আলোচিত জাহালমকাণ্ডের মূল হোতা আবু সালেক। তিনিই সোনালী ব্যাংকের সাড়ে ১৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। ফাঁসিয়েছেন নিরীহ পাটকল শ্রমিক জাহালমকে। দুর্নীতি দমন কমিশনের দীর্ঘ তদন্তে নাটের গুরু আবু সালেকের নাম এসেছে।
দুদক সূত্র জানায়, ভুল করে জাহালমকে আসামি করে ৩৩টি মামলা করেছিল দুদক। পরে সাতটি মামলা থেকে জাহালমের নাম বাদ দেওয়া হয়। বাকি ২৬টি মামলার চার্জশিটে আসামি হিসেবে জাহালমের নাম রাখা হয়েছিল। এবার এসব মামলা থেকে তাঁর নাম বাদ দেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি চার্জশিটে আবু সালেককেই আসামি করা হচ্ছে। ৩৩টি মামলার চার্জশিট শিগগিরই আদালতে পেশ করা হবে।
দুদকের ৯ তদন্ত কর্মকর্তা ৩৩টি মামলার প্রতিবেদন যথাযথ দপ্তরে পেশ করেছেন। কমিশনের অনুমোদনের পর চার্জশিটগুলো আদালতে পেশ করা হবে। এর আগে দুদকের ভুল তদন্তে নির্দোষ জাহালমকে ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় আবু সালেক হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছিল। দুদকের মামলায় বিনা অপরাধে জাহালমকে তিন বছর কারাভোগ করতে হয়েছে। হাইকোর্টের আদেশ অনুযায়ী ২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি তিনি মুক্তি পান।
৯ তদন্ত কর্মকর্তা হলেন– দুদকের উপপরিচালক রাশেদুর রেজা, শফি উল্লাহ, সেলিনা আখতার মনি, গুলশান আনোয়ার প্রধান, মো. সালাহউদ্দিন, সহকারী পরিচালক সাইফুল ইসলাম, আতাউর রহমান সরকার, নিয়ামুল আহসান গাজী ও মাহবুব আলম। তদন্তে জানা গেছে, সংঘবদ্ধ চক্র সোনালী ব্যাংকের ঢাকার মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট শাখার ১৮ কোটি ৪৭ লাখ ৩৫ হাজার টাকা আত্মসাৎ করতে ১৮টি ব্যাংকের ৩৩ শাখায় ৩৩টি ভুয়া হিসাব খুলেছিল। সোনালী ব্যাংকের ক্যান্টনমেন্ট শাখায় প্রতারকদের ছিল ৩টি হিসাব। এই তিনটি হিসাব থেকে ১৮টি ব্যাংকের ৩৩টি শাখায় খোলা ভুয়া হিসাবে ওই পরিমাণ টাকার চেক পাঠিয়ে কৌশলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্লিয়ারিং হাউস থেকে পাস করানো হয়েছিল। সোনালী ব্যাংকের ওই ৩টি হিসাব থেকে মোট ১০৬টি চেক ইস্যু করা হয়। এ ঘটনায় ব্যাংকের সন্দেহভাজন ৮ জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়েছিল। আটজনের মধ্যে ৩ জনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। অন্যরা কর্মরত।
সূত্র জানায়, অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় ২০১০ সালে প্রথমে সোনালী ব্যাংকের পক্ষ থেকে মতিঝিল থানায় মামলা করা হলে পুলিশ তদন্ত করে। পরবর্তী সময়ে মামলাটি তদন্তের জন্য দুদকে পাঠানো হয়। দুদক ঘটনাটি পুনরায় অনুসন্ধান করে ৩৩টি মামলা করে। এসব মামলায় জাহালমের নাম ছিল না। পরে দুদক ২০১১ সালে ৩৩টি মামলার তদন্ত করে ২৬ মামলার চার্জশিটে অর্থ আত্মসাতের মূল হোতা আবু সালেকের স্থলে জাহালমকে উল্লেখ করে। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে কমিশনের কাছে এই ভুল ধরা পড়ে। এ নিয়ে কমিশন দুঃখ প্রকাশ করেছিল। এর পর নতুন করে ৩৩টি মামলার তদন্ত শুরু করা হয়। অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় জালিয়াতির প্রমাণ পেয়ে ১৭ জনকে আসামি করে ৩৩টি ব্যাংক হিসাবের বিপরীতে ৩৩টি মামলা করেছিল দুদক।
জানা গেছে, সোনালী ব্যাংকের সাপোর্টিং সাব-স্টাফ মাইনুল হক মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট শাখা থেকে মতিঝিলের স্থানীয় কার্যালয়ে চেক আনা-নেওয়ার সময় পথে জালিয়াত চক্রের সদস্যদের সঙ্গে যোগসাজশে জাল ভাউচার তৈরি করে চেকের সংখ্যা বেশি উল্লেখ করে স্থানীয় কার্যালয়ে জমা দিতেন। পরে চেকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্লিয়ারিং হাউস থেকে যাচাই করে স্থানীয় কার্যালয়ে আনা হতো। এর পর পুনরায় যাচাইয়ের জন্য চেকগুলো পাঠানো হতো ক্যান্টনমেন্ট শাখায়। এ সময় আবার জাল ভাউচারে চেকের সংখ্যা কম উল্লেখ করা হতো। ক্যান্টনমেন্ট শাখা চেকগুলো যাচাই করে পাঠাত ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়ে। এই সময় পথে আবারও জাল ভাউচারে চেকের সংখ্যা বেশি উল্লেখ করে স্থানীয় কার্যালয়ে জমা দেওয়া হয়। ক্যান্টনমেন্ট শাখা থেকে ১০৬টি চেক ইস্যু করে ১৮ কোটি ৪৭ লাখ ৩৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়।
পথে জাল ভাউচারে চেকের সংখ্যা বাড়ানো-কমানো, প্রতারকদের নামে প্রয়োজনের অতিরিক্ত চেক বই ইস্যু করা, দায়িত্বপ্রাপ্ত লোক দিয়ে চেক আনা-নেওয়া না করিয়ে অন্য লোক দিয়ে আনা-নেওয়া করানোর ক্ষেত্রে জালিয়াত চক্রের সঙ্গে ক্যান্টনমেন্ট শাখা ও স্থানীয় কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী যুক্ত ছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। ওইসব ভুয়া চেকের বিপরীতে সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্টে পর্যাপ্ত টাকা আছে– এ ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার পরই চেকগুলো পাস করানো হয়েছিল। সোনালী ব্যাংকের ক্যান্টনমেন্ট শাখায় খোলা প্রতারক চক্রের ওই তিন হিসাবে কোনো টাকা ছিল না।
সূত্র জানায়, শ্যামল বাংলা আবাসন (প্রা.) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু সালেক, বাবুল মিয়া ও মোবাইল মেলার নামে ক্যান্টনমেন্ট শাখায় তিনটি হিসাব খোলা হয়েছিল। প্রতারক চক্রের সদস্যদের মধ্যে এ ছাড়া আছেন নূরে আলম, গোলাম মোর্তজা, সাগর আহমেদ, বছির দেওয়ান, আজাদ রহমান প্রমুখ।
দুদক কর্মকর্তারা জানান, তদন্তকালে ব্র্যাক ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা জাহালমকে সালেক হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে দুদকের চার্জশিটে জাহালমকে আবু সালেক ওরফে জাহালম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। চার্জশিটে জাহালমের টাঙ্গাইলের ঠিকানাও ব্যবহার করা হয়েছিল। যে ২৬টি মামলায় জাহালমের নামে চার্জশিট দেওয়া হয়েছিল, সেগুলোর ক্ষেত্রে ভুল সংশোধন করে সম্পুরক চার্জশিট দেওয়া হচ্ছে।