ভ্যাপসা গরমের মধ্যে মঙ্গলবার দুপুরে নামে ঝুম বৃষ্টি। প্রিয় ক্যাম্পাসে শ্রাবণের বারি গায়ে মাখার লোভ সামলাতে পারেননি মোবাচ্ছেরা তানজুম হিয়া (২১) ও তাসপিয়া জাহান রিতু (২১)। অনাবিল আনন্দ নিয়ে দুই বান্ধবী ভিজে ভিজে হাঁটছিলেন গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) লেকপাড়ে। মুহূর্তের অসাবধানতায় পা পিছলে লেকে পড়ে যান পরিবেশ বিজ্ঞান ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী হিয়া। সাঁতার না জানা হিয়াকে বাঁচাতে লেকে লাফ দেন কিছুটা সাঁতার জানা রিতু। কিন্তু কেউ কারও বেঁচে ফেরার সারথি হতে পারেননি; দু’জনই ডুবে মারা গেছেন।
গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার মর্মন্তুদ এ ঘটনায় গোটা ক্যাম্পাসে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। হিয়া খুলনা শহরের বয়রা মধ্যপাড়া এলাকার এনজিও কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান মনিরের মেয়ে। অন্যদিকে রিতুর বাড়ি বাগেরহাটের ফকিরহাটে। বাবার নাম আব্দুর রব। তিনি উপজেলার বেতাগী ইউনিয়নের মাছকাটা গ্রামে নানাবাড়িতে বড় হয়েছেন।
হিয়ার মামা কে এম মিটুল বলেছেন, ‘আমার ভাগনি সাঁতার জানত না। দুপুরে বৃষ্টির সময় সে বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকপাড়ে বান্ধবী রিতুকে নিয়ে ভিজছিল। হিয়া পা পিছলে লেকে পড়ে গেলে তাকে উদ্ধারে রিতুও লাফ দিলে দু’জনেই ডুবে যায়। বৃষ্টি থামলে অন্য শিক্ষার্থীরা তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়।’
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী সাজেদুর রহমান আকাশ বলেন, বৃষ্টির মধ্যে দুপুরে ওই দুই শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকপাড়ে হাঁটছিলেন। এক পর্যায়ে পা পিছলে হিয়া লেকে পড়ে যান। তাঁকে উদ্ধারে পানিতে ঝাঁপ দেন রিতু। একজনের হাত দেখে আমিও গিয়ে উদ্ধারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। খবর পেয়ে ফায়ার
সার্ভিসের কর্মীরা এসে প্রায় আধা ঘণ্টা পর দু’জনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেন, ততক্ষণে সব শেষ।
গোপালগঞ্জ ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত ডা. কাজী ইসমাইল হোসেন জানান, হাসপাতালে আনার অনেক আগেই দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে।
হিয়া ও রিতুর সহপাঠীদের অভিযোগ, লেকপাড় অরক্ষিত। কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তা বেষ্টনী দিলে এমন মৃত্যু দেখতে হতো না। খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক একিউএম মাহবুব, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মোবারক হোসেন, প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক মো. শাহজাহান, রেজিস্ট্রার দলিলুর রহমান, শিক্ষক সমিতির সভাপতি কামরুজ্জামানসহ কর্মকর্তারা হাসপাতালে ছুটে আসেন।
এ সময় উপাচার্য সাংবাদিকদের বলেন, ‘লেকে শিক্ষার্থীদের গোসল করা নিষেধ। তার পরও দুই শিক্ষার্থী বৃষ্টির মধ্যে গোসল করতে গিয়ে ডুবে মারা গেছে। ঘটনাটি খুবই হৃদয়বিদারক। আমরা গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করছি। একই সঙ্গে শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি।’ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে বলে জানান তিনি।
গতকাল বিকেলে খুলনা নগরীর বয়রা মধ্যপাড়া এলাকায় হিয়ার বাড়িতে গিয়ে জানা যায়, মা-বাবা ও একমাত্র ভাই মরদেহ আনতে গোপালগঞ্জ
গেছেন। বাড়ির আঙিনায় একটি খাটিয়া রয়েছে। মরদেহ কখন আসবে– প্রতিবেশীরা একটু পর পর এসে জানার চেষ্টা করছেন। এ সময় প্রতিবেশীরা জানান, মেধাবী হিয়া ২০১৮ সালে খুলনার সরকারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ২০২০ সালে সরকারি মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। দুই ভাইবোনের মধ্যে হিয়া বড়। ছোট ভাই তূর সরকারি এম এম সিটি কলেজে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ে।
অন্যদিকে বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার বেতাগী ইউনিয়নের মাসকাটা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, রিতুর নানা এবারত আলী মোল্লা ও নানি হাওয়া বেগম পাগলপ্রায়। কাঁদতে কাঁদতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন তাঁরা। প্রতিবেশেীরা জানান, ব্যবসা-চাকরি ও ছোট বোনকে দেখভালের জন্য রিতুর মা-বাবা চাঁদপুরে থাকেন। ছোট থেকেই নানা-নানির কাছে বড় হয়েছেন রিতু। ছুটিতে নাতনি বাড়ি এলে, তাকে নিয়ে গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন ১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য এবারত আলী। ২০১৭ সালে ফকিরহাটের বেতাগা আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ২০১৯ সালে খুলনা বয়রা মহিলা কলেজে থেকে এইচএসসি পাস করে গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন রিতু।
স্থানীয় ১ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. আসাদুজ্জামান তুহিন জানিয়েছেন, বড় মেয়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে চাঁদপুর থেকে বাবা আব্দুর রব ও মা রুমা বেগম রওনা দিয়েছেন। নানাবাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে রিতুর লাশ দাফনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে পরিবার।