দেশের সংকট সময়ে বড় ধাক্কা অর্থনীতিতে

0
134

গেল সেপ্টেম্বরে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সে বড় পতন হয়েছে। এ মাসে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছেন ১৩৪ কোটি ৩৬ লাখ ডলারের সমপরিমাণ অর্থ, যা গত ৪১ মাসে সবচেয়ে কম। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রেমিট্যান্সে পতন দেশের সংকটকালীন অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা।

খাত-সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যাংকিং চ্যানেলের চেয়ে খোলাবাজারে ডলারের দাম বেশি হলে হুন্ডিতে লেনদেন বেড়ে যায়। আর হুন্ডি বাড়লে কমে যায় রেমিট্যান্স। গত সেপ্টেম্বরে ব্যাংকের চেয়ে খোলাবাজারে ডলারের দাম ৬ থেকে ৭ টাকা বেশি ছিল। তাই বেশি লাভের আশায় বৈধ পথে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, সেপ্টেম্বরে ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১৩৪ কোটি ৩৬ লাখ ডলার, যা আগের বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় ১৯ কোটি ৫৯ লাখ ডলার বা ১২ দশমিক ৭২ শতাংশ কম। এ ছাড়া গত আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে প্রবাসী আয় কম ২৫ কোটি ৫৮ লাখ ডলার বা প্রায় ১৬ শতাংশ। আগস্টে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ ডলার। এর আগে ২০২০ সালের এপ্রিলে রেমিট্যান্স আসে ১০৯ কোটি ডলার, যা গেল সেপ্টেম্বরের চেয়ে কম। এর পর ৪১ মাস রেমিট্যান্স আসে ১৩৪ কোটি ৩৬ লাখ ডলারের বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ‘রেমিট্যান্স কমার অন্যতম কারণ হুন্ডি। তবে তা নিয়ন্ত্রণে ইতোমধ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। রেমিট্যান্স কমার পেছনে অন্য কোনো কারণ  আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’ ব্যাংকের চেয়ে খোলাবাজারে ডলারের দাম ৬ থেকে ৭ টাকা বেশি হওয়ায় প্রবাসীরা হুন্ডির দিকে আকৃষ্ট হচ্ছেন– এমনটি মনে করছেন অনেকে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, ‘দুই জায়গায় ডলারের দামে পার্থক্য সবসময় থাকে। এ কারণে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে আড়াই শতাংশ নগদ প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সবচেয়ে বড় কথা, হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাঠানো অবৈধ। কেউ যদি নিজের অর্থ অবৈধ করে ফেলে, তাহলে কিছু করার থাকে না। এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। কারণ, বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠালে রাষ্ট্র অনেক সময় বিভিন্ন সুবিধা দেয়। কেউ অবৈধ পথ বেছে নিলে সেই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন।’

এ প্রসঙ্গে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘কাঙ্ক্ষিত হারে রপ্তানি বাড়ছে না। এদিকে কিছুদিন বকেয়া থাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে আমদানির দায় পরিশোধ বাড়ছে। এসব বিষয় একসঙ্গে হয়ে অর্থনীতির ওপর বড় চাপ তৈরি করেছে। এমন পরিস্থিতিতে রেমিট্যান্স কমে যাওয়াটা চিন্তার বিষয়। রেমিট্যান্স যদি কমতেই থাকে তাহলে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমদানি করা যাবে না। আমদানি না হলে উৎপাদন কমে যাওয়ায় কর্মসংস্থান হবে না। এতে দারিদ্র্যের হার বাড়বে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সামগ্রিক অর্থনীতিতে।’

ব্যাংকের চেয়ে খোলাবাজারে ডলারের দাম বেশি হওয়াকে রেমিট্যান্স কমার অন্যতম কারণ উল্লেখ করে ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘আমরা এ কারণেই ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছি। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক এখনও তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করেনি। তবে প্রবাসীদের ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাতে আকৃষ্ট করতে ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পাশাপাশি প্রবাসীদের উৎসাহিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের মিশনকে আরও কাজ করতে হবে।’

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘সরকার আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ার পর দেশে প্রবাসী আয়ের যে প্রবাহ তৈরি হয়েছিল, তা ধরে রাখা যায়নি। প্রতি বছর অনেক মানুষ কাজের জন্য বিদেশ যাচ্ছেন। বর্তমানে এক কোটি মানুষ বিদেশে কাজ করছেন, কিন্তু প্রবাসী আয় সেভাবে বাড়ছে না। তাই রেমিট্যান্স বাড়াতে কাঠামোগত সংস্কারের পথ খোঁজা হচ্ছে। এটি করা গেলে প্রবাসী আয় দিয়েই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভসহ অনেক সমস্যা সমাধান সম্ভব হবে।’ এজন্য সংশ্লিষ্টদের উদ্ভাবনী পরামর্শ নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

এদিকে, ডলার সংকটের এই পরিস্থিতিতে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় এবং আমদানি দায় পরিশোধে ডলারের দাম নির্ধারণ করে আসছে ব্যাংকগুলো। এখন প্রবাসী আয়ে প্রতি ডলারে ব্যাংকগুলো দিচ্ছে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। রপ্তানি বিল নগদায়নে প্রতি ডলারের বিপরীতে দেওয়া হচ্ছে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। আর আমদানি ও আন্তঃব্যাংক লেনদেনে দেওয়া হচ্ছে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। তবে কার্ব মার্কেট বা খোলাবাজারে নগদ এক ডলার কিনতে গ্রাহক‌দের গুনতে হচ্ছে ১১৭ থেকে ১১৮ টাকা। চিকিৎসা, শিক্ষা বা ভ্রমণে যারা বিদেশে যাচ্ছেন, তাদের নগদ প্রতি ডলার কিনতে খরচ করতে হচ্ছে ১১৮ টাকা পর্যন্ত।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ২ হাজার ১৬১ কোটি ৬ লাখ ডলার। আগের ২০২১-২২ অর্থবছরে আসে ২ হাজার ১০৩ কোটি ১৭ লাখ ডলার। তবে ২০২০-২১ অর্থবছরে রেমিট্যান্স আসে এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ ডলার।
দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান দুই উৎসের মধ্যে প্রবাসী আয়ে পতনের পাশাপাশি রপ্তানি আয়ও কাঙ্ক্ষিত হারে বাড়ছে না। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বরে ৪৩১ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়, যা গত বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় ১০ দশমিক ৩১ শতাংশ বেশি। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই- সেপ্টেম্বর) সামগ্রিক পণ্য রপ্তানি হয়েছে ১ হাজার ৩৬৮ কোটি ডলারের, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৯ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.