সাড়ে ৩৩ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে এক প্রকল্পে পরামর্শকের জন্য। এ প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া ২২১ কোটি টাকা।
এত টাকার বিনিময়ে পরামর্শকদের কাছ থেকে কী সুপারিশ পাওয়া গেছে, তা স্পষ্ট নয়। এ ছাড়া প্রশিক্ষণ ব্যয় দেখানো হয়েছে ১৫ কোটি ২৩ লাখ টাকা। আবার প্রশিক্ষণের নামে একই কর্মকর্তা বিদেশ সফর করেছেন ১০ থেকে ১২ বার। প্রকল্পের টাকায় এমন ২৯৬ জন ঘুরে বেড়িয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, নরওয়ে, ভিয়েতনাম, হংকং, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
২০০৯ সালে শুরু হয়ে চলতি বছরের ৩০ জুন শেষ হওয়া ‘নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (কেইস) প্রকল্পের’ অর্থ ব্যয়ে এমন সব অসঙ্গতি চিহ্নিত করেছে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী জানিয়েছেন, প্রকল্পের ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিয়ে কমিটির প্রতিবেদন সুনির্দিষ্ট পর্যবেক্ষণসহ সরকারের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন (আইএমইডি) বিভাগে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. এ কে এম রফিক আহমেদ জানান, প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল টেকসই পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ নেওয়ার মাধ্যমে অধিক বায়ুদূষণ সৃষ্টিকারী উৎস, বিশেষ করে যানবাহন ও ইটভাটা থেকে নিঃসরণ মাত্রা কমানো। প্রকল্প সাহায্য হিসেবে বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তার পরিমাণ ছিল ৩৩ দশমিক ২৩ মিলিয়ন ইউএস ডলার। ২৮৪ কোটি ৭৮ লাখ টাকা প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ থাকলেও তিন দফা মেয়াদ বাড়িয়ে ব্যয় হয়েছে ২২১ কোটি টাকা। প্রকল্প এলাকা হিসেবে নির্ধারিত ছিল ঢাকা, গাজীপুর, আশুলিয়া/সাভার, নরসিংদী এবং নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, বরিশাল, সিলেট, রাজশাহী, খুলনা, ময়মনসিংহ ও রংপুর সিটি করপোরেশন।
কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী জানিয়েছেন, প্রকল্পের ১৫ ভাগ অর্থ পরামর্শক নিয়োগে ব্যয় হয়েছে- এটা অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে দেখা গেছে এ প্রকল্পের ব্যয় মূল লক্ষ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বেশির ভাগ ব্যয় আসবাবপত্র ক্রয়, ভবন নির্মাণ ও গাড়ি ক্রয়ের মতো খাতে করা হয়েছে। এ প্রকল্পে এত গাড়ি কেনার প্রয়োজনীয়তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।
পরিবেশ সচিব আবদুল্লাহ আল মোহসীন চৌধুরী জানান, বড় শহরগুলোতে বায়ুদূষণ উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। ২০১০ সালে নেওয়া এই প্রকল্প পরিবেশ অধিদপ্তর, ঢাকা সিটি করপোরেশন (দক্ষিণ ও উত্তর) এবং ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়েছে।
সংসদ সচিবালয় সূত্র জানায়, ১২ জুন অনুষ্ঠিত কমিটির পঞ্চম বৈঠকের সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, এ প্রকল্পের মাধ্যমে বিদেশে প্রশিক্ষণ নেওয়া কর্মকর্তারা বর্তমানে কোথায়, প্রকল্পের টাকায় কয়টি গাড়ি কেনা হয়েছে, গাড়িগুলো কারা ব্যবহার করছে, পরামর্শকদের সুপারিশ কী ছিল এবং কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে- তা কমিটিকে লিখিতভাবে জানাতে হবে। প্রকল্প ব্যয়ের খাতওয়ারি হিসাব বিবরণীও জানাতে হবে।
প্রকল্পের টাকায় ২৯৬ জন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ঘুরেছেন। এদের মধ্যে ২৬ জন প্রকল্প শেষ না হতেই অবসরে চলে গেছেন। অনেকে বদলি হয়ে অন্য মন্ত্রণালয়ে চলে গেছেন। এর মধ্যে প্রকল্প পরিচালক নাসিরুদ্দীন কমপক্ষে চারবার বিদেশ সফর করে এখন অবসরে রয়েছেন। শাহ রেজওয়ান হায়াত কমপক্ষে ১০ বার বিদেশ সফর করে এখন দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ে রয়েছেন। আর শামসুর রহমান খান চারবার সফর করেছেন হংকং, ইতালি, নরওয়ে ও ভিয়েতনাম। বিদেশ সফরের তালিকায় রয়েছেন বেশ কয়েকজন স্যাম্পল কালেক্টর। আছেন ঢাকার মেয়র ও পুলিশ কর্মকর্তারাও। ঋণের টাকায় প্রশিক্ষণ শেষ করে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের এই বিদেশ ভ্রমণকে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় বলে মনে করছে সংসদীয় কমিটি।
প্রকল্পের টাকায় কেনা দুটি জিপগাড়ি প্রকল্প পরিচালক ব্যবহার করেছেন। তবে প্রতিবেদনে একই ব্যক্তিকে একবার দেখানো হয়েছে পরিচালক হিসেবে, আরেকবার দেখানো হয়েছে প্রকল্প কো-অর্ডিনেটর হিসেবে। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ৯টি গাড়িকে নষ্ট বা অচল দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে দুটি জিপ, চারটি পিকআপ, দুটি মাইক্রোবাস ও একটি মোবাইল মনিটরিং ভ্যান।
পরামর্শকদের পেছনে প্রকল্পের ১৫ ভাগ অর্থ ব্যয় দেখানো হলেও তাদের সুপারিশ-সংক্রান্ত অনুসন্ধানের পরিপ্রেক্ষিতে জানানো হয়েছে, ট্রাফিক সিগন্যাল সিনক্রোনাইজেশন কনসালট্যান্ট ঢাকা মহানগরীর প্রাইমারি রোড থেকে অযান্ত্রিক যানবাহন অপসারণের সুপারিশ করেন। এই সুপারিশ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ৭ জুলাই থেকে গাবতলী থেকে আজিমপুর, কুড়িল থেকে সায়েদাবাদ এবং সায়েন্সল্যাব থেকে শাহবাগ পর্যন্ত রিকশা ও অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
তবে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ২০০৪ সালে গৃহীত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (এসটিপি) একই সড়কে একাধিক গতিসম্পন্ন, অর্থাৎ অযান্ত্রিক গাড়ি চলাচল বন্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছিল। পরে সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (আরএসটিপি) একই সুপারিশ করা হলে ২০১৬ সালের অক্টোবরে মন্ত্রিসভায় তা অনুমোদন পায়।
সংসদীয় কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, প্রকল্প-সংশ্নিষ্টরা বলেছেন, বিশ্বব্যাংকের শর্তের কারণে পরামর্শক নিয়োগ করতে হয়েছে। তাদের এই ব্যাখ্যা যৌক্তিক নয়। কারণ, পরামর্শকের সুপারিশগুলো কাজে লাগাতে হবে। এক প্রকল্পের সুপারিশ যাতে একই ধরনের অন্য প্রকল্পে ব্যবহারের সুযোগ থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে। দেখা গেছে, একই পরামর্শককে একাধিকবার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পরামর্শকরা কেউ কাজ শেষ করতে পারেননি। কেউ ১০ শতাংশ, আবার কেউ ২০ শতাংশ কাজ করেছেন। তা হলে এ ধরনের পরামর্শক কেন নিয়োগ দেওয়া হলো?
এক প্রশ্নের জবাবে সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, প্রশিক্ষণের নামে ঢালাওভাবে বিদেশ সফর হলেও তার সুফল মিলছে না। প্রশিক্ষণের একটি নীতিমালা প্রণয়নের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, একটি সমন্বিত নীতিমালার মাধ্যমে এত কর্মকর্তাকে বিদেশে না পাঠিয়ে কয়েকজন প্রশিক্ষক দেশে এনে প্রশিক্ষণ নেওয়া যেতে পারে। তাহলে অর্থের অপচয় রোধ করা সম্ভব। নীতিমালা থাকলে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের মাধ্যমে লোক নির্বাচন করার সুযোগ বন্ধ হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
কমিটির সভাপতি বলেন, পরিবেশ সম্পর্কে তেমন ধারণা রাখেন না, এমন ব্যক্তিদেরও প্রকল্পে যুক্ত করা হয়েছে। এগুলো প্রকারান্তরে অনিয়ম-দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়ার শামিল। তাই বিষয়টি আইএমইডিকে দিয়ে তদন্ত করানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।