বাবার শরীরের কোমল উষ্ণতা খুঁজে ফিরছি

0
159

বাবা সন্তানের মাথার ওপর স্নেহচ্ছায়া। বাইরে তিনি হয়তো কঠিন হতে পারেন, ভেতরে ততটাই কোমল। পরম নির্ভরতার প্রতীক। সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য নিজের বর্তমানকে হাসিমুখে উৎসর্গ করা এই বাবাদের আজ স্মরণ করার দিন। বাবা দিবস নিয়ে থাকছে সমতার বিশেষ আয়োজন। গ্রন্থনা শাহেরীন আরাফাত

মা-বাবা ঢাকায় এলে আমার বাসায় থাকতেন। তখন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ হয়ে যেতাম। বাবা অন্যলোকে পাড়ি জমিয়েছেন কয়েক মাসে আগে; আমার বাসায় আর কোনোদিন আসবেন না। এখন শুধু মাকে নিয়েই যতটুকু আবদার আর আনন্দ।
আমি যা-ই করতাম, সেগুলোর খবর প্রকাশিত হতো। সেই খবরের কাটিং বাবা ঘরের দেয়ালজুড়ে লাগিয়ে রাখতেন। এখন বাবা নেই। এখন আর কেউ স্নেহের পরশে ওই কাটিং দেয়ালে লাগিয়ে রাখবে না। আমাদের বাবা ছিলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক। ছোটবেলা থেকে হাজার মানুষের মুখে শুনেছি, ‘তুমি কিন্তু মাস্টার ছাওয়াল। ঠিকমতো পড়াশোনা করা লাগবি। ভালো মানুষ হওয়া লাগবি। সৎ মানুষ হওয়া লাগবি বাপের মতো। তা না হলি কিন্তু তুমার বাবার মুখ থাকপিনে।’

ইদানীং আমার চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা আর ব্যাক ব্রাশ করা চুল দেখলেই আমার ভাইবোনেরা বলে, আমি নাকি দেখতে দিন দিন বাবার মতো হয়ে যাচ্ছি। কিছুদিন হলো বাংলা বছরের প্রথম দিনটা পার হয়ে গেল। অভ্যাসটা ছিল বাবা-মাকে ফোন করে শুভ নববর্ষ বলা, আশীর্বাদ নেওয়া। এবার আর ফোনে বাবাকে পাইনি। কয়েক মাস আগে বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন অনন্তলোকে। আমার ভেতরটা যে কী কয়, কেমন করে বাবার জন্য, কাউকেই বোঝাতে পারি না। হঠাৎ করেই যখন মনে হয় বাবা নেই। চারপাশটা অন্ধকার লাগে, দম বন্ধ হয়ে আসে।

ছোট্টবেলার আবছা রাতের স্মৃতি ভেসে উঠে চোখের সামনে। তখনও গ্রামে বিদ্যুৎ আসেনি। অবিচল দুটো হাত সারারাত পালাক্রমে তালপাখায় বাতাস দিয়ে ঘুম পাড়াচ্ছে আমায়। হাত দুটো ছিল বাবা আর মায়ের। কী যে নেশা ওই পাখার বাতাসে! ভেজা চোখে এখনও দেখতে পাচ্ছি ওই দুটি হাত, তালপাখা। বাবা নেই; কিন্তু বাবা আমার কাছে বেশি করে আসে ইদানীং। সেদিন রাতেও এলো তালপাখা হাতে নিয়ে, আমাকে বাতাস দিয়ে ঘুম পাড়াতে। যখনই কোনো কাজে দেশের বাইরে যেতাম, বিমান ছাড়ার আগে বাবা-মার সঙ্গে ফোনে কথা বলে বিদায় নিতাম। কোনোদিন আর বাবাকে ফোন করে বলা হবে না। জিজ্ঞেস করা হবে না, ‘বাবা, তোমার জন্য কী আনব?’ বাবার একটাই উত্তর– ‘চেইনের ঘড়ি।’ শেষবার বাবার জন্য পছন্দ হয়েছিল বলে একসঙ্গে দুটো ঘড়ি এনেছিলাম। ঘড়ি দুটো আর বাবার হাতে দেওয়া হয়নি, তার আগেই বাবা সব সময়ের হিসাব-নিকাশ মিটিয়ে আকাশের তারা হয়ে গেলেন।

বাবার মৃত্যু আমাকে এতটাই মানসিকভাবে দুর্বল করে দিয়েছে যে, কোনো আনন্দেই আমি সান্ত্বনা পাচ্ছি না। কিছুদিন আগে ‘মৃণাল সেন’-এর ফার্স্টলুক প্রকাশ পাওয়ার পরও আমার শুভাকাঙ্ক্ষীদের উচ্ছ্বাস দেখে আপ্লুত হয়েছি। এত এত মানুষের আশীর্বাদ আর ভালোবাসা নিয়ে যখন নতুন কর্মযজ্ঞে অংশ নিতে চলেছি, তখন বারবার বাবার মুখটাই চোখের সামনে ভেসে উঠছে, আর চোখ দুটো বাঁধ না মানা জলে ভরে উঠছে।


২৭ ডিসেম্বর রাতে বাবা আমাদের সবার মায়া-মমতা ত্যাগ করে ইহলোক ত্যাগ করে চলে গেলেন পরলোকে। নিজগ্রাম কামারহাটের পদ্মাপাড়েই তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাবা মিশে গেলেন এই গ্রামেরই আলো-বাতাসে, পদ্মার জলে। সন্ধ্যায় ধর্মীয় আচার শেষে যখন নদীর পাড় থেকে বাড়ি ফিরলাম, তখন ভুলেই গেছিলাম, বাবাকেই তো নদীর পাড়ে রেখে এসেছি। সারারাত দুই চোখের পাতা এক করতে পারিনি। সারা বাড়িময়, ঘরময় যেন বাবা গুটি গুটি পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। এই বুঝি কখন আমায় ডাক দিয়ে বলবেন, ‘চঞ্চল, বাবা ঘুমাইছো?’

বাবার কোনো কথা আর কোনোদিন কানে বাজবে না, বাবাকে দেখতে পাব না, এগুলো কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। সেদিন শীতের ওই সকালে বাবার শালটাই আমার শরীরে জড়ানো ছিল। যে জায়গায় রোদে বসেছিলাম, এ জায়গায় বসেই বাবা রোদ পোহাতেন। রোদের উষ্ণতা নয়, বাবার শরীরের কোমল উষ্ণতা খুঁজে ফিরছি এখন। বাকি জীবনটা হয়তো এভাবেই খুঁজতে হবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.