সাড়ে পাঁচ বিঘা জমিতে ‘ক্যালেঙ্গা’ জাতের আনারসের প্রায় ২৫ হাজার চারা লাগিয়েছেন। গাছের বয়স ১৮ মাস।
দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলা ঢাকা মোড় থেকে পিচঢালা একটি সড়ক চলে গেছে নবাবগঞ্জ উপজেলার দিকে। দেড় কিলোমিটার যেতেই তেঁতুলিয়া গ্রামে চোখে পড়ল সড়কের পাশেই একটি বেঞ্চে সারি সারি তাক করা আনারস। পাশে একজন দাঁড়িয়ে আছেন। সবুজ রঙের আনারসগুলোর ওজন অনুমান সাড়ে তিন থেকে চার কেজি। পথচারীদের কেউ কেউ দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন। দরদাম করে দু-একটি কিনছেন। সুতলিতে বেঁধে ক্রেতার হাতে তুলে দিচ্ছেন বিক্রেতা।
কোথাকার আনারস জানতে চাইলে বিক্রেতা বলে উঠলেন, এখানকারই। হাত উঁচিয়ে সামনে দেখিয়ে বললেন, ওই তো বাগান। এগিয়ে দেখা গেল আনারসের বড় বাগান। লম্বা ধারালো পাতার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে আনারসগুলো। কোনোটার রং গাঢ় সবুজ। কোনোটা লাল-খয়েরি রং ধারণ করেছে মাত্র।
সাড়ে পাঁচ বিঘা জমিতে আনারসের চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে এক বিঘা ফাঁকা জমি। অবশিষ্ট সাড়ে চার বিঘা আনারস লাগানো হয়েছে আমবাগানের ভেতরে ফাঁকা জায়গাগুলোতে। বাগানের মালিক ফুলবাড়ী পৌর শহরের তেঁতুলিয়া গ্রামের নূরুন্নবী আশিকির (৪৫)। বাগানের ঠিক মাঝবরাবর টংঘর। সেখানেই পাওয়া গেল নূরুন্নবীকে।
নূরুন্নবী বলেন, পেশায় তিনি একজন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট। কর্মরত আছেন দিনাজপুর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে। প্রথমবারের মতো আনারসের এ বাগান করেছেন। সাড়ে পাঁচ বিঘা জমিতে ‘ক্যালেঙ্গা’ জাতের আনারসের চারা লাগিয়েছেন প্রায় ২৫ হাজার। গাছের বয়স ১৮ মাস। এরই মধ্যে প্রায় সব গাছে ফল এসেছে। বিক্রিও শুরু করেছেন।
নূরুন্নবী বলেন, পাইকারেরা আসছেন। প্রতিটি আনারসের দাম তাঁরা দিতে চাচ্ছেন ৩৮-৪০ টাকা। তবে এ দামে বিক্রি করছেন না। বাগানের এক কর্মীকে দিয়ে খুচরায় বিক্রি করছেন প্রতি জোড়া ১০০-১২০ টাকা দামে। জুলাই মাস পর্যন্ত তাঁর খরচ হয়েছে সাড়ে চার লাখ টাকা। প্রতিটি আনারস যদি ৪০ টাকাও বিক্রি করেন, তাহলে প্রায় ১০ লাখ টাকার আনারস বিক্রি করতে পারবেন তিনি।
উত্তরাঞ্চলে তো এই ফল চাষের কথা শোনা যায় না তেমন। নূরুন্নবী কী মনে করে এ ফলের চাষ শুরু করলেন? জবাবে তিনি বলেন, ২০২০ সালে তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন। সেখানে তাঁর এক সহকর্মী ছিলেন, তাঁর বাড়ি মধুপুর। সহকর্মীর অনুরোধে একবার তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে গিয়ে দেখলেন, মধুপুর অঞ্চলের মাটি বেলে দো-আঁশ প্রকৃতির। তাঁর নিজ এলাকা (ফুলবাড়ীর) মাটিও প্রায় একই রকম। তা ছাড়া বাবার কাছে ছোটবেলায় শুনেছিলেন, বাড়ির আশপাশে প্রচুর জঙ্গল ছিল। জঙ্গলে আনারস পাওয়া যেত। এরপর আনারস চাষের পরিকল্পনা করেন ফুলবাড়ীতেই।
২০২১ সালের নভেম্বর মাসে ২৫ হাজার চারা ট্রাকে করে নিয়ে আসেন। একটি আনারসগাছে তিন-চারটি ‘ক্রাউন’ (চারা) পাওয়া যাবে। হিসাব অনুযায়ী এখন ৬৫-৭০ হাজার চারা রয়েছে তাঁর বাগানে। প্রতিটির দাম রেখেছেন ১০ টাকা করে। তিনি নতুন করে আরও তিন বিঘা জমিতে আনারস লাগাবেন তিনি। সাধারণত অক্টোবর-ডিসেম্বর পর্যন্ত চারা লাগানোর সময়।
নূরুন্নবী বলেন, আনারসের বাগান করার সময় এলাকার অনেকেই হাসাহাসি করে বলেছেন, টাকাপয়সা নষ্ট হবে। কিন্তু কারও কথায় কান দেননি। শুধু কাজটা করে গেছেন। এখন প্রতিনিয়ত তাঁর বাগান দেখতে আসছেন অনেকেই। চারা নেওয়ার জন্য অগ্রিম টাকাও দিতে চাইছেন কেউ কেউ।
রাকিবুল ওয়ারিদ নামের এক ব্যক্তি বলেন, কয়েক দিন থেকে আনারসের বাগানের কথা শুনেছেন। মূলত আলু-ভুট্টা-রবিশস্য চাষ করেন। আনারসের চারার কথা বলে রাখলেন। এবার তিনিও আনারসের বাগান করবেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক নুরুজ্জামান বলেন, উপজেলা কর্মকর্তা সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন। এ অঞ্চলের মাটি আনারস চাষের উপযোগী। আর আনারস একটি লাভজনক ফসলও বটে। যদি নূরুন্নবী চারা সরবরাহ করতে পারেন, আগ্রহী কৃষকদের মধ্যে তাহলে অনেক কৃষকই লাভবান হবেন। কৃষি বিভাগ থেকে নূরুন্নবীকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।