ফেসবুক লাইভের বদৌলতে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি আমরা। রাতারাতি তারকা বনে যাওয়ার ঘটনা যেমন ঘটছে, তেমনি রাতারাতি তারার খসে পড়ার ঘটনাও ঘটছে। কিন্তু এই ফেসবুক লাইভ আমাদের কী শেখায়?
একদা ‘পাওয়ার ইউজার’ বা প্রভাবশালী ব্যবহারকারীদের জন্য যে ফিচার তৈরি হয়েছিল, প্রায় এক দশকের ব্যবধানে সেই ফিচারটি ছাড়া এখন ফেসবুকের অস্তিত্ব কল্পনা করাও সাধারণ ব্যবহারকারীদের জন্য দুষ্কর। ফেসবুকভিত্তিক সম্প্রচার প্ল্যাটফর্মগুলো ‘লিগ্যাসি মিডিয়া’ বা ঐতিহ্যবাহী প্রচারমাধ্যমগুলোর নাভিশ্বাসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের গতি ও বিস্তারের সঙ্গে গণমাধ্যমগুলো পেরে উঠছে না। একই সঙ্গে তারা ক্রমাগত বদলে দিচ্ছে সম্প্রচারজগতের নিয়মনীতি।
আপনি যদি ফেসবুক ব্যবহারকারী হন, তাহলে ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে আপনি নিজেই এখন জনপরিসরে সরাসরি সম্প্রচারের সুযোগ পাচ্ছেন। আপনার ওপর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কানুন বা পেশাদারি নীতিমালা খাটছে না। সহজ কথায়, ব্যক্তি হিসেবে আপনি আপনার মতামত সরাসরি প্রকাশ করতে পরছেন। এই ফেসবুক লাইভের কিছু সুবিধা যেমন আছে, তেমনি রয়েছে কিছু বিপত্তিও। যেমন এই লাইভ–পরম্পরায় দেশে বিদ্যমান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মারপ্যাঁচে জড়িয়ে আপনি ‘ফাঁপরে’ও পড়তে পারেন। সেই অলোচনা অবশ্য এ লেখার বিষয় নয়।
‘কমেন্ট অপশন’ ব্যবহার করে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের নিয়ে বিচার বসান ফেসবুকের ‘মুরব্বি’রা। এই ‘মুরব্বি’ হলো ফেসবুকের আমজনতা—অর্থাৎ আমরা। পরের দৃশ্যে ‘কমেন্ট অপশন’ বা মন্তব্যের ঘরে শুরু হয় যুদ্ধ। এই যুদ্ধে যিনি জিতবেন, তিনিই সুচরিত্রের সনদ নিয়ে সমাজ তথা বিনোদন অঙ্গনে নিজের অস্তিত্ব বহাল রাখতে পারবেন।
ফেসবুক লাইভ অধুনা দারুণ আলোচিত বিষয় বটে। কারণ, এই লাইভের বদৌলতে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি আমরা। রাতারাতি তারকা বনে যাওয়ার ঘটনা যেমন ঘটছে, তেমনি রাতারাতি তারার খসে পড়ার ঘটনাও ঘটছে। দ্রুত আর সহজলভ্য খ্যাতির লোভে তারকারা ব্যক্তিপরিসরের নানা বিষয়–আশয় জনপরিসরে নিয়ে আসছেন মূলত এই লাইভের মাধ্যমেই।
কিন্তু বিষয়টা এত সরলও নয়। একটি প্রিজমকে আলোয় মেলে ধরলে যেমন নানা দিক থেকে আলো বিচ্ছুরিত হয়, একইভাবে মেটা–দুনিয়ার প্রিজমের ভেতর দিয়ে সত্য পাচ্ছে নানা মাত্রা।
কথা হলো, সত্য আসলে কী? সত্য কি পরম? এর কি একটাই রূপ? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমনির্ভর মেটা–দুনিয়ায় একটা ঘটনার নানা বয়ান আমরা পাই, বিভিন্নভাবে ওই ঘটনাকে দেখার সুযোগও ঘটে। আবার প্রত্যেকে নিজ নিজ বয়ান দেওয়ার সুযোগও পান। আর ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে তা এখন আরও অনেক সহজ ও সরাসরি। যে কারণে সুযোগটি ব্যবহার করে জনপরিসরে নিজেদের দাম্পত্য সংকটের কথা তুলে ধরেন এ সময়ের আলোচিত দুই ঢালিউড নায়িকা। তাঁদের দুজনেরই জীবনসঙ্গী হলেন চলচ্চিত্র নায়ক। তাঁরা দুজনই কাজ করতে গিয়ে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছেন। এরপর গোপন বিয়ে প্রকাশ্যে এসেছে এবং এখন তাঁরা সন্তানের মা। দুজনই জীবনসঙ্গীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার এবং ‘ব্লেম গেম’ অর্থাৎ পাল্টাপাল্টি অভিযোগের কথা তুলেছেন; তা থেকে অব্যাহতিও চেয়েছেন লাইভে।
দুই নায়িকা লাইভে যা বলেছেন, সেখানে প্রকট হয়ে উঠেছে আরও একটি বিষয়—সমাজে এখনো নারী কতটা অরক্ষিত। তা তিনি যত বড় নায়িকাই হোন না কেন। লাইভে দুই নায়িকাই বলেছেন, তাঁরা কীভাবে সঙ্গীর নানা বিচ্যুতিতে সমর্থন দিয়ে গেছেন। আর সামাজিক স্বীকৃতি, সম্মান ও বিশ্বস্ততা দাবির পরই কীভাবে সঙ্গীরা তাঁদের থেকে দূরে সরে গেছেন। এ সময় দুই নায়িকাই জোরগলায় বলেন, সংসার টিকিয়ে রাখতে যা যা করা প্রয়োজন, যেভাবে করা প্রয়োজন, তাঁরা করেছেন। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কথা উঠে এসেছে, তা হলো, সন্তান প্রতিপালনে সঙ্গীর কোনো অংশীদারত্ব তাঁরা পাননি। একা হাতে তাঁরা সন্তান মানুষ করছেন।
বাংলাদেশি সমাজব্যবস্থায় সন্তান প্রতিপালনকে এককভাবে নারীর দায়িত্ব বলে ধরে নেওয়া হয়। বাবা হিসেবে পুরুষের দায়িত্ব অর্থনৈতিক সমর্থন দেওয়া। কিন্তু এখন নারীও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী। তবুও ক্রমাগত বিভাজনের প্রক্রিয়ায় থাকা সমাজব্যবস্থায় সন্তান পালনে নারীরা তেমন কোনো মানুষ পায় না—এটাই আমাদের নাগরিক বাস্তবতা। তাই শিশুকে বড় করে তোলার খুঁটিনাটি নানা দায়িত্ব পালন মায়ের একার পক্ষে গুরুভারই বটে।
ফেসবুক লাইভের বদৌলতে আমরা নায়িকাদের জীবনের এই আটপৌরে বয়ানের মুখোমুখি হই। বলা দরকার, মেটা–দুনিয়ার ‘মুরুব্বি’ অর্থাৎ জনগণের সামনে তাঁরা নিজেদের জীবনের এই কঠিন সত্য অকপট তুলে ধরেন। এরপর কী ঘটে?
‘কমেন্ট অপশন’ ব্যবহার করে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের নিয়ে বিচার বসান ফেসবুকের ‘মুরব্বি’রা। এই ‘মুরব্বি’ হলো ফেসবুকের আমজনতা—অর্থাৎ আমরা। পরের দৃশ্যে ‘কমেন্ট অপশন’ বা মন্তব্যের ঘরে শুরু হয় যুদ্ধ। এই যুদ্ধে যিনি জিতবেন, তিনিই সুচরিত্রের সনদ নিয়ে সমাজ তথা বিনোদন অঙ্গনে নিজের অস্তিত্ব বহাল রাখতে পারবেন। তবে এতে তাঁদের ব্যক্তিজীবনে কী প্রভাব পড়বে, তা কিন্তু আমরা সেভাবে ভাবি না। এটা বরং আমাদের অজানাই থেকে যায়। আর মেটা–দুনিয়ার এই প্রিজমের ভেতর দিয়ে বাস্তবের শতধা বিভক্তি অব্যাহত থাকে। আর ফেসবুক লাইভের প্রেক্ষিতে যেসব বয়ান প্রতিদিন আমাদের সামনে আসে, সেগুলোর পক্ষে–বিপক্ষে অবস্থান নিতে নিতে চেতনে–অবচেতনে অদতে আমরা আরও বেশি বিভক্ত হতে থাকি—বিষয়টি কি আমরা ভেবে দেখেছি কখনো?
নাজিয়া আফরিন