বাংলাদেশে প্রয়োজনের সময় ৭০ শতাংশ মানুষ অক্সিজেন পায় না

0
21
অক্সিজেন

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অক্সিজেনকে বলছে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ। অথচ বাংলাদেশে প্রয়োজনের সময় প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ ঠিকমতো অক্সিজেন পায় না। যোগাযোগ, প্রস্তুতি ও সরবরাহ পরিষেবার ঘাটতি এবং সেবার নিম্নমানের কারণে সময়মতো অক্সিজেন পায় না মানুষ।

গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর একটি পাঁচতারা হোটেলে আয়োজিত ‘বাংলাদেশ অক্সিজেন সামিট ২০২৫’–এ এ কথা বলা হয়। অনুষ্ঠানে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, অক্সিজেনকে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সম্মেলনে গবেষক ও বিজ্ঞানীরা বলেন, বাংলাদেশে প্রতিবছর ৭৪ লাখ মানুষের মেডিকেল অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়। অক্সিজেন খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার।

স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সাময়িকী দ্য ল্যানসেট গ্লোবাল হেলথ ২০২২ সালে অক্সিজেন নিরাপত্তা বিষয়ে একটি কমিশন গঠন করেছিল। ওই কমিশন মেডিকেল অক্সিজেনের নিরাপত্তা বিষয়ে এ বছরের মার্চে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

গতকালের অনুষ্ঠানে ল্যানসেট কমিশনের প্রতিবেদনের মূল বিষয়ের পাশাপাশি দেশের মেডিকেল অক্সিজেন পরিস্থিতি, সরকার কী করছে, অক্সিজেনপ্রাপ্তি নিশ্চিতে কী করা উচিত, তা নিয়ে আলোচনা হয়। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি), দ্য ল্যানসেট গ্লোবাল হেলথ এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এভরি ব্রেথ কাউন্টস ও ইউনিটাইড যৌথভাবে এক দিনের এ সম্মেলনের আয়োজন করে।

সম্মেলনের প্রধান অতিথি ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান বলেন, অক্সিজেন মূলত জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়। সরকার এ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়। এখন অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা হালনাগাদ করার কাজ চলছে। ওই তালিকায় অক্সিজেনকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনের সভাপতি ও আইসিডিডিআরবির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক তাহমিদ আহমেদ বলেন, ‘আমরা কখনো চিন্তা করি না যে আমার অক্সিজেনের প্রয়োজন। অক্সিজেন না থাকলে জীবন থেমে যায়। অক্সিজেনের ক্ষেত্রে দেশ উন্নতি করেছে। তবে দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভোগা মানুষের অক্সিজেনের চাহিদা বাড়ছে।’

অক্সিজেন পেতে ৪ বাধা

অনুষ্ঠানে জানানো হয়, অক্সিজেন শিল্পে ও চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। চিকিৎসায় ব্যবহৃত অক্সিজেন ‘মেডিকেল অক্সিজেন’ নামে পরিচিত। মূলত তিনটি ক্ষেত্রে মেডিকেল অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়: জরুরি চিকিৎসার চাহিদা (শিশু ও বয়স্ক), অস্ত্রোপচার ও দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভোগা মানুষ, বিশেষ করে শ্বাসতন্ত্রের দীর্ঘস্থায়ী রোগ (সিওপিডি)।

দ্বিতীয় অধিবেশনে অক্সিজেন নিরাপত্তা বিষয়ে মূল উপস্থাপনায় ল্যানসেট কমিশনের সদস্য ও আইসিডিডিআরবির ইমেরিটাস বিজ্ঞানী শামস এল আরেফিন বলেন, বৈশ্বিকভাবে দেখা যায়, অনেকে অক্সিজেনের প্রয়োজনের সময় হাসপাতালে বা ক্লিনিকে পৌঁছাতে পারেন না। হাসপাতালে পৌঁছালে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি অক্সিজেন দেওয়ার জন্য প্রস্তুত নয়। হাসপাতাল প্রস্তুত থাকলেও দেখা যায় নানা ঘাটতি আছে। আবার দেখা যায় সেবা মানসম্মত নয়।

শামস এল আরেফিন বলেন, অক্সিজেনপ্রাপ্তির এই চার ধাপের সমস্যা অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশেও আছে। ৪৬ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ অক্সিজেনের প্রয়োজনের সময় হাসপাতালে বা ক্লিনিকে পৌঁছাতে পারে না বা প্রতিষ্ঠান বাড়ি থেকে অনেক দূরে, ২ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ হাসপাতালে গিয়ে দেখে প্রতিষ্ঠান প্রস্তুত নয়। আবার ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ দেখে, অক্সিজেন দেওয়ার ক্ষেত্রে নানা ঘাটতি আছে। সবশেষে দেখা যায়, ৭ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ মানসম্মতভাবে অক্সিজেন পায় না। এভাবে দেখা যায়, প্রয়োজনে ৭০ শতাংশ মানুষ অক্সিজেন পায় না।

তবে অধিবেশনের এক পর্যায়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান এ পরিসংখ্যানের ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, দেশে মেডিকেল অক্সিজেনের কোনো ঘাটতি নেই।

সময় ৩ মিনিট

সকালের অধিবেশনে ল্যানসেট কমিশনের প্রতিবেদনের মূল বিষয়বস্তু উপস্থাপনার সময় কমিশনের নির্বাহী কমিটির সমস্য ও আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী আহমদ এহসানূর রহমান অক্সিজেনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সাধারণত মানুষ খাদ্য ছাড়া তিন সপ্তাহ বাঁচতে পারে, পানি ছাড়া বাঁচতে পারে তিন দিন। আর অক্সিজেন ছাড়া মানুষ তিন মিনিটের বেশি বাঁচতে পারে না।

আহমদ এহসানূর রহমান বলেন, প্রতিবছর সারা বিশ্বে ৩৭ কোটি ৪০ লাখ মানুষের মেডিকেল অক্সিজেনের দরকার হয়। এসব মানুষের চাহিদা মেটাতে ১২০ কোটি ঘনমিটার অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়। দিন দিন এ চাহিদা বাড়ছে। অক্সিজেনের চাহিদা তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বেশি। তিনি বলেন, বিলম্বে অক্সিজেন দেওয়ার অর্থ জীবনকে অস্বীকার করা।

সম্মেলনের একাধিক অধিবেশনে একাধিক আলোচক কোভিড মহামারির সময় অক্সিজেনের প্রয়োজনীয়তা ও সংকটের কথা তুলে ধরেন। শিশুরোগবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবিদ হোসেন মোল্লা বলেন, ‘কোভিড আমাদের শিখিয়েছে, অক্সিজেন কতটা জরুরি। কোভিড শিখিয়েছে, কীভাবে অক্সিজেন দিতে হয়।’

অনুষ্ঠানে বলা হয়, বাংলাদেশে জরুরি চিকিৎসার চাহিদায় ২ কোটি ৩৪ লাখ ঘনমিটার, অস্ত্রোপচারে ২৩ লাখ ঘনমিটার এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগ বা সমস্যায় ৫ কোটি ৮৩ লাখ ঘনমিটার অক্সিজেন দরকার হয়।

বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ কাজী সাইফউদ্দীন বেননূর বলেন, দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভুগছেন—এমন মানুষের মাসের পর মাস, বছরের পর বছর মেডিকেল অক্সিজেন দরকার হয়। তবে সবাই প্রয়োজনের সময় চাহিদামাফিক অক্সিজেন পায় না।

করণীয় বা সুপারিশ

ল্যানসেট কমিশন প্রতিবেদনে সরকার, অক্সিজেনশিল্পের মালিক, স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান, দাতা সংস্থা, নাগরিক সংগঠন, গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ও পেশাজীবী সংগঠনের করণীয় বিষয়ে লম্বা সুপারিশ রয়েছে। সম্মেলনের শেষ পর্যায়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব মো. মহিউদ্দীন আল হেলাল বাংলাদেশে অক্সিজেন নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য একটি পথরেখার খসড়া উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, সবার জন্য নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও নির্ভরযোগ্য অক্সিজেন নিশ্চিত করতে হবে।

এর আগে কোভিডের সময় কোন দেশ, কোন প্রতিষ্ঠান বিশ্বের কোথায় কোথায় অক্সিজেনের সংকট মোকাবিলায় কী উদ্যোগ বা কী উদ্ভাবন করেছিল, তার বর্ণনা দেওয়া হয় অনুষ্ঠানে। এ অধিবেশনে আইসিডিডিআরবি, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা তাঁদের অক্সিজেন–সম্পর্কিত উদ্ভাবনের বর্ণনা দেন।

অন্যদিকে অক্সিজেন উৎপাদন, নিয়ম-বিধি ও বিনিয়োগবিষয়ক পৃথক অধিবেশনে বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র অপারেশন অফিসার ইফ্ফাত মাহমুদ, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. মোহিত ইসলাম, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) কাজী দেলওয়ার হোসেন বক্তব্য দেন।

সম্মেলনের বিভিন্ন অধিবেশনে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সেবা বিভাগের সচিব মো. সাঈদুর রহমান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবু জাফর, ইউনিসেফের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা পিয়া ফিও থান চো, সোসাইটি অব সার্জনস অব বাংলাদেশের সদস্যসচিব অধ্যাপক সালেহীন, বাংলাদেশ সোসাইটি অব মেডিসিনের সদস্যসচিব মোহাম্মদ জাকারিয়া আল-আজিজ, বুয়েটের বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ তারিক আরাফাত।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.