দেশের ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি মোকাম চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে বাড়ছে পেঁয়াজের ‘ঝাঁজ’। কয়েক দিনের ব্যবধানে কেজিতে দাম বেড়েছে প্রায় ২০ টাকা। কম সময়ে পাইকারিতে দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে খুচরা বাজারে পেঁয়াজের দাম ঠেকেছে ৬০ টাকায়। অথচ কিছুদিন আগেও খুচরায় প্রতি কেজি পেঁয়াজ কেনা যেত ৩৫ থেকে ৪০ টাকায়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে দাম আরও বাড়ার কথা বলছেন ব্যবসায়ীরা। তাই অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের আকাশচুম্বী দামের সঙ্গে ক্রেতাদের নতুন করে ভোগাচ্ছে পেঁয়াজ। এমন ঊর্ধ্বমুখী দাম নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে তা আসছে কোরবানির ঈদে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে শঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। টিসিবির তথ্যই বলছে, গত বছরের এই সময়ের চেয়ে বর্তমানে পেঁয়াজের দাম প্রায় ৭২ শতাংশ বেশি।
কৃষকদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে সরকার গত ১৫ মার্চ ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতিপত্র বন্ধ করে দেয়। ফলে এখন চাহিদার পুরোটা মেটানো হচ্ছে দেশি পেঁয়াজে। খাতুনগঞ্জের কোনো আড়তে নেই আমদানি করা পেঁয়াজ। দেশি পেঁয়াজের সরবরাহ মোটামুটি স্বাভাবিক থাকলেও দাম বাড়ছে প্রতিনিয়ত।
খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খাতুনগঞ্জের পেঁয়াজের বাজার পুরোপুরি নির্ভর ভারতীয় পেঁয়াজের ওপর। তবে সরকার ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ করে দেওয়ায় বাজারে সংকট তৈরি হয়েছে। যে কারণে দেশি পেঁয়াজের ওপর বাড়ছে চাপ। শিগগির পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি না দিলে দাম আরও বাড়বে। আর এর প্রভাব পড়বে কোরবানির ঈদে।
এদিকে দাম বাড়ার কারণ খতিয়ে দেখতে বাজার তদারকির ওপর জোর দিচ্ছে ক্যাব। তবে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ থাকলেও দেশে পেঁয়াজের উৎপাদনের অবস্থা ভালো। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত চার বছরের ব্যবধানে দেশি পেঁয়াজের উৎপাদন ১৩ লাখ টনের বেশি বেড়েছে। তবু অজানা কারণে বাড়ছে দাম।
সরেজমিন খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন মোকাম ঘুরে দেখা যায়, মোকামে ছোট, মাঝারি ও বড়– এই তিন ধরনের পেঁয়াজ রয়েছে। ছোট পেঁয়াজ পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে কেজি ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। মাঝারি পেঁয়াজ ৪৫ থেকে ৫০ টাকা এবং বড় ভালো মানের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে কেজি ৫২ থেকে ৫৬ টাকা।
হঠাৎ খাতুনগঞ্জে দেশি পেঁয়াজের দাম বাড়তে থাকায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারে। সরেজমিন নগরের কর্ণফুলী বাজার, দেওয়ান বাজার, চকবাজার, ফিরিঙ্গী বাজার, বহদ্দারহাটসহ বিভিন্ন বাজারে দেশি পেঁয়াজের কেজি বিক্রি হচ্ছে অন্তত ৬০ টাকায়।
খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের তথ্য মতে, বর্তমানে খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন মোকামে প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ ট্রাক পেঁয়াজের ট্রাক ঢুকছে। তবে তা চাহিদার তুলনায় কম। স্বাভাবিক সময়ে খাতুনগঞ্জে প্রতিদিন শুধু ৩০ থেকে ৪০ ট্রাক ভারতীয় পেঁয়াজ ঢুকত। এখন শুধু দেশি পেঁয়াজ ঢুকছে। অন্যান্য সময় ভারতের পাশাপাশি মিয়ানমার, পাকিস্তান, তুরস্কসহ আরও কয়েকটি দেশ থেকে পেঁয়াজবোঝাই ট্রাক খাতুনগঞ্জে ঢুকলেও এখন সেসব দেশের পেঁয়াজও বাজারে আসছে না। খাতুনগঞ্জে পাবনা, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া থেকে পেঁয়াজ আসছে। কিছু পেঁয়াজ আসছে তাহেরপুর থেকে।
এ ব্যাপারে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘প্রায় দুই মাস ধরে বন্ধ পেঁয়াজ আমদানি। এ কারণে সরবরাহ সংকট দেখা দিয়েছে। দেশি পেঁয়াজ দিয়েই চাহিদা মেটাতে হচ্ছে। তাই পেঁয়াজের দাম বাড়ছে।’ নগরের বহদ্দারহাটে বাজার করতে আসা চাকরিজীবী কানিজ ফাতেমা বলেন, ‘কয়েক মাস ধরে ক্রয়ক্ষমতার বাইরে রয়েছে চাল, ডাল, তেলসহ বেশির ভাগ পণ্য। এর মধ্যে হঠাৎ বেড়েছে পেঁয়াজের দামও। কিছুদিন আগে যে পেঁয়াজ প্রতি কেজি ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় কিনেছি; একই পেঁয়াজ এখন কিনতে হচ্ছে ৬০ টাকায়। এই অবস্থায় নির্দিষ্ট টাকা দিয়ে কীভাবে পুরো মাসের খরচ সামাল দেব বুঝে উঠতে পারছি না।’ আরেক ক্রেতা রিকশাচালক মো. ইদ্রিস বলেন, ‘প্রায় সবকিছুর দামই এখন ঊর্ধ্বমুখী। কোনো কিছুতেই হাত দেওয়া যাচ্ছে না। এর মধ্যে কিছুটা স্বস্তি ছিল পেঁয়াজের বাজারে। সেটিও এখন বেড়ে ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে।’
ক্যাবের উদ্বেগ
কয়েক দিনের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম বাড়লেও তদারকি নেই কোনো সরকারি সংস্থার। আর এর খেসারত দিতে হচ্ছে ভোক্তাদের। এ প্রসঙ্গে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, ‘প্রায় ভোগ্যপণ্যের অস্বাভাবিক দামে কয়েক মাস ধরেই সাধারণ মানুষ দিশেহারা। এতে নিদারুণ কষ্টে পরিবার নিয়ে সময় কাটছে নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষের। জুনের শেষের দিকে কোরবানির ঈদ। তাই ঈদে বাড়তি মুনাফা হাতিয়ে নিতে অসাধু ব্যবসায়ীরা এখন থেকেই পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে কিনা– সেটি খুঁজে বের করতে বাজার তদারকির বিকল্প নেই। দুর্ভাগ্য, এখনও মাঠ পর্যায়ে কাউকে দেখা যাচ্ছে না।’