্নীতিবাজ’ বিচারপতিদের পদত্যাগ অথবা তাঁদের অপসারণের দাবিতে হাইকোর্ট ঘেরাও এবং বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছে। বিক্ষোভের মুখে হাইকোর্ট বিভাগের ১২ জন বিচারপতিকে আপাতত বেঞ্চ না দেওয়া, অর্থাৎ বিচারকাজ থেকে বিরত রাখার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। তবে তারা বিচারপতিদের নাম প্রকাশ করেনি।
 
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, বৈষম্যবিরোধী আইনজীবী সমাজ ও জাতীয় নাগরিক কমিটি-লিগ্যাল উইং আলাদাভাবে গতকাল বুধবার সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ করে। এই কর্মসূচির ঘোষণা আগের দিন মঙ্গলবার দেওয়া হয়েছিল। গতকালের বিক্ষোভকালে এক হাজারের বেশি শিক্ষার্থী, আইনজীবী ও নাগরিক কমিটির লোকেরা উপস্থিত ছিলেন।
 
বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, দলবাজ ও দুর্নীতিবাজ বিচারপতিরা আওয়ামী লীগের ইচ্ছা ও নির্দেশনাকে আইনে পরিণত করেছিলেন। বিচারাঙ্গনকে দলীয়ভাবে ব্যবহারের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার তাঁদের নিয়োগ দিয়েছিল। এই বিচারপতিদের দলবাজির কারণেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাজারো ছাত্র-জনতাকে হত্যার সাহস দেখিয়েছেন। এই বিচারপতিরা ফ্যাসিস্টের দোসর।
 
বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আলোচনা শেষে বিকেল চারটার দিকে হাইকোর্টের বর্ধিত ভবনের সামনে এসে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমদ ভূঞা বলেন, আপাতত ১২ জন বিচারপতিকে কোনো বেঞ্চ দেওয়া হচ্ছে না। এর অর্থ হলো, অবকাশ শেষে ২০ অক্টোবর আদালত খুললে তাঁরা বিচারকাজে অংশ নিতে পারবেন না।
 
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ১০ আগস্ট একইভাবে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ হয়েছিল। তখন পদত্যাগ করেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ আপিল বিভাগের ছয় বিচারপতি। ওই দিনই বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদকে বাংলাদেশের ২৫তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। পরে আপিল বিভাগে আরও চারজনকে বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়।
 
হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতির সংখ্যা ১০১। সরকার পতনের পর বিভিন্ন পক্ষ থেকে এই বিচারপতিদের অনেকের পদত্যাগের দাবি তোলা হচ্ছিল। সংখ্যাটি কখনো ২০, কখনো ২৫, কখনো ৩০ বলা হচ্ছিল। দাবি তোলা পক্ষগুলো কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বিচারপতিদের নামের তালিকা প্রকাশ করেনি, যাঁদের তারা পদত্যাগ চায়।
 
জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘আমরা পদত্যাগ চাওয়া বিচারপতিদের কোনো তালিকা দিইনি, সংখ্যাও বলিনি। অতীত ভূমিকা, কর্মকাণ্ড ও বক্তব্য বিশ্লেষণ করে দলবাজ ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রধান বিচারপতিসহ গ্রহণযোগ্য বিচারপতিদের কাছে আমরা দাবি জানিয়েছি।’
 
অবশ্য গতকাল সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ চলাকালে খবর ছড়ায় যে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ হাইকোর্ট বিভাগের ১২ জন বিচারপতিকে চায়ের দাওয়াত দিয়েছেন। পরে দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত আলাদাভাবে ছয়জন বিচারপতি প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা হলেন বিচারপতি এস এম মনিরুজ্জামান, বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামান, বিচারপতি শাহেদ নূরউদ্দিন, বিচারপতি মো. আখতারুজ্জামান, বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলাম ও বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসাইন দোলন।
 
সাক্ষাৎ শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় একাধিক বিচারপতির সঙ্গে সাংবাদিকেরা কথা বলার চেষ্টা করেন। তবে তাঁরা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। দুজন আগামী ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ছুটি নেওয়ার কথা জানিয়েছেন। দুজন বিচারপতি ছুটি নেওয়ার কথা জানালেও সময়সীমা উল্লেখ করেননি।
 
আইনজীবী ও বিচারালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর ভাষ্য অনুসারে, যে ১২ জন বিচারপতিকে আপাতত বেঞ্চ দেওয়া হবে না, তাঁদের মধ্যে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করা ছয়জনের নাম থাকতে পারে। বাকি ছয়জনের মধ্যে থাকতে পারেন বিচারপতি আতাউর রহমান খান, বিচারপতি নাইমা হায়দার, বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ, বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকার, বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাস ও বিচারপতি খিজির হায়াত।
 
সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন বলছে, কোন কোন বিচারপতিকে বেঞ্চ দেওয়া হয়নি, তা আদালত খোলার পরই দেখা যাবে। উল্লেখ্য, বেঞ্চ না দিলে বিচারপতিরা বিচারকাজে অংশ নিতে পারেন না।
 
সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বিক্ষোভ
 
দলবাজ ও দুর্নীতিবাজ বিচারপতিদের পদত্যাগের দাবিতে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ শুরু হয় সকাল সাড়ে ১০টায়। শুরুতে বিক্ষোভ করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের একটি দল, যাঁরা মূলত বিএনপিপন্থী হিসেবে পরিচিতি। তাঁদের ব্যানার ছিল ‘বৈষম্যবিরোধী আইনজীবী সমাজ’।
 
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে এসে বিক্ষোভ শুরু করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। শুরুতে তারা জড়ো হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে। সেখান থেকে মিছিল নিয়ে কয়েক শ শিক্ষার্থী যান সুপ্রিম কোর্ট এলাকায়। সেখানে আগে থেকে অবস্থান করছিলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী।
 
জাতীয় নাগরিক কমিটি-লিগ্যাল উইংয়ের ব্যানারে একদল বিক্ষোভকারী দুপুর ১২টার কিছু পর সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ শুরু করেন।
 
বিক্ষোভকালে নানা স্লোগান দিতে দেখা যায়। স্লোগানের মধ্যে ছিল ‘আইনজীবী-জনতা, গড়ে তোলো একতা’, ‘দফা এক দাবি এক, দলবাজদের পদত্যাগ’, ‘ফ্যাসিস্টদের প্রেতাত্মারা, হুঁশিয়ার সাবধান’, ‘আবু সাঈদের রক্ত, বৃথা যেতে দেব না’, ‘আবু সাঈদ মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ’, ‘আমার ভাইয়ের রক্ত, বৃথা যেতে দেব না’, ‘দফা এক দাবি এক, দুর্নীতিবাজদের পদত্যাগ’, ‘মুজিববাদ মুর্দাবাদ, ইনকিলাব জিন্দাবাদ’।
 
বিক্ষোভ চলাকালে নিজেদের দাবি নিয়ে বক্তব্য দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম। তিনি বলেন, ‘আদালতে মামলার রায়ের জন্য কোটি টাকা লেনদেন হয়। বৈষম্যহীন বাংলাদেশে টাকার বিনিময়ে আসামি খালাস করা বন্ধ করুন। এসব বন্ধ না হলে যেখানেই অভিযোগ পাব, সেখানেই আমরা চলে যাব।’ তিনি বলেন, দলবাজ ও দুর্নীতিবাজ বিচারপতিদের কোনো স্থান আদালতে হবে না।
 
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ফ্যাসিবাদের যাঁরা দোসর ছিলেন, তাঁদের দ্বারা আওয়ামী খুনি ও সন্ত্রাসীদের বিচার করা সম্ভব নয়।
 
বিক্ষোভকারী আইনজীবীদের অনেকেই হ্যান্ডমাইকে বক্তব্য দিচ্ছিলেন। তাঁরা বলেন, রাষ্ট্রের ভঙ্গুর অবস্থার জন্য দলবাজ ও দুর্নীতিবাজ বিচারপতিরাও দায়ী। এই বিচারপতিরা আওয়ামী লীগের নির্দেশ ও ইচ্ছাকে আইনে পরিণত করেছেন। এঁদের স্বেচ্ছায় সরে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা পদত্যাগ করেননি।
 
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ‘দলবাজ’ ও ‘দুর্নীতিবাজ’ বিচারপতিদের পদত্যাগ করতে প্রথমে বেলা দুইটা পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়। এরপর তা এক ঘণ্টা বাড়িয়ে বেলা তিনটা করা হয়। একপর্যায়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সঙ্গে আলোচনা করেন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমদ ভূঞা। বিকেল চারটার দিকে আজিজ আহমদ ভূঞা বিক্ষোভকারীদের জানান, ১২ জন বিচারপতিকে বেঞ্চ দেওয়া হবে না।
 
যা বললেন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার
 
বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশে আজিজ আহমদ ভূঞা বলেন, ‘আপনাদের নেতৃত্বকে নিয়ে দাবির বিষয়ে আমরা দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করেছি। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কথা বলেছি। বিচারপতির পদত্যাগ বা অপসারণ—এটার একটা প্রক্রিয়া আছে। বর্তমানে দেশে এ-সংক্রান্ত কোনো আইন বিদ্যমান নেই।’ তিনি আরও বলেন, বিচারপতিদের নিয়োগকর্তা হচ্ছেন রাষ্ট্রপতি। পদত্যাগ বা অপসারণের সেই উদ্যোগও রাষ্ট্রপতির দপ্তর থেকে হয়ে থাকে। এখানে সুপ্রিম কোর্টের, প্রধান বিচারপতির যেটা করণীয়, উনি সেটা করেছেন।
 
বিগত সরকার জাতীয় সংসদের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের উদ্যোগ নিয়েছিল উল্লেখ করে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল বলেন, সংবিধানে একটা সংশোধনী আনা হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট সেটা বাতিল করে দিয়েছেন। সেটা আবার সরকার রিভিউ আকারে পেশ করেছে।
 
আজিজ আহমদ ভূঞা আরও বলেন, ‘ওই মামলার (ষোড়শ সংশোধনী রিভিউ) শুনানি আছে ২০ তারিখে (অক্টোবর)। অ্যাটর্নি জেনারেল সেটি প্লেস করবেন। আশা করছি, এর মাধ্যমে পরবর্তী প্রক্রিয়াগুলো শুরু হবে। আর বিচারপতি অপসারণের সঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট এককভাবে জড়িত না; রাষ্ট্রপতি, অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় ও আইন উপদেষ্টা জড়িত আছেন। আপাতত ১২ জনকে বেঞ্চ দেওয়া হচ্ছে না। পর্যায়ক্রমে শুনানির মাধ্যমে বাকিগুলো আপনাদের সামনে আসবে।’
 
সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের বক্তব্যের পর বিক্ষোভকারীদের পক্ষ থেকে বলা হয়, আগামী রোববারের মধ্যে দলবাজ ও দুর্নীতিবাজ বিচারপতিদের অপসারণ করা না হলে আরও কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে। এরপর মিছিল নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ ছাড়েন বিক্ষোভকারীরা।
 
এদিকে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম। তিনি সেখানে লেখেন, দেশ আর দেশের মানুষের কথা চিন্তা না করে যাঁরা নির্লজ্জের মতো দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছেন, তাঁদের রোববারের মধ্যে অপসারণ করতে হবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.