পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সরিয়ে দিয়ে দুর্বল হয়েছেন সি চিন পিং

0
205

চীনের সর্বকনিষ্ঠ পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন গ্যাংয়ের অপসারণ এবং ৫৭ বছর বয়সী এই নেতার রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে যাওয়া সারা বিশ্বের পত্রপত্রিকায় শিরোনাম হয়েছে।
এই নেতাকে কেন সরিয়ে দেওয়া হলো, তা নিয়ে যখন তুমুল আলোচনা, তখন চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরেকটি কাজ করে বসে। তারা তাদের ওয়েবসাইট থেকে কিন গ্যাংয়ের বৈঠকসংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য মুছে দেয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উধাও হয়ে থাকার তুলনায় তাঁর–সম্পর্কিত তথ্য মুছে ফেলার ঘটনার গুরুত্ব অনেক বেশি।

চীনের অভিজাত রাজনীতির গতিপথ সম্পর্কে আগে থেকে কোনো কিছু আঁচ করা যায় না। এই রাজনীতি কিছুটা অস্বচ্ছ। প্রস্তরকঠিন হাতে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং জাতিকে নিয়ন্ত্রণ করলেও আসলে যে ভেতরে-ভেতরে অস্থিরতা চলছে, তা কিন গ্যাংয়ের উপাখ্যান থেকে পরিষ্কার হয়ে গেছে। আরও স্পষ্ট হলো যে চীনের শীর্ষ ও জ্যেষ্ঠ রাজনীতিক এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ওপর এই ঘটনার প্রভাব পড়েছে।

কয়েক দশক ধরে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সিসিপি) কীভাবে পরিচালিত হয়, তা বুঝতে একটি বিশ্লেষণমূলক কাঠামো দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন অনেকে। কিন্তু সিসিপির বিরুদ্ধে স্বচ্ছতার ঘাটতি থাকায় সেই চেষ্টা অনেকাংশেই ব্যর্থ হয়েছে।

শীর্ষ পর্যায়ে ক্ষমতার ভাগাভাগির যে মডেল জিয়াং জেমিন এবং হু জিনতাওয়ের আমলেও ছিল, তা সম্প্রতি বাতিল করে দেন সি চিন পিং। ওই মডেলে একটি অংশীদারত্বমূলক নেতৃত্ব ঠিক করে দেয় দলে কার কী অবস্থান।

গত বছর দলটির ২০তম পার্টি কংগ্রেসে তৃতীয়বারের মতো নেতা ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে সির মনোনয়ন পাওয়ার ঘটনাটি ছিল অভূতপূর্ব। এ সময় তিনি দলের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে নির্বাচিত হন। সেই সঙ্গে দলের সর্বোচ্চ পর্যায় যেমন পলিট ব্যুরো, স্ট্যান্ডিং কমিটি এবং স্টেট কাউন্সিলে তাঁর আজ্ঞাবহ ব্যক্তিদের পদায়ন করেন।

সির এই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হওয়া নিয়ে অনেকের মতামত হলো, সিসিপির রাজনীতি একঘেয়ে হয়ে উঠেছে। জয়ীরাই সবটা পাবে—এমন মডেলে চলে গেছে তারা। তবে এই পরিস্থিতি দলটিকে স্থিতিশীলতা দেয় এবং দলে কে কোন অবস্থানে থাকবেন, তা সহজেই সুনির্দিষ্ট করা যায়। ফলে নীতি বাস্তবায়ন অনেকটাই নির্বিঘ্ন হয়।

তবে তরতর করে উন্নতির শিখরে পৌঁছানো কিন যখন রহস্যজনকভাবে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান, তখন তাঁদের এই ধারণা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

এ বছর ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসে কিন স্টেট কাউন্সিলরের পদ পান। মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদেরও ওপরে এই পদ।

সি ভালোভাবেই চিনতেন কিনকে। কিন একসময় প্রেসিডেন্টের কূটনীতিক দলের সদস্য ছিলেন। সেই সূত্রে তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে রাষ্ট্রদূতের পদ অলংকৃত করেছেন। স্টেট কাউন্সেলর হিসেবেও সি-ই তাঁকে পছন্দ করেছিলেন। ২০তম পার্টি কংগ্রেসে সির কোনো উত্তরাধিকার না থাকা এবং কিনের বয়স কম হওয়ায় তিনিই সির উত্তরাধিকার হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে থাকবেন, এমনটাই ধরে নেওয়া হয়েছিল।

কিনের ত্বরিত উত্থানের সঙ্গে ভূরাজনৈতিক চাপ হ্রাস এবং চীনের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করতে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে সির চেষ্টার একটা যোগসূত্র পাওয়া যায়। তাই কিনের এই হঠাৎ হারিয়ে যাওয়ার একটা সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ে চীনের ভেতরে ও বাইরে। এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে সির নিয়ন্ত্রণ সিসিপির ভেতরের বিরোধ নিরসন করতে পারেনি। এতেই খুব সম্ভবত কিনের পতন হলো

সিসিপির নেতৃত্বে কিনের যে যথেষ্ট প্রভাব ছিল, তার প্রমাণ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তাঁর দায়িত্ব পালন। কংগ্রেসের পর এটি পরিষ্কার হয়ে যায় যে দেশটির নেতৃত্ব যুক্তরাষ্ট্রের মতো বৃহৎ শক্তির সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন চায়। যুক্তরাষ্ট্র অর্থনীতি, নিরাপত্তা ও প্রযুক্তি খাতে নানাভাবে চীনকে মারাত্মক চাপে রেখেছে।

সম্পর্কোন্নয়নের এই চেষ্টায় অবশ্য বিঘ্ন ঘটায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির সেই রহস্যময় বেলুন। কিনের দল তারপরও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ চালিয়ে যেতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের চীন সফরের পূর্বপরিকল্পনা বাতিল হয়ে যায়। তারপরও উধাও হয়ে যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে কিনের সঙ্গে বেইজিংয়ে দেখা করেন ব্লিঙ্কেন।

কিন ‘উলফ ওয়ারিয়র ডিপ্লোম্যাসি’র পথ থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছিলেন। একসময় লড়াকু ও আক্রমণাত্মক কূটনীতির মুখ ছিলেন কিন। তিনি রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের সময় চীনকে রাশিয়া থেকে একটু দূরত্বে রাখেন। দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট–এ এ বিষয় নিয়ে তিনি একটি নিবন্ধও লিখেছিলেন। সেখানে তিনি বলেন, চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যোগাযোগ অক্ষুণ্ন থাকবে এবং কখনোই তা বন্ধ হবে না।

‘দুর্বল ও অপমানিত’ পুতিন ছাড়া সি চিন পিংয়ের গতিও নেই

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান প্রভাবশালী উলফ ওয়ারিয়র ছিলেন। কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি কোণঠাসা হয়ে পড়েন। এ সময় চীনের সঙ্গে ইউরোপের সম্পর্কও ক্রমাগত ভালো হতে থাকে। গত বছরের এপ্রিলে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ এবং ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট আরসোলা ভন ডের লিয়েন বেইজিং সফরে আসেন।

কিনের ত্বরিত উত্থানের সঙ্গে ভূরাজনৈতিক চাপ হ্রাস এবং চীনের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করতে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে সির চেষ্টার একটা যোগসূত্র পাওয়া যায়।
তাই কিনের এই হঠাৎ হারিয়ে যাওয়ার একটা সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ে চীনের ভেতরে ও বাইরে। এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে সির নিয়ন্ত্রণ সিসিপির ভেতরের বিরোধ নিরসন করতে পারেনি। এতেই খুব সম্ভবত কিনের পতন হলো।

কিনের পূর্বসূরি ৬৯ বছর বয়সী ওয়াং ইর আবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার ঘটনাটি রীতিমতো অস্বাভাবিক। ভুল মানুষকে গুরুত্বপূর্ণ জায়গার পদায়ন নিয়ে শীর্ষ নেতৃত্বের উদ্বেগও এতে প্রকাশ পায়। মোটের ওপর আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে চলতে থাকা অস্থিরতা এবং চীনের প্রায় স্থবির অর্থনীতির এই সময়ে দলের সদস্যরা ভুল করে বসলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং দলের ভেতর শীর্ষ নেতৃত্ব ও নীতিনির্ধারণে ক্ষমতার লড়াই বাড়বে।
পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের যে নীতি, তার সঙ্গে ওয়াং ইর কট্টর অবস্থানের বিরোধের কথাও গোপন কিছু ছিল না। এ নিয়ে এমনকি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তাঁর অনেক সহকর্মীর কাছ থেকেও তাঁকে সমালোচনা শুনতে হয়েছে।

চীনের রাজনীতি যে জীবন অথবা মৃত্যুর মতো দুই চরম অবস্থার মধ্যে আবর্তিত, তা–ও প্রকাশ করে দিয়েছে কিনের ঘটনা। এই রাজনীতিতে সির কর্তৃত্ব কিছু ‘ইয়েস মেন’ তৈরি করেছে। তবে এর মধ্যেও ভিন্নমত ক্রিয়াশীল এবং সুযোগ পেলেই হুমকি আসতে পারে—এমন কাউকে অপসারণে তারা এক জোট হয়।

কিনকে অপসারণের ব্যাপারে স্বচ্ছতার ঘাটতি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থায় চিড় ধরাবে। আর এমন একটা সময়ে এই ঘটনা ঘটল, যখন পশ্চিমা অর্থনীতি চীনের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে।

ভূরাজনীতি ও সরবরাহব্যবস্থার ঝুঁকি তো আছেই। এর মধ্যে নতুন করে যদি চীন আবার ‘উলফ ওয়ারিয়র’–এর ভূমিকা নেয়, তাহলে বিদেশি কর্মকর্তারা চীনের সঙ্গে ব্যবসা সম্প্রসারণের বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবতে পারেন।

গত কয়েক মাসে, বিশেষ করে জিরো-কোভিড নীতিমালা শিথিলের পর চীন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য লালগালিচা বিছিয়ে দিয়েছিল। কারণ, তাঁদের অনেকেই চীনের বাইরে বিকল্প খুঁজছিলেন।

চীনা সেনাবাহিনীর সঙ্গে কথা বলতে কেন এতটা ব্যাকুল মার্কিনরা

যখন টেসলার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইলন মাস্ক ২০২৩ সালের মে মাসে সাংহাই সফরে যান, তখন কিন তাঁকে বলেন, চীন সরকার বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধুজ্ঞানে সুযোগ-সুবিধা দেবে। কিন মাস্ককে এ-ও বলেছিলেন, চীন আরও উদার হবে এবং ভবিষ্যতে বাজার ব্যবস্থাপনায় সংস্কার করবে।

চীনা একটা প্রবাদ আছে, ‘যখন মানুষ সরে যায়, তখন চা-ও ঠান্ডা হয়ে যায়।’ কিন চলে যাওয়ার পর বিনিয়োগকারীসহ বিশ্বের অনেকের মনেই সন্দেহ, তাঁর কথার আর দাম আছে কি না।

  • ছেন গ্যাং ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের ইস্ট এশিয়ান ইনস্টিটিউটের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ও সহকারী পরিচালক।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.