দেশে ফেরাই চ্যালেঞ্জ ছিল

জাফরুল্লাহ চৌধুরী

0
185
জাফরুল্লাহ চৌধুরী

সদ্য প্রয়াত জাফরুল্লাহ চৌধুরী বীর মুক্তিযোদ্ধা, ভাস্কুলার সার্জন, বাংলাদেশ ফিল্ড হসপিটাল, গণস্বাস্থ্য হাসাপাতাল ও গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর ধানমন্ডির বাসায় সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছিলেন লেখক, গবেষক ও পরিবেশবিদ মার্জিয়া লিপি

সমকাল: মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য কবে ঘর ছেড়েছেন?

জাফরুল্লাহ চৌধুরী: আমি দেশের বাইরে; বিলাতে ছিলাম ১৯৬৭ সাল থেকেই। এফআরসিএস পড়তে লন্ডন যাই। বিশেষত ’৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পর বাঙালি জাতির প্রতি অবিচার ও ২৫ মার্চ কালরাতে নির্বিচারে পাকিস্তানিদের গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প ছিল না। আমি আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির (আইআরএ) সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। স্প্যানিশ সিভিল ওয়ারের যাঁরা ভ্যাটেরান ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে আলাপ করতাম। মানে, কীভাবে তাঁরা করেছেন, তা ভাবতাম। তখনই খোঁজখবর নিতাম। ব্রিটেনে একটি ট্রেনিংও নিয়েছি।
বিলাতের রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস থেকে এফআরসিএস প্রাইমারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই। সেখানে অবস্থানকালেই দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। এফআরসিএস চূড়ান্ত পর্ব শেষ না করেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে দেশে ফিরে আসি।

সমকাল: যুদ্ধ চলাকালীন পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল কিনা?

জাফরুল্লাহ চৌধুরী: যুদ্ধ চলাকালীন জুলাইয়ের ২ তারিখে সেক্টর কমান্ডার এবং ‘কে-ফোর্স’-এর অধিনায়ক খালেদ মোশাররফের দুটি অ্যাসাইনমেন্ট ক্র্যাক প্লাটুন কতটা কার্যকর এবং তেল বহনকারী ট্যাঙ্কারের সাপ্তাহিক গতিবিধির সংবাদ জানতে ঢাকায় এসেছিলাম। ক্র্যাক প্লাটুন আর তেল বহনকারী ট্যাঙ্কারের সংবাদ সংগ্রহ করে তিন দিন পর ফিরে যাই ত্রিপুরার মেলাঘরে। সে যাত্রায় কথা ছিল– ঢাকায় আসার পর একজন এস্কর্ট-সঙ্গী বকুল আর আমাকে কোনো এক গোপন স্থানে নিয়ে যাবে রাত্রিযাপনের জন্য। কিন্তু গুলিস্তানে নির্দিষ্ট লোকটির দেখা না পেয়ে চলে আসি বকশীবাজার। সেখানে আলিয়া মাদ্রাসার পাশেই ছিল আলবদর আর আলশামসের হেডকোয়ার্টার। বকশীবাজার মাঠের উল্টো পাশে নবকুমার ইনস্টিটিউশন। কিছুটা সামনে রয়েছে কেন্দ্রীয় কারাগার। কারাগারের পেছনে ৮ নম্বর উমেশ দত্ত রোডের ছোট্ট বাড়িতেই বসবাস ছিল আমাদের পরিবারের। সামনে রাস্তায় পুলিশ দেখে রিকশা থেকে দ্রুত লাফ দিয়ে নেমে দেয়াল টপকিয়ে গেট পার হয়ে বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ি। দরজায় শব্দ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের বাতিগুলো নিভে যায়। আবার দরজার কড়া নেড়ে মাকে ডাকি। আমার ছোট বোন মিলিকে মা বলেন, ‘কচি এসেছে; দরজা খুলে দে।’ উত্তরে মিলি মাকে মনে করিয়ে দেয়, ‘বড় ভাই তো বিলেতে।’ মা আবার বলেন, ‘বলেছি তো; দরজা খুলে দে। না হলে আমিই যাচ্ছি।’ মায়ের কথা শুনে আমার বোন দরজা খুলে দেয়।

সমকাল: কোন সেক্টরের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন?

জাফরুল্লাহ চৌধুরী: ২ নম্বর সেক্টর কমান্ডার এবং কে-ফোর্সের অধিনায়ক খালেদ মোশাররফের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। নয়াদিল্লি থেকে কলকাতায় বাংলাদেশ হাইকমিশনার এম. হোসেন আলী, মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল এমএজি ওসমানীর সঙ্গে দেখা করি। সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ, মেজর হায়দার এবং জেড ফোর্সের কমান্ডার জিয়াউর রহমানের সঙ্গেও দেখা হয়। প্রথম দিনের আলাপ শেষে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘বিভিন্ন জায়গায় যুদ্ধ হচ্ছে। যান, ঘুরে ঘুরে দেখুন।  যে কোনো এক ফ্রন্টে যোগ দিন।’ মুক্তিযোদ্ধা সাদেক খানের পরামর্শে গেরিলা যুদ্ধ বুঝতে আগরতলায় চলে আসি। আগরতলায় মেলাঘর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে গেরিলা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি।
প্রথমে চেয়েছিলাম সেক্টর-২ এর কাছাকাছি জায়গায় ফিল্ড হসপিটাল করতে। সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ রাজি ছিলেন না। তাঁর দরকার সৈনিক; ডাক্তার নয়। পরবর্তী সময়ে খালেদ মোশাররফ ও ভারতের জিবি হাসপাতালের প্রধান সার্জন ডা. রথিন দত্তের সহযোগিতায় পালিয়ে আসা ডা. মবিনকে নিয়ে আগরতলার বিশ্রামগঞ্জের মেলাঘরে হাবুল ব্যানার্জির আনারস বাগানে গড়ে তুলি প্রথম ফিল্ড হাসপাতাল ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হসপিটাল’।

সমকাল: মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার প্রধান প্রতিবন্ধকতা কী ছিল? কীভাবে তা অতিক্রম করেন?

জাফরুল্লাহ চৌধুরী: মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য দেশে ফেরাই সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জ ছিল। পাকিস্তানি পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলার কারণে রাষ্ট্রহীন নাগরিকে পরিণত হই। বিলাত থেকে দেশে ফিরে আসার কোনো উপায় ছিল না। ’৭১-এর মে মাসের শেষদিকে ডা. এমএ মবিন এবং আমি পাসপোর্ট ও নাগরিকত্বহীন অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশ্যে লন্ডন থেকে কলকাতার উদ্দেশে রওনা দিই। ভারতীয় ট্রাভেল পারমিট জোগাড় করে সিরিয়ান এয়ারলাইনসে উঠি। ট্রানজিট দামেস্ক। বিপত্তি বাধল সেখানেই। দামেস্ক বিমানবন্দরে সিরিয়ার সহযোগিতা নিয়ে পাকিস্তান সরকার গ্রেপ্তার করতে চাইল। বিমানবন্দরে উপস্থিত পাকিস্তানি এক কর্নেল দাবি করে বলেন, ‘আমাদের দুইজন নাগরিক উড়োজাহাজে আছে। তাদেরকে আমাদের হাতে তুলে দাও।’ দীর্ঘ সময় দেন-দরবার চলে। অবশেষে পাকিস্তানি কর্নেলকে জানানো হয়– তাঁরা পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে ভ্রমণ করছেন না;  ট্রাভেল পারমিট নিয়ে ভ্রমণ করছেন। তাঁরা পাকিস্তানের নাগরিক নন। সে যাত্রায় পাকিস্তানিদের হাত থেকে বেঁচে যাই।

সমকাল: মুক্তিযুদ্ধকালীন উল্লেখযোগ্য ঘটনা কী ছিল?

জাফরুল্লাহ চৌধুরী : ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রতিটি দিনই ছিল অনিশ্চয়তাপূর্ণ আর ঘটনাবহুল। বিলেত থেকে পাসপোর্টবিহীন হয়ে কলকাতায় ফিরতে পারা এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হসপিটাল’ নির্মাণ।

সমকাল: মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আপনার সামাজিক অথবা পারিবারিক কোনো স্বীকৃতি অথবা মূল্যায়ন আছে কিনা?

জাফরুল্লাহ চৌধুরী: অনেক বছর কোনো রকম সনদ ছিল না। পরবর্তী সময়ে সনদ ও ভাতা পাই, যা গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল ফান্ডে জমা দিই। কিডনি ডায়ালাইসিসের জন্য মুক্তিযোদ্ধা ভাতা কাজে লাগে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.