দেশে মশার ওষুধ কবে আসবে কেউ জানে না

0
804
ডেঙ্গু জ্বরে ১৫ দিন ধরে ভুগছে ছয় বছরের শিশু মুশনান। হাসপাতালের মশারিঘেরা বিছানাটিই তার এখন পুরো জগৎ। আছে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা। পায়ে ছবি এঁকে সময় কাটাচ্ছে সে। গতকাল শিশু হাসপাতালের ডেঙ্গু সেলে।

মশা মারার ওষুধ নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটছে না। কবে দেশে ওষুধ আসবে, কবে সেই ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষা হবে, মাঠপর্যায়ে তার ব্যবহার কীভাবে শুরু হবে, তা কেউ জানে না। অথচ ডেঙ্গুর ভয়াবহতা দিন দিন বাড়ছেই।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেছেন, আগামী সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে তাঁর এলাকার মশা নিয়ন্ত্রণে আসবে। আর উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, খুব শিগগির ওষুধ আসবে, তবে দিনক্ষণ বলা সম্ভব নয়।

গতকাল বৃহস্পতিবার মশা নির্মূলে দেশের বাইরে থেকে নতুন ওষুধ কোন কর্তৃপক্ষ আনবে, তা নিয়ে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে শুনানি হয়। আদালত এডিস মশা নির্মূলে দ্রুত নতুন ওষুধ আনতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে আদেশ দেন। এ কাজে সহযোগিতা করতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে নির্দেশ দেওয়া হয়।

গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে ১ হাজার ৭১২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে বলে জানিয়েছে সরকারের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম। দেশের কিছু সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের তথ্য নিয়ে সরকার এই হিসাব দিচ্ছে। প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি। সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এবার ডেঙ্গুতে ৬৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রতিদিনই হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। ডেঙ্গু শনাক্তের পরীক্ষা করাতে অনেকে হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভিড় করছেন। ঢাকার একাধিক বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ডেঙ্গু শনাক্তের পরীক্ষার রিএজেন্টেরও স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। সুযোগ নিয়ে রিএজেন্টের ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা বলেছে, দুই সিটি করপোরেশনেই মশা বেড়েছে। গত মার্চে ১০০টি এলাকায় তারা এডিস মশার জরিপ করেছিল। জুলাই মাসের ১৭ থেকে ২৭ তারিখ পর্যন্ত এলাকায় জরিপ করে সরকারি ওই প্রতিষ্ঠান বলেছে, গড়ে মশা বেড়েছে ছয় গুণ। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক গত সপ্তাহে ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসকদের এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, মশা ১০ গুণ বেড়েছে।

নেত্রকোনা ছাড়া বাকি ৬৩ জেলায় ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত 
প্রতিদিনই হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে 
এবার ডেঙ্গুতে ৬৯ জনের মৃত্যু হয়েছে 
ডেঙ্গু শনাক্তের পরীক্ষার রিএজেন্টের স্বল্পতা

অথচ দুই সিটি করপোরেশন গতানুগতিক ধারায় মশা মারার ওষুধ ছিটাচ্ছে। সেই ওষুধের মান নিয়েও প্রশ্ন আছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, অকার্যকর ওষুধ ছিটাচ্ছে দুই সিটি করপোরেশন। বেশ কিছুদিন ধরেই ঢাকার দুই সিটির মেয়র নতুন ওষুধ আনার কথা নগর ও দেশবাসীকে শোনাচ্ছেন। কিন্তু গতকাল দুজনই নগরবাসীকে হতাশ করেছেন।

গতকাল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সেবাকক্ষে ডেঙ্গুবিষয়ক সমন্বয় সভায় মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, ‘ডেঙ্গু পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে, আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।’ আর উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, নতুন ওষুধ আনার জন্য কয়েক দিন ধরেই জোর তৎপরতা চলছে। আইনি বাধা দূর হয়েছে। সাংবাদিকেরা উত্তরের মেয়রকে প্রশ্ন করেন, ‘নতুন ওষুধ কবে আসছে?’ উত্তরে মেয়র বলেন, ‘আমি কবে আনছি, ডেটটি বলব না। আমরা চেষ্টা করছি যত দ্রুত সম্ভব ওষুধটা যেন আনা যায়।’

নতুন ওষুধ কবে আসবে, এটা যেমন পরিষ্কার হচ্ছে না, তেমনি ওষুধ এলেই তা সঙ্গে সঙ্গে কেউ ব্যবহার করতে পারবে না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বিধিবিধান মেনে ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষা করতে হবে, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কি না, তা-ও জানতে হবে। এই পরীক্ষা করবে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা প্রথম আলোকে বলেন, সব নিয়মনীতি ও প্রক্রিয়া মেনে পরীক্ষা শেষ করতে ৭ থেকে ১০ দিন লাগে।

রোগীর চাপ বাড়ছে
গতকাল সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, রোগী আর রোগীর স্বজনদের ভিড়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল-২-এর মেডিসিন ওয়ার্ডে ফাঁকা কোনো জায়গা নেই বললেই চলে। রক্ত পরীক্ষা ও ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়ার জন্য দীর্ঘ লাইন। এই হাসপাতালে গতকাল ৭০৬ জন রোগী ভর্তি ছিল। এর মধ্যে গতকাল আসা নতুন রোগী ছিল ২২২ জন।

হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন বলেন, বারান্দায়, সিঁড়ির নিচে, বেসমেন্টে যেখানে যতটুকু জায়গা পাওয়া যাচ্ছে, ডেঙ্গু রোগীর জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। স্থান সংকুলান না হলে শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে রোগী নেওয়া হবে। সেখানে ৮০০ থেকে ১০০০ রোগীর ব্যবস্থা করা যাবে। তিনি বলেন, ঢাকা মেডিকেলের পক্ষে রোগীর চাপ নেওয়া সম্ভব হলেও অন্যগুলোর পক্ষে তা সম্ভব নয়। তাই মশা নির্মূলেই জোর দিতে হবে।

ডেঙ্গু রোগীর চাপ পড়েছে ঢাকা শিশু হাসপাতালেও। ছোটদের এই হাসপাতালে গতকাল ১৩২টি শিশু ভর্তি ছিল। এদেরই একজন ছয় বছর বয়সী মুসনান। নার্সারিতে পড়ে। বাসা ফার্মগেটে। শিশুটির সঙ্গে ছিল মা ও খালা। দেশের অন্যান্য শত শত রোগীর মতো মশার কামড়ে এই শিশুও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে।

গতকাল দুপুরে ওই হাসপাতালে দোতলায় গিয়ে কথা হয় শিশুটির সঙ্গে। ৯ দিন ধরে সে হাসপাতালে। খেলতে না পারা শিশুটি ছবি আঁকছিল নিজের পায়ে। ও ছিল মশারির মধ্যে, যেন ওকে আবারও মশায় না কামড়ায়—এমনই আকুতি ছিল চোখে-মুখে।

আরও ছয় মৃত্যু
একমাত্র নেত্রকোনা জেলা ছাড়া বাকি ৬৩ জেলায় ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। আর গতকাল ছয়জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও আইইডিসিআরের তথ্য অনুযায়ী এ নিয়ে ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে হলো ৬৯।

ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় মাদারীপুরের দুজন রোগী মারা গেছেন। আর কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলায় মারা গেছেন একজন।

গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে তিনটার দিকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছেন শারমীন আক্তার (২২)। তাঁর বাড়ি মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার টেকেরহাট এলাকায়। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক কামদা প্রসাদ সাহা এ কথা জানিয়েছেন। গত বুধবার রাতে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে মারা গেছেন শিবচর উপজেলার পুরোনো ফেরিঘাট এলাকার ফারুক খান (২২)। পরিবারের সদস্যরা এ খবর জানিয়েছেন। গতকাল বিকেলে ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে মো. হামজা (১২) নামের এক শিক্ষার্থী। তার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার চুন্টা গ্রামে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ এ কথা জানিয়েছে।

এ ছাড়া ঢাকার ইবনে সিনা হাসপাতালে মারা গেছেন তিনজন। গতকাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

কীটতত্ত্ববিদ মঞ্জুর চৌধুরী গতকাল সন্ধ্যায় বলেন, ‘ডেঙ্গুর ভয়াবহতা প্রতিরোধে এ মুহূর্তের প্রথম কাজ দুটি—মশা মারা ও লার্ভা ধ্বংস করা। এর মূল দায়িত্ব দুই সিটি করপোরেশনের।’ তিনি বলেন, মশার জন্ম বা উৎসস্থল ধ্বংসের কাজে নাগরিক সমাজেরও দায়িত্ব আছে। ঢাকায় মশা নিধনের পাশাপাশি অন্য জেলায় ডেঙ্গু যাতে না ছড়ায়, সেই উদ্যোগও নিতে হবে। বাস, ট্রেন বা লঞ্চ ঢাকা ছাড়ার আগে সেগুলো মশামুক্ত করার উদ্যোগ জরুরি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.