প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি ২৯ বিশিষ্ট নাগরিকের

0
220
প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

বিশিষ্ট নাগরিকদের দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, এটি সর্বজন বিদিত যে ২০১৩ সালে ২৬ হাজার ১৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ এবং সাম্প্রতিক সময়ে গৃহীত শিক্ষাক্রম সংস্কারসহ বর্তমান সরকার কিছু শিক্ষাবান্ধব কৌশল ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে বেশ কিছু দৃশ্যমান সাফল্য এনে দিয়েছে। এই অর্জনগুলো এখন সারা বিশ্বেও স্বীকৃত। একসময় প্রচলিত ব্যবস্থায় মেধাবৃত্তি প্রদানের উপায় হিসেবে বাছাই করা শিক্ষার্থীদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হতো ‘প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা’। ২০০৯ সালে সেটি বাদ দিয়ে শুরু হয় ‘প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি)’ পরীক্ষা। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি ও নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখা বিবেচনায় নিয়ে তিন বছর ধরে পিইসি পরীক্ষা হচ্ছে না। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে চালু হচ্ছে নতুন শিক্ষাক্রম, যে শিক্ষাক্রমে প্রাথমিক পর্যায়ে পাবলিক পরীক্ষাকে কম গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ধারাবাহিক মূল্যায়নের ওপর অধিকতর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য শ্রেণিতেও নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনা রয়েছে। এ অবস্থায় বছরের একেবারে শেষ সময় আকস্মিকভাবেই পুরোনো ব্যবস্থার মতো ‘প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা’ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যার যৌক্তিকতা ও নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে তাঁরা উদ্বিগ্ন।

বিবৃতিতে বিশিষ্ট নাগরিকেরা আরও বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখা অনুযায়ী শিক্ষায় পরিবর্তনের যে ইতিবাচক ধারা তৈরি হচ্ছে, সেখানে এভাবে হুট করে বৃত্তি পরীক্ষা চালু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হলে শিক্ষার্থীদের ওপর নানামুখী মানসিক ও শারীরিক চাপ পড়বে। এ ছাড়া নতুন শিক্ষাক্রমে যেখানে সব শিক্ষার্থীর মেধার সম্পূর্ণ বিকাশের নানা দিককে উৎসাহিত করা হচ্ছে, সেখানে মাত্র ২০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে বাছাই করে একটি বৃত্তি কার্যক্রম শুরু করলে সুবিধাভোগী ও সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এটি সংবিধানের মূলনীতির পরিপন্থী।

বিশিষ্ট নাগরিকেরা বলেন, দ্রুত পরিবর্তনশীল পৃথিবীর সঙ্গে খাপ-খাওয়ানোর লক্ষ্যে বর্তমানে প্রচলিত সনাতন শিখনকালীন মূল্যায়ন পদ্ধতি এবং পরীক্ষানির্ভর, সনদসর্বস্ব শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিভিন্ন সময় দেওয়া বক্তব্য অনুপ্রাণিত করেছে। কিন্তু শুধু ২০ শতাংশ শিক্ষার্থীর জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে একটি বৃত্তি পরীক্ষা চালুর ঘোষণা হতাশ করেছে। শিক্ষা নিয়ে প্রায়ই এত পরীক্ষা-নিরীক্ষা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বিভ্রান্ত করে থাকে, যা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এবং আন্তমন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে প্রতিবছর ‘সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ’ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যেভাবে বিভিন্ন স্তরের ও নানা ধরনের আর্থসামাজিক অবস্থানে থাকা, এমনকি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদেরও বাছাই করা হয়ে থাকে, তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। সব শিক্ষার্থীর মেধা যাচাইয়ের এ রকম একটি সুন্দর ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও কেন শুধু ২০ শতাংশ শিক্ষার্থীর জন্য হঠাৎ ‘বৃত্তি পরীক্ষা’ চালু করা হচ্ছে, তা বোধগম্য নয়। তদুপরি এই পরীক্ষা চালুর মাধ্যমে কোচিং বাণিজ্য ও গাইড বইয়ের দৌরাত্ম্য বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা ইতিপূর্বে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা নিয়ে পরিচালিত বিভিন্ন গবেষণায় সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এ কারণে অভিভাবকদের বাড়তি খরচেরও সম্মুখীন হতে হবে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে।

বিশিষ্ট নাগরিকে বলেন, ‘আমরা আশা করছি, নীতিনির্ধারকেরা আকস্মিকভাবে ঘোষিত এবং জাতীয়ভাবে পরিচালিত “প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা”র মতো পাবলিক পরীক্ষার (High Stake Exam) পরিবর্তে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর দিকনির্দেশনার আলোকে সব শিক্ষার্থীর জন্য উপজেলাভিত্তিক বাছাইয়ের মাধ্যমে মেধাবৃত্তি প্রদানের বিষয়টিকে বিবেচনা করবেন। এর মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থাপনা বিকেন্দ্রীকরণের পথে এগিয়ে যাবে বলে আমরা মনে করি। যা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নসহ ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত বাংলাদেশের প্রত্যাশা পূরণ এবং এসডিজি-৪–এর লক্ষ্য “সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং জীবনব্যাপী শিক্ষা”র অধিকার প্রতিষ্ঠায় নতুন মাত্রা যুক্ত করবে। বেগবান হবে জাতীয় সম্মিলিত প্রয়াস—এটাই আমাদের প্রত্যাশা।’

বিবৃতি দাতা বিশিষ্ট নাগরিকেরা হলেন—অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, রামেন্দু মজুমদার, সুলতানা কামাল, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, অধ্যাপক এম এম আকাশ, রাশেদা কে চৌধূরী, অধ্যাপক মনজুর আহমেদ, ইলিয়াস কাঞ্চন, অধ্যাপক মাহফুজা খানম, অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, কাজী ফারুক আহমেদ, আসিফ সালেহ, ফেরদৌসী মজুমদার, মামুনুর রশীদ, নজরুল ইসলাম খান, কাজী রফিকুল আলম, এজাজুল ইসলাম, মনসুর আহমেদ চৌধুরী, শাহীন আনাম, মোস্তাক রাজা চৌধুরী, এম. সাখাওয়াত হোসেন, সঞ্জিব দ্রং, করভি রাকসন্দ, মালেকা বেগম, খালেদ মাসুদ পাইলট, অধ্যাপক শফি আহমেদ ও অধ্যাপক এম তারিক আহসান।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.