আমাকে পেন পিন্টার পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করার জন্য ধন্যবাদ জানাই ইংলিশ পেনের সদস্য এবং জুরিদের।
আমি এই বছরের সাহসী লেখকের নাম ঘোষণা করে আমার কথা শুরু করতে চাই। তার সঙ্গে এই পুরস্কার ভাগ করে নিতে চাই। তোমাকে শুভেচ্ছা, সাহসী লেখক আলা আবদ আল-ফাত্তাহ। আমরা আশা করেছিলাম, প্রার্থনা করেছিলাম, যেন তুমি এই সেপ্টেম্বরে মুক্তি পাও; কিন্তু তুমি এত সুন্দর একজন লেখক আর এত বিপজ্জনক একজন চিন্তাবিদ যে মিসর সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তোমাকে এখনই মুক্তি দেওয়া যাবে না। কিন্তু তুমি এখানে আমাদের সঙ্গে এই ঘরেই আছ। তুমিই এখানে উপস্থিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। কারাগার থেকে তুমি লিখেছ, ‘আমার শব্দগুলো শক্তি হারিয়েছে। তবু আমি কথা বলে যাই। আমার এখনো একটি কণ্ঠস্বর আছে, না হয় কয়েকজন মাত্রই শুনল।’ আমরা শুনছি, আলা। আমরা তোমার কথা নিবিড়ভাবে শুনছি।
আমি ভারতের কারাগারে বন্দী আমার বন্ধু ও কমরেডদের কথা বলছি। তাঁদের কেউ আইনজীবী, কেউ শিক্ষাবিদ, শিক্ষার্থী বা সাংবাদিক। উমর খালিদ, গুলফিশা ফাতিমা, খালিদ সাইফি, শারজিল ইমাম, রোনা উইলসন, সুরেন্দ্র গ্যাডলিং, মহেশ রাউত। আমি তোমাকে বলছি, বন্ধু খুররম পারভেজ। আমার চেনা অসাধারণতম মানুষ। তিন বছর ধরে জেলে আছ তুমি। হ্যাঁ, তোমাকেও বলছি ইরফান মেহরাজ। বলছি, কাশ্মীর আর সারা দেশে বন্দী হাজার হাজার মানুষকে, যাঁদের জীবন এলোমেলো হয়ে গেছে।
আর আজ, আরও এক গণহত্যার মধ্যে এক বছরের বেশি সময় পার হয়ে যাচ্ছে আমদের। ঔপনিবেশিক দখলদারি আর বর্ণবিদ্বেষী রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখার জন্য গাজা আর এখন লেবাননে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের নিরন্তর এক গণহত্যা চলছে। সেই গণহত্যা এখন টেলিভিশনে দেখানোর অনুষ্ঠান হয়ে গেছে।
ইসরায়েল যা করছে কেউ কীভাবে তাকে ন্যায্য বলতে পারে?
ইসরায়েল ও তার মিত্রদের পাশাপাশি পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের কাছে এর একটি উত্তর আছে। আর তা হলো—গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলা। ইসরায়েলি নাগরিকদের হত্যা এবং কিছু ইসরায়েলিকে জিম্মি করা। তাদের মতে, এই ইতিহাস মাত্র এক বছর আগে শুরু হয়েছে।
বক্তৃতার এই অংশে নিশ্চয়ই সবাই আশা করছেন যে আমি নিজেকে, আমার ‘নিরপেক্ষতা’কে আর বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থানকে রক্ষা করার জন্য বাকচাতুরি শুরু করব। ঠিক এখানেই আমার নৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করে হামাস আর তাদের মিত্র হিজবুল্লাহর নিন্দা করার কথা। কারণ, তারা বেসামরিক লোক হত্যা করেছে। জিম্মি করেছে মানুষকে। আমার তো গাজার জনগণেরও নিন্দা করার কথা। তারা হামাসের হামলা উদ্যাপন করেছে। এসব ছক বাঁধা কাজ করলেই তো সবকিছু সহজ হয়ে যায়, তাই না?
যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে, তা হবে ভয়াবহ। তবে তা শেষ পর্যন্ত ইসরায়েলি বর্ণবাদকে চূর্ণ করে ফেলবে। তখন এই পৃথিবী হবে সবার জন্য অনেক বেশি নিরাপদ। …ইহুদি জনগণও সেই ন্যায্যতায় নিশ্বাস নেবেন।
আমি দোষারোপের খেলা খেলতে রাজি নই। আমার কথাটা পরিষ্কার করি। কীভাবে নিপীড়নকে প্রতিহত করতে হবে বা কে তাদের সহযোগী হওয়া উচিত—এ বিষয়ে নির্যাতিত মানুষকে আমি পরামর্শ দেওয়ার স্পর্ধা করি না।
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নিজেকে অ–ইহুদি ইহুদিবাদী বলে ঘোষণা দিয়ে ইসরায়েলকে যুদ্ধাপরাধে নিরঙ্কুশভাবে সহায়তা করেন। অস্ত্র জোগান দেন। তবে আমার লেখাই আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়। অন্য কোনোভাবে আমি নিজের পরিচয় দিতে রাজি নই। আমি যা লিখি, আমি তা–ই।
আমি খুব ভালো করে জানি যে আমি লেখক, অমুসলিম এবং নারী হওয়ার কারণে হামাস, হিজবুল্লাহ বা ইরানি শাসনে আমার দীর্ঘকাল টিকে থাকা খুব কঠিন হবে। বরং বলা ভালো, অসম্ভবই হবে। তবে এখানে কথা এটা নয়। মূল বিষয় হলো ইতিহাস আর যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তারা জন্মলাভ করেছে, সে সম্পর্কে জানা। এই মুহূর্তে তারা চলমান এক গণহত্যার বিরুদ্ধে লড়াই করছে। নিজেদের প্রশ্ন করা উচিত—পৃথিবীর সব শক্তি যখন তাদের বিরুদ্ধে, তখন আল্লাহ ছাড়া আর কার দিকে মুখ ফেরাবে তারা?
আমি জানি যে তাদের নিজ দেশে হিজবুল্লাহ এবং ইরানের শাসকদের সোচ্চার বিরোধিতা রয়েছে। এই বিরোধীদের অনেকে কারাগারে বন্দী। কেউবা এর চেয়েও খারাপ পরিণতি ভোগ করছেন। আমি জানি যে বেসামরিক মানুষকে হত্যা এবং নাগরিকদের জিম্মি করা যুদ্ধাপরাধের মধ্যে পড়ে। তবে গাজা, পশ্চিম তীর এবং এখন লেবাননে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র যা করছে, তার সঙ্গে এর তুলনা চলে না। ৭ অক্টোবরের সহিংসতাসহ সব সহিংসতার মূলে রয়েছে ইসরায়েলের ফিলিস্তিনি ভূমি দখল এবং ফিলিস্তিনি জনগণকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা। এই ইতিহাস ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর শুরু হয়নি।
গাজা এবং পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিরা দশকের পর দশক ধরে অপমানের শিকার হচ্ছেন। আমি আপনাদের একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। এই হলঘরে আপনারা যাঁরা বসে আছেন, তাঁদের মধ্যে কে স্বেচ্ছায় এমন অপমান মুখ বুজে সহ্য করবেন? এমন কোন শান্তিপূর্ণ উপায় আছে, ফিলিস্তিনি জনগণ যা চেষ্টা করেনি? আর কোন আপস গ্রহণ করেনি তাঁরা?
ইসরায়েল আত্মরক্ষার জন্য যুদ্ধ করছে না। তাদের যুদ্ধ আগ্রাসনের। এই যুদ্ধ আরও বেশি অঞ্চল দখল করে বর্ণবাদকে শক্তিশালী করার যুদ্ধ। এর লক্ষ৵ ফিলিস্তিনি জনগণ আর সেই অঞ্চলের ওপর ইসরায়েলিদের নিয়ন্ত্রণ আরও শক্ত করা।
সব শক্তি, সব অর্থ, পৃথিবীর সব অস্ত্র আর প্রচারণা ফিলিস্তিন নামের ক্ষতকে আর আড়াল করতে পারবে না। এই ক্ষত দিয়ে ইসরাইলসহ সারা বিশ্বের রক্ত ঝরছে।
যখন নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনকে মুছে ফেলে মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র তুলে ধরেন, তখন তিনি স্বপ্নদর্শী। সবাই তার খুব প্রশংসা করেন। তিনি ইহুদিদের স্বদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করছেন।
কিন্তু যখন ফিলিস্তিনিরা ‘নদী থেকে সমুদ্র, ফিলিস্তিন হবে মুক্ত’ বলে স্লোগান দেয়, তখন তাদের ধিক্কার দেওয়া হয়। তারা নাকি খোলাখুলি ইহুদি গণহত্যার আহ্বান জানাচ্ছেন!
যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে, তা হবে ভয়াবহ। তবে তা শেষ পর্যন্ত ইসরায়েলি বর্ণবাদকে চূর্ণ করে ফেলবে। তখন এই পৃথিবী হবে সবার জন্য অনেক বেশি নিরাপদ। অনেক বেশি ন্যায্য। ইহুদি জনগণও সেই ন্যায্যতায় নিশ্বাস নেবেন। আর তা হবে আমাদের আহত হৃদয় থেকে বিদ্ধ তির টেনে বের করে নেওয়ার মতো।
মার্কিন সরকার ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করলে যুদ্ধ আজই বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এই মুহূর্তে সব শত্রুতাও শেষ হতে পারে। …
গাজা এবং এখন লেবাননের যে ভয়াবহতা দ্রুত এক আঞ্চলিক যুদ্ধে পরিণত হচ্ছে। এই যুদ্ধের আসল নায়কেরা ছবির বাইরেই থেকে যাচ্ছেন; কিন্তু তাঁরা লড়াই করে যাবেন। কারণ, তাঁরা জানেন যে একদিন-
নদী থেকে সমুদ্র
ফিলিস্তিন হবে মুক্ত
আর তা হবেই।
আপনার ঘড়ি থেকে চোখ সরিয়ে নিন। ক্যালেন্ডারে চোখ রাখুন।
জেনারেলদের কথা আলাদা। যে জনগণ মুক্তির জন্য লড়াই করে, তারা ক্যালেন্ডার দিয়েই সময় মাপে।
- অরুন্ধতী রায় বুকার পুরস্কার পাওয়া ভারতীয় লেখক ও অধিকারকর্মী
দ্য ওয়্যার থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে নির্বাচিত অংশের অনুবাদ জাভেদ হুসেন