চট্টগ্রামের অন্যতম শাস্ত্রীয় নৃত্যশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘ওডিসি অ্যান্ড টেগোর ড্যান্স মুভমেন্ট সেন্টার’ সম্প্রতি উদ্যাপন করেছে তাদের ২৫ বছরের পথচলার উৎসব। ৮ ও ৯ নভেম্বর থিয়েটার ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে নৃত্যালেখ্য ও ওডিশি নৃত্যকলার অনুপম পরিবেশনা প্রাণভরে উপভোগ করেছেন মুগ্ধ দর্শক। সিকি শতাব্দীর নিরন্তর সৃজনযাত্রার উৎসবে মঞ্চজুড়ে নবীন ও পুরোনো শিল্পীদের নৃত্যের তালে তালে নূপুরের শব্দ আর সুরের অনুরণনে সময় যেন থেমে ছিল। দর্শকেরা শুধু অনুষ্ঠান দেখছিলেন না, তাঁরা যেন প্রত্যক্ষ করছিলেন এক গৌরবময় ইতিহাস—চট্টগ্রামের বুকে জন্ম নেওয়া এক শিল্প আন্দোলনের অনন্য পর্ব।
প্রথম দিন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও সাহিত্য নিয়ে নৃত্যালেখ্য ‘বাঁশরী ও তূর্য হাতে কবি’ পরিবেশনায় কবির সাহিত্যের দ্রোহ, প্রতিবাদ, প্রণয়, আধ্যাত্মচেতনা, প্রকৃতিপ্রেম, সমসাময়িক গ্রামবাংলার চিত্র অনন্য মুদ্রায় আর শিল্পীদের দেহভাষায় ফুটে উঠেছে। দ্বিতীয় দিনের আকর্ষণ ছিল ‘ওডিশি নৃত্যকলা’।
ওডিসি অ্যান্ড টেগোর ড্যান্স মুভমেন্ট সেন্টার’ বাংলাদেশের নৃত্যকলাচর্চায় যে নতুন ধারা সংযোজন করেছে, তারই নান্দনিক উদাহরণ দর্শক দুটো দিন উপভোগ করেছেন। এই শিল্পধারার কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন প্রমা অবন্তি। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক ওডিশি নৃত্যশিল্পী। তিনি বিশ্বাস করেন, ‘নৃত্য শুধু দেহের অনুশীলন নয়, এটি আত্মার আরাধনা।’ রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ওডিশি নৃত্যে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জনের পর প্রমা শিষ্য হয়েছেন ভারতের কিংবদন্তি গুরু কেলুচরণ মহাপাত্রের। গুরু থেকে পাওয়া তত্ত্ব ও তালের মেলবন্ধনে তিনি গড়ে তুলেছেন এমন এক নৃত্যভাষা, যেখানে রবীন্দ্রনাথের ভাবধারা ও ওডিশির শাস্ত্রীয় রূপ মিশে গেছে এক নান্দনিক স্রোতে।

২০০০ সালে চট্টগ্রামে প্রমা প্রতিষ্ঠা করেন এই প্রতিষ্ঠান। একটি ছোট কক্ষ, কয়েকজন তরুণ-তরুণী আর এক মহৎ স্বপ্ন মনে। দুই দশকের বেশি সময় ধরে পথ চলতে চলতে প্রতিষ্ঠানটি নৃত্যশিক্ষার এক আলোকিত কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। এখানে শেখানো হয় ছন্দের সঙ্গে মানবিকতার পাঠ, তালের সঙ্গে শৃঙ্খলার শিক্ষা। শতাধিক শিক্ষার্থী এই কেন্দ্রে নৃত্যকে জীবনবোধ হিসেবে গ্রহণ করেছে। প্রমা অবন্তির নির্দেশনায় তাঁদের পদচারণে ধ্বনিত হয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মিশ্র সুর।
২৫ বছর পূর্তির আয়োজনটি ছিল এক মূলত সংগীত, কবিতা, আবৃত্তি ও নাটকীয় মুহূর্তের অপূর্ব মেলবন্ধন। প্রমার শিষ্যরা যখন নেচে নেচে মঞ্চে প্রাণ আনছিল, তখন মনে হচ্ছিল, এই আয়োজন কেবল উৎসব নয়; বরং শিল্পের উত্তরাধিকারের এক অনন্য আয়োজন। মিলনায়তনের আবছা আলোয় যখন সুরে সুরে নৃত্যের দেহভাষা মিলেমিশে গেল, দর্শকদের চোখে জল আর হৃদয়ে আলো একসঙ্গে ঝলমল করে উঠল।

প্রমা অবন্তির যাত্রা বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে ছুঁয়ে গেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গন। তিনি নেচেছেন ভারতের রাউরকেলা, ত্রিপুরা, কলকাতা থেকে শুরু করে ইউরোপের নানা মঞ্চে। পেয়েছেন প্রাইড অব উইমেন অ্যাওয়ার্ড এবং আন্তর্জাতিক নৃত্য পরিষদের (ইউনেসকো–সি আইডি) সদস্যপদ। তাঁর প্রতিষ্ঠানও পেয়েছে বহু স্বীকৃতি ও সম্মান—দেশজুড়ে নৃত্যানুরাগীদের কাছে এটি হয়ে উঠেছে শাস্ত্রীয় নৃত্যের এক অনন্য শিক্ষাগৃহ।
কিন্তু প্রমার সবচেয়ে বড় সাফল্য এই কেন্দ্রের শিক্ষার্থীরা। যাদের মধ্যে কেউ কেউ ইতিমধ্যে মঞ্চে দাঁড়িয়ে নিজের আলোর বৃত্ত তৈরি করছে। প্রমা বলেন, ‘নাচ শেখানো মানে শুধু পদক্ষেপ শেখানো নয়, শেখানো মানে জীবনের সৌন্দর্য চিনে নেওয়া।’
আজ যখন প্রতিষ্ঠানটি ২৫–এ পা রাখল, তখন মনে হয়, এই সময়ের প্রতিটি ঘুঙুরের শব্দে লুকিয়ে আছে দুই যুগের সাধনা, মুগ্ধতা আর অগণিত সৃজনপ্রয়াস। প্রমা অবন্তি ও তাঁর সহযাত্রীদের এই অবিরাম পরিশ্রম একদিন হয়তো বাংলাদেশের শাস্ত্রীয় নৃত্যচর্চার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। দুই দিনের শিল্প পরিবেশনার পর সুধীজনের আলাপে সেই কথাই উঠে এসেছে।

অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব থিয়েটার আর্টসের (বিটা) নির্বাহী প্রধান নাট্যজন ও সংগঠক শিশির দত্ত, কবি অভীক ওসমান, জেলা কালচারাল অফিসার সৈয়দ মুহম্মদ আয়াজ মাবুদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ইসরাফিল শাহীন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন ফারুক তাহের এবং সভাপতিত্ব করেন প্রতিষ্ঠানের সাধারণ সম্পাদক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যায়ের নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক কুন্তল বড়ুয়া। প্রতিষ্ঠানের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে শিক্ষা ও গবেষণায় অবদান রাখার জন্য ‘আজীবন সম্মাননা’য় সম্মানিত করা হয় সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক অনুপম সেনকে। এ ছাড়া অধ্যাপক সনজীব বড়ুয়াকে ‘সাহিত্য সম্মাননা ২০২৫’ পুরস্কার প্রদান করা হয়।
ওডিসি অ্যান্ড ট্যাগোর ড্যান্স মুভমেন্ট সেন্টারের ২৫ বছরের যাত্রা যেন এক নীরব নদী, যার জলে মিলেছে নান্দনিক মানবতার স্রোত। এই নদীর তীরে দাঁড়িয়ে প্রমা অবন্তি বলেন, ‘নৃত্যের ভেতরেই আছে আমার দেশ, আমার মানুষ, আমার রবীন্দ্রনাথ।’ আর তাঁর নৃত্যচরণে যে আলো জ্বলে ওঠে, তা শুধু মঞ্চকে নয়, আমাদের মননকেও আলোকিত করে যায়, ছন্দে ছন্দে।


















