বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতির সমালোচনায় পশ্চিমারা, ভারত-চীন-সৌদির প্রশংসা

0
113
পোশাক শ্রমিক

শ্রম অধিকার চর্চা, শ্রমিকদের ওপর হামলা-নির্যাতন বন্ধসহ শ্রম আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার নিয়ে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থার (আইএলও) চলতি অধিবেশনে পশ্চিমাদের চরম সমালোচনার মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশের প্রশংসা করেছে ভারত, চীন, সৌদি আরব, ইরানসহ বিভিন্ন দেশ। অধিবেশনে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক শ্রম আইন সংশোধনে জোরালো রাজনৈতিক অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, শ্রম পরিস্থিতির উন্নয়নে বাংলাদেশের উদ্যোগের যথাযথ স্বীকৃতি না দিলে আইএলওসহ আন্তর্জাতিক অংশীজনের সঙ্গে আস্থার সংকট তৈরি হতে পারে।

মঙ্গলবার সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় আইএলওর ৩৫০তম অধিবেশনে বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতির অগ্রগতি নিয়ে পর্যালোচনা হয়। আলোচনার শুরুতে আইনমন্ত্রী আইএলওর পথনকশা অনুযায়ী সরকার কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে, তা উপস্থাপন করেন। পরে বিভিন্ন দেশ, জোট, সংগঠন ও আইএলওর পরিচালনা পরিষদের সদস্যসহ ২৪ জন বাংলাদেশের পরিস্থিতি ও প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তাদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। সবশেষে আইনমন্ত্রী ওই পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে পাল্টা বক্তব্য উপস্থাপন করেন।

শুনানিতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আর্জেন্টিনা বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতি নিয়ে বেশ সমালোচনা করে। আইএলওর পরিচালনা পরিষদে মালিকদের প্রতিনিধি বাংলাদেশের পরিস্থিতির উন্নতির তাগিদ দেওয়ার পাশাপাশি এখন পর্যন্ত নেওয়া উদ্যোগের প্রশংসা করেন। এ ছাড়া ভারত, চীন, সৌদি আরব, ইরানসহ অনেক দেশের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের নেওয়া পদক্ষেপের প্রশংসা করেন। তারা আইএলওর ২৬ ধারা অনুযায়ী ৮১, ৮৭ ও ৯৮ সনদ অনুসরণ না করায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা তুলে নেওয়ার প্রস্তাব করেন।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রশ্নোত্তর পর্বে পশ্চিমাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পর বাংলাদেশ উল্লিখিত সনদ মানছে না বলে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, সেটি প্রত্যাহারের অনুরোধ জানান।

আলোচনার শুরুতে আইএলওর পরিচালনা পরিষদের সভাপতি রিচার্ড এ আদেজোলা গত ২৯ জানুয়ারি আইএলওর কাছে উত্থাপিত প্রতিবেদনের প্রসঙ্গ টানেন। তিনি বলেন, সামগ্রিকভাবে ২০২১ থেকে ২০২৬ সালের মধ্যে আইএলওর কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাংলাদেশে শ্রম আইন সংশোধনসহ প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিষয়ে জোরালো অঙ্গীকার প্রতিফলিত হয়েছে। শ্রম আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে সরকার ও অংশীজনের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ত্রিপক্ষীয় আলোচনা এগিয়ে নিতে হবে। প্রয়োজনে আইএলওর কারিগরি সহায়তা এবং মালিক ও শ্রমিক পক্ষের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে।

এর পর আইএলওর পরিচালনা পরিষদের সভাপতি বাংলাদেশের আইনমন্ত্রীকে বক্তব্য দেওয়ার আহ্বান জানান। আইনমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় লিখিত প্রতিবেদনের ধারাবাহিকতায় এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে, তা তুলে ধরেন। এর পর জাতীয় নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে কেন শ্রম আইনের সংশোধন করা গেল না, তা ব্যাখ্যা করেন। সংসদের আগামী অধিবেশনে তিনি শ্রম আইন সংশোধনের আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি এ সময় জানান, শ্রমিক নেতা শহীদুল ইসলাম হত্যার চার্জশিট প্রস্তুত, দ্রুতই সম্পন্ন হবে বিচারকাজ।

আনিসুল হক এ সময় বলেন, আইএলওর সঙ্গে সম্মত পথনকশা অনুযায়ী, চারটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতির উন্নয়নে নতুন সরকারের জোরালো রাজনৈতিক অঙ্গীকার আছে। পরিস্থিতির উন্নতির স্বার্থে বাংলাদেশকে আরও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। তবে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, সেগুলোর যথাযথ স্বীকৃতি না দেওয়া ও যান্ত্রিকভাবে পরিস্থিতির উন্নতি দাবি অংশীদারিত্বের মাঝে আস্থার সংকট তৈরি করতে পারে। বাংলাদেশের যে অঙ্গীকার রয়েছে, সেটির প্রশংসা করা প্রয়োজন।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন সলিডারিটি সেন্টারের পরিচালক জেফরি ভগ্ট বলেন, বাংলাদেশে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নে যুক্ত হওয়ার স্বাধীনতা নেই। দরকষাকষিতে যুক্ত থাকার হার খুবই কম। শ্রমিকরা প্রতিনিয়ত নানা ধরনের সহিংসতার মুখোমুখি হচ্ছেন। নারী কর্মীরা নানাভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। বাংলাদেশের শ্রম আইনে যে সংস্কার হয়েছে, তা একেবারেই ন্যূনতম। বিশেষ করে শ্রম অধিকার চর্চার ন্যূনতম শর্ত পথনকশা অনুযায়ী পূরণে বাংলাদেশ ব্যর্থ হয়েছে।

আইএলওর পরিচালনা পরিষদে মালিকদের প্রতিনিধি জার্মানির রেনাটে ড্রাইস বলেন, নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ দ্রুত পথনকশা অনুযায়ী সংস্কার প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করবে বলে আমরা আশাবাদী। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, পরবর্তী সময়সীমা শেষ হওয়ার আগে বাংলাদেশ যাতে সংস্কার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে পারে।

ইইউর প্রতিনিধি লিজিন ইলিইস বলেন, যে সংস্কার বাংলাদেশে হয়েছে, তা আংশিক, বিষয়টি উদ্বেগের। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, বাংলাদেশের নতুন সরকার সব অংশীজনকে নিয়ে দ্রুত শ্রম অধিকার নিশ্চিতের বিষয়গুলোতে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনবে। ২০২৩ সালে শ্রমিকরা নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সেগুলোর দ্রুত তদন্ত করে সুরাহা করতে হবে। রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকায় (ইপিজেড) সব শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করতে সংগঠনের বিষয়টিকে বিবেচনায় নিতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি সারাহ মরগ্যান বলেন, আইএলওর ৮১, ৮৭ ও ৯৮ নম্বর সনদ বাস্তবায়নের পাশাপাশি বাংলাদেশ শ্রম আইন ও ইপিজেড আইনে প্রয়োজনীয় সংস্কার দ্রুত করতে হবে। ট্রেড ইউনিয়ন-বিরোধী তৎপরতার বিরুদ্ধে সরকার যেসব ব্যবস্থা নিয়েছে, সেগুলোকে সাধুবাদ জানাই। দুই বছর পেরিয়ে গেলেও শ্রমিক নেতা শহীদুল হত্যার বিচার না হওয়ার পাশাপাশি জগদীশ বাবুসহ আরও বেশ কয়েকজন শ্রমিক নেতার নির্যাতনের শিকার হওয়ার বিষয়গুলো অত্যন্ত উদ্বেগের। আমরা শ্রমিকদের বিরুদ্ধে আনা ভিত্তিহীন অভিযোগগুলো প্রত্যাহারের আহ্বান জানাই।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.