বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে প্রথমবারের মতো স্বল্পমেয়াদি ঋণ দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বিশ্বব্যাপী চলমান প্রথা ভেঙে প্রাথমিকভাবে শুধু ইউরো মুদ্রায় ঋণ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মাত্র আড়াই শতাংশ সুদে মূলধনি যন্ত্রপাতি, শিল্পে ব্যবহূত কাঁচামালসহ কয়েকটি পণ্য আমদানির জন্য ঋণ পাবেন উদ্যোক্তারা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনের পর এ বিষয়ে নীতিমালা তৈরির কাজ প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে এসেছে। বিশ্নেষকরা বলছেন, বর্তমানে বিশ্বের কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের ঋণ দেওয়ার কোনো প্রচলন নেই। তাছাড়া এটা ঝুঁকিপূর্ণ।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের গত ১ জুলাইয়ের বৈঠকে রিজার্ভ থেকে ইউরো মুদ্রায় ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে বলা হয়, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে সংঘটিত ইউপাস বা ডেফার্ড এলসির বিপরীতে ইউরো মুদ্রায় উচ্চ সুদে ঋণ নেওয়ার ফলে দেশের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার বহিঃপ্রবাহ বাড়ছে। এই বহিঃপ্রবাহ রোধ করতে ইউরোতে বিনিয়োগ প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। তবে এ ক্ষেত্রে বিভাগীয় পর্যায়ে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে গভর্নরের অনুমোদন নিতে বলা হয়।
সংশ্নিষ্টরা জানান, সিদ্ধান্তের আলোকে নীতিমালা তৈরির কাজ প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। নীতিমালার একটি খসড়া এখন গভর্নরের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এটি অনুমোদন হলে আগ্রহী ব্যাংককে প্রথমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সঙ্গে একটি অংশগ্রহণমূলক চুক্তি করতে হবে। ব্যাংকগুলো গ্রাহক পর্যায়ে ঋণ দিয়ে এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অর্থ তুলে নেবে।
গ্রাহক পর্যায়ে সুদহার ধার্য হবে ইউরো ইন্টার ব্যাংক অফার রেট (ইউরিবর) অনুযায়ী। এর সঙ্গে যোগ হবে আড়াই শতাংশ। ইউরিবর যদি ঋণাত্বক হয় সে ক্ষেত্রে শূন্য ধরে আড়াই শতাংশ সুদ হিসাব করা হবে। তার মানে বর্তমানে গ্রাহকরা আড়াই শতাংশ সুদে ঋণ পাবেন।
অফশোর ব্যাংকিং থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় বিদ্যমান স্বল্পমেয়াদি (ইউপাস ও ডেফার্ড) ঋণের আলোকে প্রতিষ্ঠানগুলো সর্বোচ্চ এক বছরের জন্য ঋণ নিতে পারবে। শুধু মূলধনি যন্ত্রপাতি, শিল্পে ব্যবহূত কাঁচামাল, সমুদ্রগামী নৌযান, কৃষি উপকরণ, লৌহ এবং অপ্রক্রিয়াজাত তেল, চিনি ও গম আমদানিতে এ ঋণ দেওয়া হবে।

জানতে চাইলে বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন,‘ রিজার্ভ জাতীয় সম্পদ। এটা রাখা হয় মুনাফা করার জন্য নয়, বিপদে-আপদে আমদানিতে ব্যবহারের জন্য। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের ঋণ দেওয়ার কথা আগে কখনও শুনিনি। এটা ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত। রিজার্ভ ব্যবস্থাপনাকে ঝুঁকিতে ফেলবে। ইউরো মুদ্রায় লোকসান ঠেকানোর জন্য স্থানীয় উদ্যোক্তাদের ঋণ না দিয়ে অন্য বিদেশি মুদ্রায় এটা রাখা যেত।’
‘সব অর্থ নগদে না রেখে বন্ডেও খাটানো যেত। যুক্তরাষ্ট্র এখন দীর্ঘমেয়াদি ট্রেজারি বিলের তুলনায় স্বল্পমেয়াদি ট্রেজারি বিলে বেশি সুদ দিচ্ছে। সাময়িকভাবে সেখানে রেখে পরবর্তীতে ইউরোর পরিস্থিতি ভালো হলে আবার সেখানে বিনিয়োগ করা যেত। কেননা দেশীয় উদ্যোক্তাদের ঋণ নিয়ে পরিশোধ করার সংস্কৃতি খুব একটা ভালো না। সেখানে রিজার্ভ থেকে ঋণ দিয়ে সুদ-আসলে ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা নিয়ে সংশয় আছে। এ অর্থ যদি ফেরত না আসে তাতে বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিকভাবে লোকসানে না পড়লেও দেশের ক্ষতি হবে।’
এর আগে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগের সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে অর্থ ব্যয়ের প্রসঙ্গ আসে। তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেছিলেন, প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করা হবে। তখন অর্থনীতিবিদসহ বিভিন্ন পক্ষ এ প্রস্তাবের সমালোচনা করে। এরপর রিজার্ভ থেকে অর্থ ব্যয়ের বিষয়টি আর এগোয়নি। এখন নতুন করে রিজার্ভ থেকে ইউরো মুদ্রা ঋণ হিসেবে দেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
কেন ঋণ দেওয়ার উদ্যোগ : কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত জুন পর্যন্ত ইউরো মুদ্রায় বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ রয়েছে ১১ কোটি ৮০ লাখ। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ এক হাজার ১০৪ কোটি টাকা। ইউরো অঞ্চলে ধারাবাহিকভাবে সুদহার কমতে থাকায় ইউরো মুদ্রায় রক্ষিত বাংলাদেশের রিজার্ভ কমে লোকসানে পড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একই সময়ে দেশের অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটগুলো ইউরো জোনের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ৪১ কোটি ২০ লাখ ইউরো ঋণ নিয়েছে। টাকার অঙ্কে যা ৩ হাজার ৮৫৬ কোটি। গড়ে ২ শতাংশ সুদে এসব ঋণ আনা হয়েছে।
তবে ঝুঁকি প্রিমিয়ামসহ এসব ঋণের সুদহার দাঁড়াচ্ছে তিন থেকে সাড়ে তিন শতাংশ। এতে একদিকে দেশটিতে রক্ষিত অর্থে লোকসান হচ্ছে। আরেক দিকে তিন শতাংশের বেশি সুদে ঋণ আনছেন এখানকার উদ্যোক্তারা। এ রকম পরিস্থিতিতে রিজার্ভের বিকল্প বিনিয়োগের ব্যবস্থা না করলে লোকসান অব্যাহত থাকবে। আবার দেশ থেকে সুদসহ ইউরোর বহিঃপ্রবাহ চলতেই থাকবে। ফলে আমদানি দায় পরিশোধ, রফতানি বিল ডিসকাউন্টিং এবং বায়ার্স ক্রেডিট হিসেবে ইউরো মুদ্রা ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া যায় বলে ওই প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্নিষ্ট এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বৈশ্বিক মন্দার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৮ সালের নভেম্বর থেকে ইউরিবর কমতে থাকে। ২০১৫ সালের মে মাসে যা নেতিবাচক পর্যায়ে পৌঁছায়। এ পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপিয়ান কেন্দ্রীয় ব্যাংক তিন বছরমেয়াদি কর্মসূচির অধীনে প্রতি মাসে ৩০ বিলিয়ন ইউরোর সমমূল্যের বেসরকারি বন্ড কেনা শুরু করে।
পরবর্তীতে মূল্যস্ম্ফীতির লক্ষ্য অর্জিত হওয়ায় ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতি মাসে ১৫ বিলিয়ন ইউরোর বন্ড কেনা হয়েছে। তবে আইএমএফ ও অন্যান্য বৈশ্বিক সংস্থার সতর্কতামূলক পূর্বাভাস, ২০১৯-২১ মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের সুদহার স্থির রাখার ইঙ্গিত এবং আগামী অক্টোবরে ব্রেক্সিটের সম্ভাবনার ফলে সহসা সুদহার বৃদ্ধির সম্ভবনা নেই। এ রকম পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় অংশগ্রহণমূলক চুক্তির মাধ্যমে ঋণ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
রিজার্ভের কী হবে :প্রতিটি দেশের আপদকালীন আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রাখা হয়। বিভিন্ন দেশ রক্ষিত এই রিজার্ভের অর্থের বিপরীতে খুব সামান্যই মুনাফা পায়। নব্বইয়ের দশকে এশিয়া অঞ্চলে সংকট দেখা দিলে থাইল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এর রিজার্ভ থেকে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের ঋণ দিয়েছিল। এরপর ১৯৯৬ সালে একটি নীতিমালা করে আইএমএফ। সেখানে বলা হয়, স্থানীয় উদ্যোক্তাদের মাঝে বিতরণ করা ঋণ রিজার্ভে দেখানো যাবে না।
বর্তমানে বাংলাদেশের রিজার্ভ রয়েছে ৩২ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার যা দিয়ে প্রায় সাড়ে ৬ মাসের আমদানি দায় মেটানো সম্ভব। বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের বর্তমানে রিজার্ভ রয়েছে ৩২০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এর আগে ২০১৭ সালের জুনে বাংলাদেশের রিজার্ভ প্রথমবারের মতো ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছিল। তবে বর্তমানে সরবরাহের তুলনায় জোগান কম থাকায় রিজার্ভ কমে এ পর্যায়ে নেমেছে। ইউরো মুদ্রায় ঋণ দিলে সামান্য হলেও রিজার্ভ কমবে। তাছাড়া একবার নজির তৈরি হলে তখন ডলারেও ঋণ দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর চাপ তৈরির আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্নিষ্টরা।
খেলাপি হলে কী হবে :সংশ্নিষ্টরা বলছেন, স্থানীয় মুদ্রার পাশাপাশি বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে খেলাপি হওয়ার নজির বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের মধ্যে রয়েছে। ফলে রিজার্ভ থেকে নেওয়া ঋণ খেলাপি হলে কী হবে। সুত্র বলছে, দ্বিপক্ষীয় চুক্তির বিপরীতে ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ নিয়ে গ্রাহক পর্যায়ে ঋণ দেবে। নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে গ্রাহকের কাছ থেকে আদায় করে সুদসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দেবে ব্যাংকগুলো। কোনো কারণে গ্রাহক খেলাপি হলে বা ব্যাংক নির্দিষ্ট সময়ে অর্থ ফেরত না দিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে রক্ষিত সংশ্নিষ্ট ব্যাংকের চলতি হিসাব থেকে কেটে নেওয়া হবে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ খোয়া যাওয়ার আশঙ্কা নেই বললেই চলে।