- অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য সংলাপের তাগিদ
- অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চায় বন্ধু রাষ্ট্রগুলো
- গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে কূটনীতিকদের আস্থায় নিয়েছে সরকারনির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এখনও সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই চায় বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। আর আওয়ামী লীগ ও সমমনা দলগুলো চায়, সংবিধান অনুযায়ী এই সরকারের অধীনেই নির্বাচনে যেতে। দু’দলের নেতারাই বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে ছুটে গিয়ে স্ব-স্ব অবস্থান ব্যাখ্যা করেন; কিন্তু কূটনীতিকরা এই প্রশ্নে কোনো পক্ষ না নিয়ে নিজেদের সম্পূর্ণ দূরত্বে রাখেন। বিদেশিরা বলেন, তাঁরা দেখতে চান অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন।কূটনীতিকরা বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার এ দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়, যা রাজনীতিকদেরই সমাধান করতে হবে এবং তাঁরা সংঘাত এড়িয়ে সংলাপের তাগিদ দেন।
সম্প্রতি বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করেন ঢাকার ইইউর কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূত। সেখানে তাঁরা জানিয়েছেন, নির্বাচন যদি অংশগ্রহণমূলক না হয়, তাহলে পর্যবেক্ষক পাঠানো হবে না। যদি পর্যবেক্ষক না পাঠায়, তাহলে সেই নির্বাচন নিয়ে তাঁদের সমালোচনাও সীমিত হয়ে আসবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও পশ্চিমা দেশগুলো পর্যবেক্ষক পাঠানো সম্পর্কে এ অবস্থান নিলে আমাদের নির্বাচনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও গ্রহণযোগ্যতা দুর্বল হয়ে যায়।
আগামী নির্বাচন যদি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের দ্বারা স্বীকৃত হতে হয়, তাহলে এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যাতে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়। এমন বাস্তবতায় ক্ষমতাসীন সরকারের ওপর নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করার চাপ বজায় থাকছেই।
স্বাধীনতার পর দেশের প্রায় সব নির্বাচন নিয়েই কিছু-না-কিছু বিতর্ক আছে। স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে একটি এবং ১৯৯৬ সালে প্রথম সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর তিনটি জাতীয় নির্বাচন অরাজনৈতিক নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হওয়ায় সর্বাধিক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। কিন্তু ক্রমাগত রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করায় তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাটিই বিতর্কিত হয়ে পড়ে এবং আদালতের রায়ে তা অসাংবিধানিক ঘোষিত হওয়ায় ২০১১ সালে সংসদের সিদ্ধান্তে বিলুপ্ত হয়।
২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। দু’বারই ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ এবং দেশে-বিদেশে দুটি নির্বাচনই বিতর্কিত রয়ে যায়।
এখন আবার নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক ধরনের সরকারের দাবি তুলে বিএনপি ও সমমনারা আন্দোলন করছে। নির্বাচনের আগে অনেক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।ইইউ ও ভারতের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি নেতারা জানিয়ে দিয়েছেন, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবেন না তাঁরা। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বৈঠক করে পরিষ্কার বলেছে, সংবিধানের বাইরে গিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো সুযোগ নেই।
নির্বাচনকালীন সরকার প্রসঙ্গে ঢাকার পূর্ব ও পশ্চিমা দেশগুলোর একাধিক হাইকমিশনার ও রাষ্ট্রদূতের কাছে তাঁর দেশের অবস্থান জানতে চেয়েছিল । এ বিষয়ে বেশিরভাগ হাইকমিশনার ও রাষ্ট্রদূত সরাসরি মন্তব্য করতে চাননি। কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন নাম প্রকাশ না করার শর্তে। দুই মিশনপ্রধান এ নিয়ে তাঁদের অবস্থান তুলে ধরেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অবস্থান জানতে চাইলে ঢাকার ইইউ ডেলিগেশন প্রধান চার্লস হোয়াইটলি বলেন, ‘নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আমাদের কোনো অবস্থান নেই।’ঢাকার ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট সি ডিকসন বলেন, ‘আমরা চাই বাংলাদেশে সহিংসতামুক্ত স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হোক। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশিদের গণতান্ত্রিক মতপ্রকাশ ও প্রতিনিধিত্বের সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগকে সমর্থন করে।’
সংলাপের পক্ষে মত দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা সব রাজনৈতিক দলকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকতে উৎসাহিত করি। সেই সঙ্গে সব পক্ষের পূর্ণ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকারকে চাহিদা অনুযায়ী যথাযথ পরিবেশ নিশ্চিত করতে আহ্বান জানাই। আন্তর্জাতিক নির্বাচনী পর্যবেক্ষক আসা এবং দলগুলোর মধ্যকার সংলাপের মধ্য দিয়ে শুরু হতে পারে এ প্রক্রিয়া।’পশ্চিমা কূটনীতিকরা জানান, বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে বড় সমস্যা আস্থার সংকট। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরকে বিশ্বাস করে না। আর যারা ক্ষমতায় থেকেছে বা রয়েছে, সবার প্রবণতা যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় টিকে থাকা। জনগণকে পাশ কাটিয়ে পরের বার ক্ষমতা নিশ্চিত করতে কাজ করে তারা। এর মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা অবাধ থাকবে, তা আশা করা কঠিন।
তাঁরা বলেন, সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে; সে বিষয়ে আস্থা রয়েছে; তবে আগের অভিজ্ঞতার আলোকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক রাষ্ট্রদূত বলেন, ক্ষমতায় গেলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করার মনোভাব প্রখর হয়। এ কারণে ক্ষমতায় থাকাটা বাংলাদেশে জরুরি। বিষয়টি অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার মতো। ফলে এ বিতর্কে কোনো দেশ যেতে চাইবে না। যদি জনসমর্থিত রাজনৈতিক আন্দোলন দেশে পরিবর্তন ঘটায়, তবে সেই পরিবর্তিত অবস্থায় আলোচনা করে করণীয় ঠিক করবে বন্ধু রাষ্ট্রগুলো।তিনি বলেন, বাংলাদেশে সংবিধানে যেভাবে বলা রয়েছে, সে অনুযায়ী নির্বাচন চাওয়ার বাইরে কূটনীতিকদের অন্য কোনো উপায় নেই।
গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা সফরের সময় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কাউন্সিলর ডেরেক এইচ শোলের কাছে বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের প্রশ্ন তুলে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে মূল্যায়ন জানতে চাওয়া হয়েছিল। এর উত্তরে সাংবাদিকদের তিনি বলেছিলেন, ‘নির্বাচনকালীন সরকার বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। যে নির্বাচন হয়নি, সেটি নিয়ে অনুমান করা সম্ভব নয়। আমরা মনে করি, সব নির্বাচন এমনভাবে হতে হবে, যাতে ফল পরাজিতরাও মেনে নেয়।’ডেরেক শোলে আরও বলেছিলেন, ‘শক্তিশালী সুশীল সমাজ, অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্র, একটি শক্তিশালী মুক্ত গণমাধ্যম যারা কঠিন প্রশ্ন করতে পারে ও নেতাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে পারে– এমন পরিবেশ একটি সুস্থ ও সমৃদ্ধ গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।’
সরকারের প্রতিশ্রুতি নিয়ে ডেরেক শোলে বলেছিলেন, ‘সরকার বলেছে, তারা অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন করতে চায়। আমি আশ্বস্ত, সরকার অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন করতে চায়। তবে সুশীল সমাজকে চাপে রাখা, মানবাধিকার পরিস্থিতি ও পূর্ববতী নির্বাচন নিয়ে আমাদের কিছু উদ্বেগ রয়েছে। আমরা বারবার আমাদের উদ্বেগগুলো জানিয়ে যাব। তবে আমরা আত্মবিশ্বাসী, সরকার তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন করবে।’অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যাখ্যায় তিনি বলেছিলেন, ‘নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়েছে– এ বিষয়টিতে জনগণকে আশ্বস্ত হতে হবে। জনগণ বললেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য বলা যায়– এটিই আমাদের অবাধ, মুক্ত, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাখ্যা।