চালকের আমৃত্যু কারাদণ্ড হলেও যে প্রশ্নের উত্তর পাননি মা

0
150
বাড়ির উঠানে ষাটোর্ধ্ব মৃণালিনী শীল। কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারা ইউনিয়নের মালুমঘাটের হাসিনাপাড়ায়

কক্সবাজারের চকরিয়ায় পিকআপচাপায় ছয় ভাই হত্যাকাণ্ডের রায়ে সন্তুষ্ট হতে পারেননি তাঁদের মা মৃণালিনী সুশীল। তিনি বলেন, ‘রায়ে আমার চাওয়া পূরণ হয়নি। এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে আমি যে প্রশ্নের উত্তর চেয়েছিলাম, সেটি পাইনি। এ জন্য আমি আপিল করব।’

গত রোববার দুপুরে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল চকরিয়ায় পিকআপচাপায় ছয় ভাইয়ের মৃত্যুর ঘটনায় রায় ঘোষণা করেন। রায়ে পিকআপচালক সাহিদুল ইসলাম ওরফে সাইফুলকে (২২) আমৃত্যু সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। সঙ্গে এক লাখ টাকা জরিমানাও করেছেন। রায়ে আদালত বলেছেন, এটি সড়ক দুর্ঘটনা নয়, পরিষ্কার হত্যাকাণ্ড।

রায়ের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে মুঠোফোনে গতকাল সোমবার মৃণালিনী সুশীল বলেন, ‘আদালতই বলেছেন, এটি পরিষ্কার হত্যাকাণ্ড। তাহলে আমার জানার বিষয়, কেন এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে? চালকের সঙ্গে আমাদের তো কোনো বিরোধ নেই। তিনি কার কথায় আমার ছয় ছেলেকে একসঙ্গে হত্যা করেছেন, সেই প্রশ্নের উত্তর চাই।’

দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো ছয় ভাই এখন ছবি
দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো ছয় ভাই এখন ছবিফাইল

মৃণালিনী সুশীল কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ‘আমি একসঙ্গে ছয় সন্তানকে হারিয়েছি, আমিই বুঝি ব্যথা কী। আমি মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে কতবার গেলাম, আদালতে সাক্ষীতে বললাম, কেউ আমার কথা শোনেননি। আমার ছেলেদের এমনে এমনে পিকআপচাপা দিয়ে হত্যা করেনি। আমি নিশ্চিত, চালক কারও নির্দেশে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। আমি ঘটনার পেছনের খুনিদের চেহারা দেখতে চাই।’

গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি ভোরে চকরিয়ার ডুলাহাজারা ইউনিয়নের মালুমঘাটের হাসিনাপাড়া এলাকায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে পিকআপের চাপায় নিহত হন সুরেশ চন্দ্র সুশীলের ছয় ছেলে অনুপম সুশীল (৪৬), নিরুপম সুশীল (৪০), দীপক সুশীল (৩৫), রক্তিম সুশীল (৩২), চম্পক সুশীল (৩০) ও স্মরণ সুশীল (২৯)। এ ঘটনার আগে ৩০ জানুয়ারি তাঁদের বাবা সুরেশ চন্দ্র সুশীল মারা যান। ৮ ফেব্রুয়ারি ভোরে মালুমঘাটের একটি মন্দিরে বাবার শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান শেষ করে ফেরার পথে তাঁরা এ ঘটনার শিকার হন।

পুলিশ জানায়, ছয় ভাইয়ের মৃত্যুর ঘটনায় তাঁদের ভাই প্লাবন সুশীল বাদী হয়ে চকরিয়া থানায় হত্যা মামলা করেন। ঘটনার তিন দিন পর ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন চালক সাহিদুল ইসলাম। পরে পিকআপমালিক মাহমুদুল করিম গ্রেপ্তার হলেও তিনি এখন জামিনে আছেন। আর তাঁর ছেলে মো. তারেক পলাতক।

আদালত সূত্র জানায়, তদন্তের পর গত বছরের ৯ নভেম্বর তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক এনামুল হক চৌধুরী তিনজনের বিরুদ্ধে হত্যা ও সড়ক পরিবহন আইনে পৃথক অভিযোগপত্র দাখিল করেন। চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি চকরিয়ার জ্যেষ্ঠ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত শুনানি শেষে অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, পিকআপের মালিক মাহমুদুল করিম অনভিজ্ঞ ও লাইসেন্সবিহীন একজন চালকের হাতে গাড়িটি চালানোর জন্য তুলে দিয়েছেন, যা সড়ক পরিবহন আইনের পরিপন্থী। এ ছাড়া দুর্ঘটনার খবর শুনেও তিনি (মাহমুদুল) আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার উদ্যোগ নেননি। এ জন্য মাহমুদুলকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। ঘটনার সময় মাহমুদুলের ছেলে মো. তারেক পিকআপে চালকের পাশে বসা ছিলেন। আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার না করে উল্টো তিনি চালককে দ্রুত পালিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দেন। এ জন্য তাঁকেও আসামি করা হয়েছে। চালক সাহিদুল ইচ্ছাকৃতভাবে জেনে–বুঝে গাড়িটি পেছনের দিকে চালান এবং ঠান্ডা মাথায় তিনি এটা সম্পন্ন করেন। তাঁর উচিত ছিল, প্রথমবার চাপা দেওয়ার পর আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া বা পুলিশকে খবর দেওয়া। কিন্তু তা না করে তিনি আহত ব্যক্তিদের দ্বিতীয়বার চাপা দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে পালিয়েছেন।

মামলার অন্য দুই আসামি পিকআপের মালিক মাহমুদুল করিম ও তাঁর ছেলে মো. তারেকের বিরুদ্ধে সড়ক পরিবহন আইনে বিচার হবে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.