নবজীবন থামাতে পারেনি ডেঙ্গু

0
300
ডেঙ্গু জ্বর নিয়েই গত বুধবার প্রথম সন্তানের জন্ম দেন এই মা। নিজেকে নিয়ে উৎকণ্ঠায় থাকলেও সন্তানের মুখ দেখে তিনি সবকিছু ভুলে গেছেন। শুক্রবার ঢামেক হাসপাতালের ৮০২ নম্বর ওয়ার্ড ।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের ৮০২ নম্বর ওয়ার্ডে ‘সিভিয়ার ডেঙ্গু রোগী কর্নারের’ ৪৭-ক নম্বর শয্যা ঘিরে ব্যাপক কৌতূহল ও উৎকণ্ঠা। ছয় দিন আগে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে সন্তানসম্ভবা শারমিন আক্তার ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।

গত বুধবার তিনি কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। কৌতূহল ও উৎকণ্ঠা এই নবজাতককে নিয়ে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নোমান-শারমিন দম্পতির এই প্রথম সন্তান। একদিকে আনন্দ, অন্যদিকে ডেঙ্গুর আতঙ্ক। পুরো ওয়ার্ডের রোগী আর স্বজনের একমাত্র প্রার্থনা- ‘আহারে ফুটফুটে শিশুটার যেন ডেঙ্গু না হয়।’ রোগ শোক মহামারি যাই  আসুক না কেন, জীবন থেমে থাকে না। ডেঙ্গুও নবজীবনকে ঠেকাতে পারেনি। ডেঙ্গু বহু জীবন কেড়ে নিতে পারে, কিন্তু নবজীবনকে সে থামাতে পারেনি। এটাই জীবনের নিয়ম। নবজাতককে নিয়ে এই ওয়ার্ডে এখন ভিন্ন আমেজ। সবার একই প্রত্যাশা- বাচ্চাটি যেন ভালো থাকে। সুস্থ হয়েই বাড়ি ফিরবে মা-মেয়ে।

আশার বাণী শোনালেন ওই ওয়ার্ডে দায়িত্বরত চিকিৎসক আর নার্সরাও। তারা জানালেন, মা শারমিনের শরীরের রক্ত কণিকা কমতে কমতে ৭৫ হাজারে ঠেকেছিল। এখন এক লাখ ২৫ হাজারে স্থিতিশীল। শিশুটির শরীরে যাতে ডেঙ্গু ছড়াতে না পারে, সে জন্য আপাতত মায়ের বুকের দুধ খেতে দেওয়া হচ্ছে না।

শিশুটির বাবা মো. নোমান কারওয়ান বাজারের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। তিনি সারাক্ষণই চোখেমুখে উৎকণ্ঠা নিয়ে বসে থাকেন স্ত্রী আর মেয়ের শয্যাপাশে। গতকাল শুক্রবার সেখানেই তিনি বলছিলেন, প্রথম সন্তান, ওকে ঘিরে এখন পুরো পরিবারের আনন্দের বন্যা বয়ে যেত। কিন্তু সবাই চিন্তায় আছেন কী হয়! তিনি দোয়া চাইলেন মেয়ে আর স্ত্রীর জন্য।

ওই শয্যার বাইরে গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ড আর শিশু ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে, ওয়ার্ডের শয্যা ছাড়িয়ে বারান্দা আর করিডোরের মেঝেতেও চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে ডেঙ্গু রোগীদের। শিশু ওয়ার্ডের একেকটা শয্যায় দুইথেকে তিনজন করে শিশু রেখেও চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

রোগী আর স্বজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এতকিছুর পরও চিকিৎসক আর নার্সদের আন্তরিকতায় তারা খুশি। এর বাইরে শয্যা বরাদ্দ আর রক্ত পরীক্ষার সিরিয়াল নিয়ে কিছুটা ক্ষোভ আছে তাদের। একজন রোগী মারা গেলে বা সুস্থ হয়ে কেউ ঘরে ফিরে গেলে শূন্য শয্যা বরাদ্দ পাওয়ার জন্য রীতিমতো যুদ্ধ চলে। রোগীর চাপে প্যাথলজি বিভাগে রক্তের নমুনা দিতেই দিন পার হয়ে যায় বলে জানালেন ডেঙ্গু আক্রান্তদের সঙ্গে থাকা স্বজনরা।

মেডিসিন বিভাগের ৭০২ নম্বর পুরুষ ওয়ার্ডে ৪২ নম্বর শয্যায় চিকিৎসা নিচ্ছে ১৭ বছর বয়সী মিলন মিয়া। সে যাত্রাবাড়ীর অদূরে চিটাগাং রোডে সামিরা গার্মেন্টের কর্মী। ১০ দিন আগে জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পর আর কর্মস্থলে যেতে পারেনি। গত বৃহস্পতিবার থেকে ওই ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন।

মিলন মিয়া বলছিল, সে দ্রুত সুস্থ হয়ে ঈদের ছুটি কাটাতে সুনামগঞ্জের গ্রামের বাড়ি যেতে চায়। তার আর হাসপাতাল ভালো লাগে না। তবে তার পাশেই বসা মা হনুফা বেগম রাজ্যের দুশ্চিন্তা নিয়ে বলছিলেন, ‘বাড়ি গিয়ে কী হবে, ঈদ তো আর করা গেল না।’

এই মায়ের ভাষ্য, মিলন তার সংসার চালানোর একমাত্র অবলম্বন। জ্বরে পড়ে কর্মস্থলে যেতে পারেনি। এজন্য ঈদের বোনাসও পায়নি। বেতনের টাকা চিকিৎসাতেই শেষ হয়েছে। এখন ঈদে আর খরচ করার টাকাও নেই।

৬০২ নম্বর ওয়ার্ডের সিভিয়ার ডেঙ্গু রোগী কর্নারের ৩৫ নম্বর শয্যায় চিকিৎসা নিচ্ছেন হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজ থেকে সদ্য উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করা শাকিল চৌধুরী। পরীক্ষার ফল পাওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির খোঁজখবর আর ভাইয়ের কাছে বেড়াতে এসে আক্রান্ত হয়ে যান ডেঙ্গুতে। এখন বাড়ি যেতে ছটফট করছেন এই তরুণ।

শাকিলের বড় ভাই শাখাওয়াত হোসেন বলছিলেন, বেড়াতে এসে ভাই রোগী হয়ে গেল। যাত্রাবাড়ীর যে এলাকায় তিনি থাকেন, সেখানে মশা মারার ওষুধ দিতে কখনও দেখেননি। এলাকায় নিয়মিত ওষুধ দিলে ঈদের আগে তাদের এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতো না।

শিশু ওয়ার্ডে একজনের শয্যায় তিনজন :নতুন ভবনের মেডিসিন ওয়ার্ডে প্রাপ্ত বয়স্ক ডেঙ্গু আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়া হলেও পুরনো ভবনে শিশু ওয়ার্ডে চলছে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা। ওই ওয়ার্ডে একজনের শয্যায় দুই থেকে তিনজন করে শিশুকে শয্যা ভাগাভাগি করে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এর বাইরে বারান্দা আর করিডোরেও শয্যা পাতা হয়েছে। তবে ওয়ার্ডজুড়েই ভ্যাপসা গরমে হাঁসফাঁস করে শিশু রোগী ও তাদের স্বজনরা। গরম থেকে রক্ষা পেতে কেউ কেউ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বাইরে নিজেরাই ফ্যানের ব্যবস্থা করেছেন।

শিশু ওয়ার্ডের ১ নম্বর ইউনিটের ৮নং শয্যায় চিকিৎসা চলছে দোলাইরপাড় স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী ১১ বছর বয়সী রশ্মীমনির। একই শয্যায় কদমতলী এলাকার একটি মাদ্রাসার ছাত্র ১০ বছরের নাঈমেরও চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যেই ছোট্ট বিছানায় দুই শিশুর স্বজনরাও অবস্থান করায় গরমে ঘামছিলেন সবাই।

রশ্মীমনির মা সুমি আক্তার বলছিলেন, একদিন আগে এই শয্যায় আরও একটি ছোট্ট শিশু চিকিৎসাধীন ছিল। অবস্থা খারাপ হওয়ায় তাকে অন্যত্র নেওয়া হয়েছে। তবে শয্যা না পেলেও চিকিৎসকরা সব সময়ই তাদের খোঁজ রাখছেন- এটা তাদের কষ্ট ভুলিয়ে দেয়। তখন মেয়ে রশ্মীমনি কেঁদে কেঁদে শুধু বাসায় যাওয়ার কথা বলছিল।

করিডোরে বিছানো অতিরিক্ত ৪ নম্বর শয্যায় ডেঙ্গুর চিকিৎসা চলছে সাত বছর বয়সী মাহিনুরের। তার মা শাহনাজ পারভীন সন্তানসম্ভবা হওয়ায় বাসাতে বিশ্রামে রয়েছেন। মাহিনুরের নানি সালমা বেগমই হাসপাতালে নাতির দেখভাল করছেন।

সালমা বেগম বলছিলেন, নাতি বারবার মায়ের কাছে ফিরতে চাচ্ছে। কিন্তু ওর মা বিশ্রামে থাকায় হাসপাতালে আসতে পারছে না। মাহিনুরের বাবা মোয়াজ্জেমও মালয়েশিয়া প্রবাসী। তিন মাস আগে বাড়ি এলেও প্রবাসে চলে গেছেন। এমন অবস্থায় তিনি ছোট্ট নাতিকে নিয়ে কী পরিস্থিতিতে রয়েছেন, তা বোঝাতে পারবেন না।

হাসপাতালে ওই কয়েকজন ছাড়া আরও অন্তত ১৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্তের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তারা দ্রুত সুস্থ হতে চান। ঈদের আগেই বাড়ি ফিরতে চান। হাসপাতালের যন্ত্রণা আর সহ্য হচ্ছে না তাদের।

জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) মো. নাছির উদ্দিন বলেন, তারা রোগীদের সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হওয়ায় সবাইকে শয্যায় রাখা যায়নি। এজন্য বার্ন ইউনিটের নতুন ভবনে আলাদা ডেঙ্গু ওয়ার্ড তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.