দেরিতে হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গুতে মৃত্যুঝুঁকি বাড়াচ্ছে

0
214
ডেঙ্গু আক্রান্ত এক ব্যক্তিকে সেবা–শুশ্রূষা দিচ্ছেন এক নার্স। গতকাল দুপুরে রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালে

ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে দেরিতে ভর্তির কারণে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। এ বছর ডেঙ্গুতে যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের ৮০ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালে ভর্তির এক থেকে তিন দিনের মধ্যে। ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া ৫০ জনের তথ্য পর্যালোচনা করে এটা জানতে পেরেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা। পর্যালোচনায় আরও দেখা গেছে, মৃতদের বড় অংশ কর্মক্ষম। আর বেশি মারা যাচ্ছেন নারীরা।

ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেশি দেখা যাচ্ছে। গতকাল রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম সারা দেশের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর যে পরিসংখ্যান দিয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে ঢাকায় নতুন ভর্তি হয়েছেন ২২৪ জন। আর ঢাকার বাইরে নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন ২৮৫ জন। এই প্রথম দেখা যাচ্ছে, ঢাকার বাইরে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি।

ঢাকা থেকে সারা দেশে ডেঙ্গু ছড়িয়েছে। ঢাকায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলার বা ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসার যে ব্যবস্থা আছে, সারা দেশে তা নেই। সুতরাং আগামী মাসগুলোতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার ঝুঁকি দেখা যাচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজীর আহমেদ

নতুন এসব তথ্য ও পরিসংখ্যান বলছে, দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে। বৃষ্টিপাত বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গু আক্রান্ত মানুষের সংখ্যাও বেড়ে যেতে পারে।

এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন বলেন, এ বছর প্রায় সারা দেশে বিরতিহীনভাবে ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে। এর অর্থ সারা দেশে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা আছে। সারা দেশের ছোট-বড় শহরগুলোতে নির্মাণকাজ চলছে, মানুষের মধ্যে পানির বোতল ব্যবহারের প্রবণতা বেড়েছে। সারা দেশে ডেঙ্গু বেড়ে যাওয়ার শর্ত আগের চেয়ে বেশি প্রবল হতে দেখা যাচ্ছে।

অনেকে জানেন না কখন রোগ পরীক্ষা করাতে হবে। পরীক্ষা না করে তাঁরা বসে থাকেন। অনেকে জ্বর হলে পাত্তা দেন না বা আমলে নেন না। অনেকে হাতুড়ে চিকিৎসক বা পাড়ার ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ কিনে খান। এসব কারণে রোগ ভালো হয় না, তাঁরা শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে আসেন। এটাই ৭২ ঘণ্টায় বেশি মৃত্যুর কারণ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক মো. নাজমুল ইসলাম

বিলম্বে হাসপাতালে ভর্তি

গতকাল ডেঙ্গুতে আরও দুজন মারা যাওয়ার তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুম। এ নিয়ে এ বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াল ৫২।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা গতকাল শেষ দুজন বাদ দিয়ে বাকি ৫০ জনের মৃত্যুর তথ্য পর্যালোচনা করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ৮০ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালে ভর্তির এক থেকে তিন দিনের মধ্যে। ১৪ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালে ভর্তির ৪ থেকে ১০ দিনের মধ্যে। বাকি ৬ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালে ভর্তির ১১ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে।

বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী, হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ

এই তথ্য বলছে, সিংহভাগ মৃত্যু হচ্ছে হাসপাতালে ভর্তির ৭২ ঘণ্টার মধ্যে। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, অনেকে জানেন না কখন রোগ পরীক্ষা করাতে হবে। পরীক্ষা না করে তাঁরা বসে থাকেন। অনেকে জ্বর হলে পাত্তা দেন না বা আমলে নেন না। অনেকে হাতুড়ে চিকিৎসক বা পাড়ার ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ কিনে খান। এসব কারণে রোগ ভালো হয় না, তাঁরা শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে আসেন। এটাই ৭২ ঘণ্টায় বেশি মৃত্যুর কারণ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, ১৯ থেকে ৫০ বছর বয়সীদের মধ্যে মৃত্যু বেশি। ৬২ শতাংশ মৃত্যু এই বয়সীদের মধ্যে। ১৯ থেকে ৫০ বছর বয়সীরা দেশের সবচেয়ে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী। তাঁরা কাজের জন্য ঘরের বাইরে থাকেন বেশি। এটাই বেশি মৃত্যুর কারণ কি না, তা নিয়ে গভীর পর্যালোচনা দরকার বলে জনস্বাস্থ্যবিদেরা মনে করছেন।

উত্তর পাওয়া যায়নি

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুমের হিসাব বলছে, শনিবার সকাল আটটা থেকে গতকাল সকাল আটটা পর্যন্ত সারা দেশে ৫০৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে এ বছর রোগী ভর্তির সংখ্যা হলো ৮ হাজার ৭৫৭। এর মধ্যে কতজন নারী ও কতজন পুরুষ, সেই তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে মৃত ৫০ জনের ৩১ জন নারী এবং ১৯ জন পুরুষ।

ডেঙ্গুতে কেন নারীর মৃত্যু বেশি হচ্ছে, তার সঠিক কারণ জানা যায়নি। জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন বলেন, এ নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার।

তবে জনস্বাস্থ্যবিদদের একটি অংশ মনে করে, একজন পুরুষ আক্রান্ত হলে পরিবার থেকে যত গুরুত্ব দেওয়া হয়, নারী সেই গুরুত্ব পান না। অন্যদিকে একজন পুরুষ রোগ পরীক্ষা করাতে বা হাসপাতালে একাই ভর্তির জন্য যেতে পারেন, নারীর ক্ষেত্রে তা কম হয়। নারী রোগীর পরিস্থিতি বেশ খারাপ হওয়ার পরই পরিবার হাসপাতালে ভর্তির ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। তখন পরিস্থিতি অনেকটাই খারাপ হয়ে পড়ে।

ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে

সব বয়সী মানুষ ডেঙ্গুতে মারা যাচ্ছে। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, ১৯ থেকে ৫০ বছর বয়সীদের মধ্যে মৃত্যু বেশি। ৬২ শতাংশ মৃত্যু এই বয়সীদের মধ্যে। ১৯ থেকে ৫০ বছর বয়সীরা দেশের সবচেয়ে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী। তাঁরা কাজের জন্য ঘরের বাইরে থাকেন বেশি। এটাই বেশি মৃত্যুর কারণ কি না, তা নিয়ে গভীর পর্যালোচনা দরকার বলে জনস্বাস্থ্যবিদেরা মনে করছেন।

ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন শিশুও ডেঙ্গুতে মারা গেছে। ২৯ শতাংশ মৃত্যু হয়েছে, যাদের বয়স ১ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। বাকি ৯ শতাংশের বয়স ৫০ বছর বা তার বেশি।

যে ১২ জেলায় ডেঙ্গু শনাক্ত হয়নি তার মধ্যে আছে: গোপালগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, নাটোর, জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ, রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড়, ঝালকাঠি, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ।

প্রায় সারা দেশে ডেঙ্গু

গত কয়েক বছরে ঢাকা শহরেই ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি দেখা গেছে। এই বছরের এখন পর্যন্ত ঢাকা শহরেই বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হতে দেখা গেছে। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুমের সর্বশেষ তথ্যে দেখা গেল, ঢাকার বাইরে বেশি রোগী ভর্তি হয়েছেন।

দেশের অন্যান্য মহানগর বা বড় বড় শহরের চেয়ে এডিস মশা নিধন নিয়ে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে বেশি আলোচনা হতে দেখা যায়। বিভিন্ন কর্মতৎপরতাও দেখা যায়। সেই তুলনায় ছোট ছোট শহর বা উপজেলা পর্যায়ে কোনো কাজ চোখে পড়ে না। যে কারণে সারা দেশেই ডেঙ্গু বাড়ছে।

গতকাল পর্যন্ত ৫২ জেলায় ডেঙ্গু শনাক্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুম। যে ১২ জেলায় ডেঙ্গু শনাক্ত হয়নি তার মধ্যে আছে: গোপালগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, নাটোর, জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ, রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড়, ঝালকাঠি, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ।

সাধারণত পাহাড়ি এলাকায় ডেঙ্গু কম দেখা যায়। এ বছর পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা অর্থাৎ খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙামাটি জেলায় ইতিমধ্যে ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। অন্যদিকে ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু রোগী সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে চট্টগ্রাম বিভাগে। এ পর্যন্ত এই বিভাগের ১১টি জেলায় ৯৩৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজীর আহমেদ বলেন, ঢাকা থেকে সারা দেশে ডেঙ্গু ছড়িয়েছে। ঢাকায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলার বা ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসার যে ব্যবস্থা আছে, সারা দেশে তা নেই। সুতরাং আগামী মাসগুলোতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার ঝুঁকি দেখা যাচ্ছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.