দেশি ফলের সুবাসের ঋতু

0
191
গ্রীষ্মের ফল জামরুল। রাজধানীর আগারগাঁও থেকে

গ্রীষ্মের জনজীবন কি শুধুই দহনের হাওয়া বয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা? এই হাওয়ায় তো বয়ে আসে বিচিত্র রসাল ফলের মিষ্টি সুবাস আর নানা বর্ণের ফল দেখার চোখের আনন্দও। জ্যৈষ্ঠ এখন দ্বিতীয় সপ্তাহে। প্রকৃতি এখন সজীব আর রসময়। ফলে ফলে ভরে উঠেছে প্রকৃতির বিপুল আয়োজন।

বসন্তে ফুল ফোটে, মুকুল আসে। জ্যৈষ্ঠের তাপে আর বারিধারায় পুষ্ট হয় ফল। সবই যেন গ্রীষ্মের উপহারের ডালি সাজানোর জন্য প্রকৃতির তৎপরতা। এই ঋতুর প্রায় সব ফলই মিষ্টি আর সুঘ্রাণ।

আম, কাঁঠাল, আনারস, লিচু, তরমুজ তো আছেই। এর বাইরে আছে এই মাটির ফল। বইয়ের পাতায় সেগুলোর পরিচিতি ‘অপ্রচলিত ফল’ নামে। অথচ এরাই আদি-অকৃত্রিম বাংলার। গ্রামগঞ্জে ফলে ওঠে অযত্নেই, নিজেরই গরজে। শহরের ফলের বাজারে, গলির মোড়ে এরা ঢের মেলে।

সুস্বাদু ফল সফেদা। বাগেরহাটের মোংলা থেকে
সুস্বাদু ফল সফেদা। বাগেরহাটের মোংলা থেক

সরকারের কৃষি তথ্য সার্ভিসের সূত্র বলছে, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১৩০টি ফলকে দেশি ফল হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে বুনো ফল ৬০টি। ১০টি আমাদের প্রধান ফল। বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ হচ্ছে এমন গুরুত্বপূর্ণ ফলের সংখ্যা ১৮। আজ আমরা অপ্রচলিত দেশি ফলের কথাই বলি।

এখন চলছে তালশাঁস খাওয়ার সেরা সময়। গ্রামের কচি তাল এখন শহরে চলে এসেছে। একটি তালে শাঁস থাকে সাধারণত তিনটি। কখনো বা দুটি। রাজধানীতে প্রতিটি শাঁস বিক্রি হচ্ছে ৫–১০ টাকায়। তালের শাঁসে জলীয় অংশই প্রধান। এই গরমে তালশাঁস মন জুড়িয়ে দেয়। এর পাশাপাশি মুহূর্তেই যে মনে ফিরিয়ে আনে গ্রামের জলহাওয়ার অনুভূতি, তা তো অমূল্য।

বাজারে আপেল-আম-লিচুর ঝাঁকে উঁকি দিচ্ছে এখন জামরুলও। সাদা জামরুলই বেশি। লাল শাড়ি পরা নতুন বউয়ের সাজে টকটকে লাল জামরুলও মাঝেমধ্যে চোখে পড়ে। সাদাটি বিকোচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজি, লালটি ১২০। জামরুলে আছে প্রচুর ক্যালসিয়াম ও ফাইবার। গরমে পানির চাহিদা মেটাতে জামরুল অনবদ্য।

‘পাকা জামের মধুর রসে রঙিন করি মুখ’—এই বলে কবি জসীমউদ্‌দীন কী সুখ্যাতিই না দিয়েছেন জামকে। গ্রামেগঞ্জে একসময় প্রচুর জামগাছের দেখা মিলত। এখন গাছ গেছে কমে, জামের নাম উঠে গেছে দামি ফলের তালিকায়। মঙ্গলবার সকালে যাত্রাবাড়ীর বাজারে বিক্রেতা খুদি জাতের জামের দাম হাঁকলেন প্রতি কেজি ৩০০ টাকা। বিক্রেতা জানান, ছোট আকারের জাম আসতে শুরু করেছে। মহিষে জাত বলে পরিচিত বড় মিষ্টি কালোজাম আসছে কিছুদিন বাদেই।

অড়বরই নামের ফলটি দেখতে লাগে আমলকীরই মতো, কেবল আকারে ছোট। লবণ-মরিচ মাখালে স্বাদ আসে টক এ ফলটিতে। বিকোচ্ছে ১০০ গ্রাম ৩০ টাকায়। অড়বরই আর আমলকীতে ভিটামিন সির পরিমাণ ঢের।

গাব গ্রীষ্মের দেশি ফল, কিন্তু শহরের বাজারে পেতে মেহনত করতে হয়। মিষ্টি ঘ্রাণের আরেকটি ফল গোলাপজাম। দক্ষিণবঙ্গের আরেক সুস্বাদু ফল সফেদা। আকারভেদে কেজি ১২০ থেকে ২০০ টাকা। আতাও এখন দামি ফলের কাতারে। নিউমার্কেটের পূর্ব ফটকে বা কারওয়ান বাজারে পাওয়া যাচ্ছে টক-মিষ্টি স্বাদের ডেউয়া।

গ্রীষ্মের অপ্রচলিত ফলের মধ্যে এখন পেকেছে আঁশফল, তৈকর, করমচা, হামজাম আর বৈঁচি। তৈকর প্রধানত সিলেট অঞ্চলের ফল। সারা দেশে পাওয়া যায় না। অন্য ফলগুলো ঢাকার বাজারে কম চোখে পড়ে। তবে গ্রাম বা মফস্‌সলের নদীতীরের গঞ্জে আছে বিস্তর। শরিফা, করমচা, লুকলুকি অবশ্য গ্রীষ্ম ছাড়িয়ে বর্ষা পর্যন্ত থেকে যায়।

জাম, জামরুল, অড়বরই, ডেউয়া আর তালশাঁসে চিনি খুব কম। ডায়াবেটিসের রোগীদের রসনার উপযোগী।

পাকা গাবে ভরে উঠেছে গাছটি। মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে
পাকা গাবে ভরে উঠেছে গাছটি। মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে

গ্রীষ্মের ফল মিশে আছে এ অঞ্চলের মানুষের সংস্কৃতিতে। কৃষিবিদ ও লেখক মৃত্যুঞ্জয় রায় বললেন, জ্যেষ্ঠ মাসে হয় জামাইষষ্ঠী। এর প্রধান উপকরণ নানা রকম ফল। বাঙালি সনাতন ধর্মের নারীরা এ সময় পালন করেন বিচিত্র ব্রত। এসব ব্রতের অনুষঙ্গ হরেক ফল। এই ঋতুতে বাড়িতে বাড়িতে নানা মৌসুমি খাদ্যসামগ্রী তৈরির পালা। চাঁপাইনবাবগঞ্জে পাকা আমের গোলা দিয়ে খাওয়া হয় যবের ছাতু। পাকা কাঁঠালের গোলা দিয়ে চিতই পিঠা খাওয়া হয় গাজীপুরে।

আমাদের তরুণ-তরুণীদের এসব অপ্রচলিত দেশি ফল চেনানোর জন্য উদ্যোগ দরকার। প্রতিটি ঋতুতে আয়োজন করা হোক অপ্রচলিত ফলের মেলা।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.