ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের সোয়া ১১ কোটি টাকা লুট করার সময় ব্যবহার করা হয় ট্রাফিক পুলিশের এক সার্জেন্টের ভাইয়ের গাড়িচালকের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া মাইক্রোবাস। ভাড়া নেওয়ার নাম করে চালককে ডেকে নিয়ে মারধর করে হাত-পা বেঁধে গাড়ির পেছনেই ফেলে রাখা হয়। চক্রটি নতুন একটি সিমকার্ডও কিনেছিল। সেটি দিয়েই তারা চালককে কল করে। তদন্ত সংশ্লিষ্টদের সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
পুলিশ বলছে, ছিনতাইয়ের সময় ঘটনাস্থলে ৮-১০ জন সদস্য উপস্থিত ছিল। তাদের কয়েকজনের ব্যাপারে এরই মধ্যে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া গেছে। শিগগির তাদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এদিকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অভিযানে উদ্ধার টাকার পরিমাণ নিয়ে দু্ই রকমের তথ্যের ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে। ডিবিপ্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ গতকাল শুক্রবার বলেন, লুট হওয়া চারটি ট্রাঙ্কের মধ্যে তিনটিই উদ্ধার হওয়ায় অনুমান থেকে প্রথমে টাকার ওই পরিমাণ বলা হয়েছিল। পরে সবার উপস্থিতিতে গুনে সঠিক অঙ্ক জানা যায়।
এর আগে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ডিবি লুণ্ঠিত প্রায় ৯ কোটি টাকা উদ্ধারের কথা বললেও পরে তুরাগ থানা পুলিশ জানায়, উদ্ধার করা ট্রাঙ্কে ৩ কোটি ৮৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা পাওয়া গেছে।
তদন্ত সূত্র জানায়, ঢাকা মহানগর পুলিশের উত্তরা ট্রাফিক বিভাগের এক সার্জেন্ট তাঁর ভাইয়ের মালিকানাধীন মাইক্রোবাসের দেখাশোনা করেন। সেটি একজন চালকের অধীনে ভাড়া দেওয়া রয়েছে। ব্যাংকের টাকা লুটের আগের দিন সিলেটে যাওয়ার কথা বলে গাড়িটি ভাড়া নেওয়া হয়। ঘটনার দিন সকালে চালককে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে যেতে বলা হয়। তিনি সেখানে গাড়ি নিয়ে গেলে দুর্বৃত্তরা তাঁকে মারধর করে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ নেয়। পরে তাঁকে বেঁধে গাড়িতে রেখেই ব্যাংকের টাকা লুট করে। পালানোর পথে তারা এক জায়গায় থেমে গাড়িতে তেল ভরে। পথের কোনো এক স্থানে তারা টাকা ভর্তি একটি ট্রাঙ্ক অন্য একটি গাড়িতে সরিয়ে নেয়।
সংশ্লিষ্ট এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ঘটনার দিন মাইক্রোবাসের দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সার্জেন্ট ফোন করে চালককে পাচ্ছিলেন না। এতে তাঁর সন্দেহ হয়, চালক গাড়ি নিয়ে পালালেন কিনা। ফলে তিনি এ বিষয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন। পুলিশ তাঁর খোয়া যাওয়া গাড়ি ও চালককে খুঁজছিল। এর মধ্যে ছিনতাইয়ের সময় গাড়িতে থাকা নিরাপত্তাকর্মীদের দেওয়া তথ্য ও গাড়ির নম্বর অনুযায়ী, পুলিশ একটি সাদা রঙের গাড়ি শনাক্ত করে। তবে তারা সেটি দেখে জানায়, ছিনতাইয়ে ব্যবহৃত গাড়িটি ছিল কালো রঙের। প্রকৃতপক্ষে তাদের দেওয়া নম্বরপ্লেটের একটি অঙ্ক ছিল ভুল। এ পর্যায়ে তদন্তকারীরা লক্ষ্য করেন, পুলিশ সার্জেন্টের হারানো গাড়িটির রং কালো এবং নম্বরপ্লেটের একটি অঙ্ক শুধু আলাদা। তখন তারা বুঝতে পারেন, এই গাড়িটি ছিনতাইয়ে ব্যবহার করা হয়েছে। চালকের কাছ থেকে এ ব্যাপারে বর্ণনাও পাওয়া যায়।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ছিনতাইয়ে জড়িত চক্রটি পেশাদার অপরাধী বলে ধারণা করা হচ্ছে। তারা যে সিমকার্ড দিয়ে গাড়িচালককে কল করেছিল, সেটি সদ্য কেনা এবং মাত্র দুটি কল করা হয়। ছিনতাইয়ের পর কয়েকটি ভাগ করে বিভিন্ন স্থানে টাকা সরিয়ে ফেলা হয়। এ ঘটনার সঙ্গে টাকা বহনের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান মানি প্লান্ট লিংক সিকিউরিটিজ কোম্পানির কোনো কর্মীর যোগসাজশ থাকতে পারে। জড়িতদের ধরতে গত রাতে ঢাকার বাইরে অভিযান চলছিল। এ ঘটনায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে তুরাগ থানায় মামলা হয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার মোরশেদ আলম বলেন, উদ্ধার করা টাকার অঙ্ক নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। ট্রাঙ্কগুলো উদ্ধারের পর সিকিউরিটি কোম্পানির কর্মকর্তারা সেগুলো নিয়ে পুলিশের সঙ্গেই তুরাগ থানায় যান। সেখানে তাঁরা আঙুলের ছাপ দিয়ে ট্রাঙ্কের তালা খোলেন। কিন্তু একটি ট্রাঙ্ক ওপর থেকে ঠিকঠাক দেখালেও নিচে কেটে টাকা সরিয়ে ফেলেছিল ছিনতাইকারীরা। এ বিষয়গুলো আগে বোঝা যায়নি। পরে সিকিউরিটি কোম্পানির মালিকসহ একাধিক সংস্থার কর্মকর্তার উপস্থিতিতে টাকা গণনা করা হয়।
পুলিশের উত্তরা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার বদরুল হাসান বলেন, ছিনতাইয়ের ঘটনায় মানি প্লান্ট লিংক সিকিউরিটিজ কোম্পানি লিমিটেডের দুই পরিচালকসহ সাতজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। গতকাল তাঁদের আত্মীয়ের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তদন্তের প্রয়োজনে তাঁদের আবারও ডাকা হতে পারে।
মানি প্লান্ট লিংক কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক যশোদা জীবন দেবনাথ গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ডিবির উদ্ধার করা টাকা গণনার সময় আমি তুরাগ থানায় উপস্থিত ছিলাম। সেখানে প্রায় চার কোটি টাকা পাওয়া যায়। আমাদের টাকাবাহী গাড়িতে মানি প্লান্টের একজন ব্যবস্থাপক, একজন নির্বাহী কর্মকর্তা, একজন সুপারভাইজার, একজন কর্মচারী, দু’জন গার্ড ও চালক ছিলেন। তাঁরা ঘটনার পরপর ৯৯৯-এ ফোন করে জানান এবং তুরাগ থানায় রিপোর্ট করতে গাড়ি নিয়ে চলে যান। পরে সন্ধ্যায় পুলিশ তাদের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে।
এর আগে টাকা বহনের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা পুলিশকে জানায়, বৃহস্পতিবার সকালে মানি প্লান্টের একটি গাড়িতে সোয়া ১১ কোটি টাকা সাভার ইপিজেডে ডাচ্-বাংলার বুথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। সকাল ৭টার দিকে উত্তরা ১৬ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর ব্রিজ এলাকায় একটি মাইক্রোবাস দিয়ে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে গাড়িটি থামানো হয়। পরক্ষণে সেই মাইক্রোবাস থেকে ১০-১২ জন নেমে টাকা বহন করা গাড়ির দরজা ভেঙে ফেলে। তারা সবাইকে মারধর করে টাকা ভর্তি চারটি ট্রাঙ্ক ছিনিয়ে নেয়। তাদের হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না। ওই দলের একজন নিজেকে ডিবির সদস্য বলে পরিচয় দেয়।