পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার মৌলিক কিছু উদ্যোগ নেবে বলে আশা ইফতেখারুজ্জামানের

0
58
‘সাম্প্রতিক পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি ও পার্বত্য চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়নে করণীয়’ শীর্ষক এই আলোচনা সভা। আজ শুক্রবার রাজধানীর ধানমন্ডির ডব্লিউভিএ মিলনায়তনে

পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার অন্তত মৌলিক কিছু কার্যক্রমের উদ্যোগ নেবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।

আজ শুক্রবার রাজধানীর ধানমন্ডির ডব্লিউভিএ মিলনায়তনে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় এই আশা প্রকাশ করেছেন ইফতেখারুজ্জামান। ‘সাম্প্রতিক পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি ও পার্বত্য চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়নে করণীয়’ শীর্ষক এই আলোচনা সভার আয়োজন করে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম।

ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীদের অধিকার হরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ ও আমলাদের মধ্যে একধরনের ঐকমত্য আছে। সেটার সঙ্গে যোগ হয়েছে সামরিক প্রচেষ্টা। এসবের বাস্তবতা হলো বর্তমান পাহাড়ের পরিস্থিতি।

গণমাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে তেমন প্রতিবেদন উঠে আসে না বলে মন্তব্য করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক। তিনি বলেন, এর কারণও সবার জানা। গণমাধ্যম যতই স্বাধীন হোক, কিন্তু সেখানে কিছু নিয়ন্ত্রণ আছে।

দেশে ‘আদিবাসী’ শব্দ নিয়ে গবেষণা করা দরকার বলে উল্লেখ করেন ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, আদিবাসী শব্দ নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভিন্ন তথ্য দেওয়া হয়। শব্দটির অর্থ কোনো বসতির সময়কাল নাকি জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত সেটা খুঁজে দেখতে হবে।

চব্বিশের জুলাইয়ে দেশের সব রাজনৈতিক দল ও জনতার হাতে বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশের ব্যানার ছিল বলে উল্লেখ করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক। তিনি বলেন, এখানে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল অবিস্মরণীয়। একইভাবে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। জুলাইয়ে পরে তাঁরা পরিবর্তনে আশা দেখলেও বাস্তবে তেমনটি ঘটেনি।

অন্তর্বর্তী সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে অন্তত মৌলিক কিছু কার্যক্রমের উদ্যোগ নেবে বলে আশা প্রকাশ করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের পেছনে যে রাজনৈতিক শক্তি আছে, তাদের কাছে আদিবাসী শব্দ কতটা গ্রহণীয়, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তাই এখানে চ্যালেঞ্জ অনেক বড়।

নিজেদের অধিকার রক্ষায় ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর সদস্যদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান টিআইবির নির্বাহী পরিচালক। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা শুধু ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীদের অধিকার নয়। এটা সমগ্র বাংলাদেশের মানুষের অধিকার। এই বোধ জাগ্রত করতে হবে। সব রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট অবস্থান আদায় করে নেওয়ার বিকল্প নেই।

আলোচনা সভায় নির্ধারিত বিষয়বস্তুর ওপর প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আদিবাসী অধিকারকর্মী সতেজ চাকমা। সভায় শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহসাধারণ সম্পাদক গজেন্দ্রনাথ মাহাতো। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির পর ২৮ বছর পার হয়েছে। কিন্তু এখনো সেই চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামকে বেসামরিক প্রশাসনে ন্যস্ত করতে হবে।

জুলাই সনদে পাহাড়ি ও ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য রক্ষাকবচ তৈরির আহ্বান জানান বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং। তিনি বলেন, একটা দেশ কতটা সভ্য, গণতান্ত্রিক ও মানবিক, তা তার সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্রগোষ্ঠীর ভালো থাকার সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র গোষ্ঠীরা ভালো নেই। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন করতেই হবে। পাহাড়ের জীববৈচিত্র্য ও সংস্কৃতি রক্ষায় এটা জরুরি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক খায়রুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ৫৪ বছর পরে এসে বুঝতে পারছেন, এখানে বারবার স্বৈরতন্ত্র উত্থিত হচ্ছে। একদল যায়, একদল আসে। কিন্তু সংবিধান, রাষ্ট্রনীতিসহ কোনো কিছুতেই ঐকমত্য দেখা যায় না। একইভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে কী ধরনের শাসনকাঠামো প্রতিষ্ঠিত হবে, তা নিয়ে বাংলাদেশের শাসকশ্রেণির মধ্যে কখনো ঐকমত্য দেখা যায়নি। সেখানে চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে বাঙালি মুসলমানদের মনস্তাত্ত্বিক দিক ও কিছু সামরিক প্রেক্ষাপট দায়ী। তাই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সেখানকার অধিবাসীদের সংগঠিত হতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে করণীয়সহ সেখানকার বাস্তবতা সম্পর্কে সব রাজনৈতিক দলের কাছে ব্যাপক প্রচারের আহ্বান জানান বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স। তিনি বলেন, তাঁরা ছাত্রজীবনে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠায় যেসব দাবি করেছিলেন, তা এখনো করছেন। অর্থাৎ বিগত তিন দশকে সেখানে তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। এই পরিবর্তনের জন্য সবার সচেতনভাবে কাজ করা জরুরি।

পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য একটি ইতিবাচক পথরেখা তৈরি করে যাওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত বলে মন্তব্য করেন রুহিন হোসেন প্রিন্স। তিনি বলেন, অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় অন্যতম গুরুত্ব বহন করে। কাজেই সরকারকে সে বিষয়ে মাখায় রেখে পদক্ষেপ নিতে হবে।

অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান তাঁদের ভীষণ আশাবাদী করেছিল। কিন্তু তারপরে সেই আশা কিছুটা হতাশায় পরিণত হয়। বিগত সরকার ক্ষুদ্রগোষ্ঠীদের নিয়ে অনেক ধরনের আশা জাগিয়েছিল। কিন্তু তারা সেটা বাস্তবায়ন করেনি। পার্বত্য ভূমি বিরোধ কমিশনকে পুনরায় সক্রিয় করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আশা করেছিলেন, তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সেখানকার মতো করে দেখবে। কিন্তু তারা সেটা করেনি। পার্বত্য অঞ্চলের মানুষদের এখনো আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়। অন্তত বর্তমান সরকারের কাছে এই অবস্থার পরিবর্তন আশা করেছিলেন তাঁরা। যেহেতু অধিকার আদায় হয়নি, তাই পাহাড়ের অধিবাসীদের অধিকার আদায়ে বহুদূর যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয়ে বিভিন্ন মতামত, উদ্যোগের কথা বলা হলেও বিগত সরকারগুলোর পক্ষ থেকে তা তেমন আমলে নেওয়া হয়নি বলে মন্তব্য করেন সাবেক সংসদ সদস্য ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহসভাপতি ঊষাতন তালুকদার। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে সামরিক-বেসামরিক অনেক ধরনের বাধা আছে। তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে তাঁরা সবার সহযোগিতা চান। কিছু খারাপ আমলা, রাজনীতিবিদ ও সাম্প্রদায়িক শক্তির কারণে গত ২৮ বছরেও এই চুক্তি বাস্তবায়ন হয়নি। এই চুক্তি অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষার ছিল। তাঁরা মনে করেন, তাঁদের সঙ্গে বেইমানি করা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার চাইলে অন্তত একটি পথরেখা প্রদান করতে পারে। তাঁরা এটুকু অনুরোধ জানান।

আলোচনা সভার সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম সহসভাপতি অজয় এ মৃ। সঞ্চালনা করেন সংগঠনটির তথ্য ও প্রচার সম্পাদক হিরণ মিত্র চাকমা। উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর সদস্যরা।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.