জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রদের রাজনৈতিক দল আসছে ফেব্রুয়ারি মাসেই। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে দলটির যাত্রা শুরু হবে। যেখান থেকে গত বছরের ৩ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনে একদফার ঘোষণা দিয়েছিল ছাত্ররা। নতুন রাজনৈতিক দল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে বড় জমায়েতের লক্ষ্য তাদের।
একদফার ঘোষক ছাত্রনেতা ও বর্তমান তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম-ই নয়া দলটির হাল ধরছেন। দল ঘোষণার আগেই সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করবেন তিনি।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ একজন কর্মকর্তা যমুনা টেলিভিশনকে বলেছেন, চলতি মাসেই পদত্যাগ করবেন উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। এ বিষয়ে উপদেষ্টা পরিষদ অবগত।
গত সোমবার (১০ ফেব্রুয়ারি) ওই কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয় যমুনা টেলিভিশনের। তবে তথ্য উপদেষ্টার পদত্যাগের নির্দিষ্ট তারিখ জানাননি তিনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতাদের সাথে কথা বলে ধারণা পাওয়া যায়, চলতি সপ্তাহেই পদত্যাগ করতে পারেন উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম।
ছাত্ররা কী বলছে?
নতুন দলে নাহিদ ইসলামের দায়িত্ব নেয়া এবং উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগের বিষয়ে কথা বললেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির কেউ গণমাধ্যমে নিজের নাম উদ্ধৃত করতে চাননি। তাদের সাথেও কথা বলে জানা গেছে, নাহিদ ইসলাম-ই দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন তাদের দলের।
নাহিদ ইসলামকে দলের শীর্ষ নেতৃত্বে বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে তারা বেশ কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করার কথা বলেছেন।
এ নিয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় এক সদস্য বলছিলেন, নাহিদ ইসলাম ‘কুল’ প্রকৃতির। ধীরস্থির সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। সবচেয়ে বড় বিষয়, শেখ হাসিনার পতনে একদফার ঘোষক এই নাহিদ ইসলাম-ই।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামের নেতৃত্ব মানুষের নজর কেড়েছে। তার ঘোষণাতেই লাখও ছাত্র-জনতা ৫ আগস্ট রাস্তায় নেমে এসেছিল। অন্তর্বর্তী সরকারে দায়িত্ব নিলেও এখন পর্যন্ত তার সুনাম রয়েছে। এছাড়া, রাজপথে নেতৃত্বের পাশাপাশি রাষ্ট্র পরিচালনায়ও অংশ নেয়ায় দুটিইতে পোক্ত হয়েছেন নাহিদ ইসলাম— বলছিলেন নাগরিক কমিটির ওই নেতা।
জানা গেছে, দল ঘোষণা নিয়ে এখন শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে। নেতৃত্বের চূড়ান্ত বাছাই, গঠনতন্ত্র এসব নিয়েই ব্যস্ত সময় পার করছেন ছাত্রনেতারা। দল ঘোষণার তারিখ চূড়ান্ত হতে পারে আজ শনিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি)।
দলের দ্বিতীয় শীর্ষ পদে কে থাকতে পারেন? তা-ও জানতে চাওয়া হয়। তারা বলছেন, ডাকসুর সাবেক ছাত্রনেতা ও নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন অথবা ‘নতুন কোনো মুখ, তবে পরিচিত’। নতুন কোনো মুখ বলতে তারা বুঝিয়েছেন, এখন পর্যন্ত নাগরিক কমিটি বা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কমিটির পদে নেই, তবে সবার কাছে পরিচিত মুখ, এমন কেউ। তবে আখতার হোসেনই এগিয়ে রয়েছেন।
দল ঘোষণার সময় ‘পরিচিত মুখ বা ফিগার’ দিয়ে চমক দেখাবেন, এমনটাও বলছেন তারা। ইতোমধ্যে দলের দায়িত্ব নিতে ৭০-৮০ জন মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে চূড়ান্ত করেছেন, যাদের মধ্যে রয়েছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ, মানবাধিকারকর্মীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী।
নাহিদ ইসলাম সরকারে যোগ দেয়ার আগে গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির মহাসচিব ছিলেন। আখতার হোসেন সংগঠনটির আহ্বায়ক ছিলেন। গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির নেতারা জুলাই আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন।
নাহিদ ইসলাম কী বলছেন?
দলের দায়িত্ব নেয়া এবং তার আগে উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগের বিষয়ে জানতে গত ১১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় নাহিদ ইসলামকে হোয়াটসঅ্যাপে প্রশ্ন করা হয়। তবে প্রতিবেদন প্রকাশের আগ পর্যন্ত তিনি কোনও উত্তর দেননি।
পঁচিশের ডিসেম্বরে ভোট:
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস একটি সময়রেখা দিয়েছেন। তা থেকে বুঝা যায়, ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬-এর জুনের মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি দ্রুত নির্বাচন দেয়ার জন্য বলে আসছে। ভোটের সময় নিয়ে জামায়াতের বক্তব্য পরিষ্কার নয়।
গত মঙ্গলবার (১০ ফেব্রুয়ারি) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন অতি দ্রুত তারা নির্বাচনের ব্যবস্থা করছেন। এবং বলেছেনও ডিসেম্বরের মধ্যে তারা নির্বাচনের জন্য কাজ করছেন।’
পরদিন ইউএনডিপিসহ উন্নয়ন সহযোগী ১৮টি দেশের রাষ্ট্রদূত ও প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকের পরে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ-ও সাংবাদিকদের কাছাকাছি কথা বলেছেন। তিনি জানান, ডিসেম্বর ধরে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে কমিশন।
ইউনূস সরকারের ওই কর্মকর্তা যমুনা টেলিভিশনকে জানিয়েছেন, সরকারের দিক থেকে বারবার বলার পরও সুষ্ঠু ভোট ও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন হবে কি না— এ নিয়ে কোনও দলের নেতা সংশয় প্রকাশ করলেও করতে পারে। তবে, নির্বাচন সুষ্ঠু ও সময়রেখার মধ্যে করতে বদ্ধ পরিকর ড. ইউনূস। চলতি বছরের ডিসেম্বরেই ভোট হবে। এ লক্ষ্যেই এগোচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাফ কথা, তিনি সুষ্ঠু ভোট দিয়েই দায়িত্ব হস্তান্তর করতে চান।
নির্বাচন আয়োজনে তৃতীয় কোনও পক্ষের এখন পর্যন্ত বাধা নেই বলেও জানিয়েছেন তিনি। ফলে ‘ইলেকশন ম্যাকানিজম’ এর শঙ্কা উড়িয়ে দেন ওই কর্মকর্তা।
জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় ভোট হবে কি না?
স্থানীয় নির্বাচন আগে করার বিষয়ে সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে ইতোমধ্যে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মোহাম্মদ সজীব ভূঁইয়া।
যদিও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর বিএনপি মহাসচিব স্পষ্ট করে বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন মানবে না তার দল।
তবে, ছাত্ররাসহ অনেক রাজনৈতিক দল আগে স্থানীয় পর্যায়ে ভোট চায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ভোট আয়োজনের সক্ষমতা যাচাই স্বরূপ স্থানীয় নির্বাচনের কথা বলছেন তারা। আর পরে ভোট হলে ক্ষমতায় যাওয়া দলের প্রভাব বিস্তারের শঙ্কাও করছেন কেউ কেউ।
উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে বৈঠকের পর ইসি আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ আরও বলেছেন, অন্য নির্বাচনের প্রস্তুতি ইসি নিচ্ছে না। তবে সরকার চাইলে ইসি জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করবে।
এ অবস্থায় রাজনীতির মাঠে এখন বড় প্রশ্ন, সংসদ নির্বাচনের আগেই স্থানীয় ভোট হবে কি না? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চাওয়া হয়েছিল প্রধান উপদেষ্টার কর্যালয়ের ওই কর্মকর্তার কাছে। তবে, তিনি স্পষ্ট কোনও উত্তর দেননি। কথা বলে যা বুঝা গেছে, আগে স্থানীয় নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে রাজনৈতিক ঐক্যমতের বিষয়টি জরুরি হয়ে পড়েছে।
নাহিদের হাতে থাকা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেতে পারেন কে?
নাহিদ ইসলাম এখন অন্তর্বর্তী সরকারের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি পদত্যাগ করলে মন্ত্রণালয়ের প্রধানের পদ দুইটি খালি হবে।
নাহিদ ইসলাম পদত্যাগের পর উপদেষ্টা পরিষদ ঢেলে সাজানোর গুঞ্জন রয়েছে।
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আসতে পারেন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় এক সদস্য জানালেন এ তথ্য।
জুলাই আন্দোলনের অন্যতম ছাত্রনেতা মাহফুজ আলম কার্যত দফতরবিহীন উপদেষ্টা।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের বিষয়ে জানা যায়নি। এটিও কি মাহফুজ আলমের অধীনে আসবে নাকি নতুন কেউ আসতে পারে— তা জানার চেষ্টা করেছিল যমুনা টেলিভিশন। তবে নির্ভরযোগ্য সূত্রে কোনও উত্তর মেলেনি।
মিশুক নজিব