মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি: ভিয়েতনামের আছে ৪০ দেশের সঙ্গে, বাংলাদেশের একটিও নেই

0
125
চট্টগ্রাম বন্দর

স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার পর উন্নত দেশগুলো থেকে আর বাণিজ্য সুবিধা পাবে না বাংলাদেশ। রপ্তানি বৃদ্ধির ব্যাপার তো আছেই, বিদ্যমান রপ্তানির ধারা বজায় রাখতেও দরকার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করা। রপ্তানিকারক ও বিশেষজ্ঞরা জোর দিয়েই বলছেন এ কথা।

বাণিজ্য বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এফটিএ করতে না পারলে অন্তত অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) হলেও করা দরকার। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বিশ্বের কোনো দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত এফটি করতে পারেনি। প্রতিবেশী ছোট অর্থনীতির দেশ ভুটানের সঙ্গে শুধু বাংলাদেশের পিটিএ আছে একটি এবং এটিই একমাত্র।

পোশাক রপ্তানিতে ভিয়েতনাম হচ্ছে বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশ। অথচ দেশটির সঙ্গে এফটিএ আছে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) ২৭ দেশসহ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, ভারত, চিলি, চীন, সিঙ্গাপুর, ব্রুনেই, বেলারুশ, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তানসহ ৪০টির মতো দেশের।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে গত মাসে অনুষ্ঠিত রপ্তানিসংক্রান্ত জাতীয় কমিটির বৈঠকে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এফটিএ বা পিটিএ করার গুরুত্ব তুলে ধরেন বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ। ২০২১ সালের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউসের নেতৃত্বে এ জাতীয় কমিটি গঠিত হয়।

শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা পেতে জাপান, কানাডা, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন ইত্যাদি দেশ এবং আঞ্চলিক সমন্বিত অর্থনৈতিক সহযোগিতা চুক্তি (আরসিএপি), মার্কাসোরভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন বাণিজ্যসচিব। মার্কাসোরভুক্ত দেশগুলো হলো ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, প্যারাগুয়ে ও উরুগুয়ে।

এফটিএ করার পক্ষে এক দশকে সরকারের পক্ষ থেকে বহু বক্তব্য শোনা গেছে। বাস্তবে অগ্রগতি তেমন কিছুই হয়নি। সাত বছর আগে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ তুরস্কের সঙ্গে এফটিএ করা নিয়ে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘তুরস্কের সঙ্গে এফটিএ করার প্রক্রিয়া চলছে। ১৮টি দেশের সঙ্গে তুরস্কের এফটিএ রয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে তা না করার কোনো কারণ নেই।’ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এফটিএ করার এখনকার তালিকায় তুরস্কের নামই নেই।

বর্তমান বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিও মাঝেমধ্যে এফটিএ করার বিষয়ে কথা বলে আসছেন। গত বছরের জানুয়ারিতে টিপু মুনশি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘মালয়েশিয়ার সঙ্গে এফটিএ স্বাক্ষরের বিষয়ে উভয় দেশের আলোচনা অনেক দূর এগিয়ে গেছে।’ আর গত নভেম্বরে তিনি বলেন, ‘সিঙ্গাপুরের সঙ্গে এফটিএ স্বাক্ষরের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শিগগির দর-কষাকষি শুরু হবে।’

চার মাস আগে গত ডিসেম্বরে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি একটু বিশদভাবেই এফটিএ নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, জাপানের সঙ্গে এফটিএ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে কথা চলছে। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে প্রাথমিক চুক্তি করা হয়েছে। নেপালের সঙ্গে চুক্তির কাগজপত্র তৈরি হয়ে আছে। শ্রীলঙ্কার সঙ্গেও কথা চলছে। আর আপাতত ভারত ও চীনের সঙ্গে করা হচ্ছে সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি (সিইপিএ)।

এফটিএর হালনাগাদ অবস্থা জানতে চাইলে বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ‘আমাদের এফটিএ করা দরকার। কিন্তু যাদের সঙ্গে আমরা করতে চাই, তাদেরও এ ব্যাপারে আগ্রহ থাকতে হবে। আবার অনেকে আছে বাংলাদেশের সঙ্গে এফটিএ করতে চায়, তবে বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে রক্ষণশীল। বাংলাদেশের স্বার্থ সুরক্ষার বিষয় নিশ্চিত না হলে তো এফটিএ করেও কোনো লাভ নেই। তবে এখন বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে বেশ এগিয়েছি।’

এফটিএর সম্ভাব্য দেশ কতটি

এফটিএ করার জন্য সম্প্রতি ১০টি দেশের একটি তালিকা করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। দেশগুলো হচ্ছে সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, চীন ও মালয়েশিয়া। তালিকা করার আগে অবশ্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের মত নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

এ ছাড়া ব্রাজিল, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, আর্জেন্টিনা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া ও সৌদি আরবের নামও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তালিকায় রয়েছে। অর্থ বিভাগ এক চিঠিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানায়, এফটিএর মাধ্যমে বাংলাদেশের বাণিজ্য ব্যবধান কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। কারণ, এফটিএ পণ্য রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে।

চাইলেই কারও সঙ্গে এফটিএ করা যায় না, অপর পক্ষের ইচ্ছা থাকতে হয়, সেটিকে ভিত্তি ধরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এফটিএ করার জন্য সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের দায়িত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকে (বিটিটিসি)। সংস্থাটি তা করেও দিয়েছে।

পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম ইতিমধ্যে ইইউসহ ৪০ দেশের সঙ্গে এফটিএ করে ফেলেছে বলে জানা গেছে।

বিটিটিসির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, ‘বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যখনই এফটিএ করার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য কোনো দেশের কথা বলে, আমরা গবেষণা করে তা পাঠিয়ে দিই। সিদ্ধান্ত নেওয়ার মূল এখতিয়ার সরকারের।’

এফটিএ কেন জরুরি

এলডিসি থেকে বের হওয়ার পর নানামুখী চ্যালেঞ্জে পড়বে বাংলাদেশ—এ কথা রপ্তানিসংক্রান্ত জাতীয় কমিটির সাম্প্রতিক প্রতিবেদনেও তুলে ধরা হয়েছে। বড় চ্যালেঞ্জ হবে রপ্তানি আয় ধরে রাখা। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ২০২০ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর রপ্তানি আয় কমবে ১৪ দশমিক ২৮ শতাংশ। অর্থাৎ উচ্চ শুল্কে রপ্তানি করতে হবে বলে দেশের আয় কমতে পারে কমপক্ষে ৫১ হাজার কোটি টাকা।

তবে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর নতুন সম্ভাবনার দুয়ারও খুলতে পারে। যেমন এলডিসি থেকে উত্তরণ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে নতুন বার্তা দেবে। এতে বাংলাদেশের নতুন ভাবমূর্তি ও ব্র্যান্ডিং হবে, যা বৈশ্বিক নীতিনির্ধারকদের কাছে ইতিবাচক বার্তা দেবে ও বিনিয়োগ আকর্ষণে ভূমিকা রাখবে।

এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ এত দিন বহির্বিশ্ব থেকে যেসব শুল্কসুবিধা পেয়ে আসছিল, ২০২৬ সালের পর থেকে অন্য সব এলডিসিভুক্ত দেশ বরং সেগুলো বাংলাদেশের কাছে দাবি করবে। আবার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য করতে গেলে ডব্লিউটিওর যেসব বিধিবিধান মানতে হয়, এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশকে এত দিন সেগুলো কম মানলেও উন্নয়নশীল দেশ হয়ে যাওয়া মাত্রই পুরোপুরি মানতে হবে।

রপ্তানি বাণিজ্যকে উৎসাহিত করতে বাংলাদেশ বর্তমানে ৪৩টি পণ্যে রপ্তানি প্রণোদনা বা নগদ সহায়তা দিচ্ছে। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর পণ্য রপ্তানিতে নগদ সহায়তা আর দেওয়া যাবে না। শুল্ক হারও যৌক্তিক করতে হবে। বিশ্ব কাস্টমস সংস্থা (ডব্লিওসিও) ও ডব্লিউটিওর বিধিবিধান মেনে বাংলাদেশকে সব শুল্কহার নামিয়ে আনতে হবে যৌক্তিক পর্যায়ে।

জানা গেছে, আমদানি শুল্ক থেকে বর্তমানে ৩৪ শতাংশ রাজস্ব আসে বাংলাদেশের। তা চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৪ শতাংশ, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২২ শতাংশ, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ২০ শতাংশ এবং এর পরের অর্থবছরে ১৮ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে।

সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘এফটিএ করার ব্যাপারে বাংলাদেশকে আরও আগে থেকেই তৎপর থাকা উচিত ছিল। কিন্তু প্রায় সব কাজই যেন এখানে ধীরগতিতে চলে। তবু ভালো যে এখন একটু তৎপরতা চোখে পড়ছে। বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে।’

মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, ‘এফটিএতে শুধু বাণিজ্যসুবিধার কথা চিন্তা করলেই হবে না। এত বাণিজ্য করব, আমাদের এত পণ্য কি আছে? বাণিজ্য, যোগাযোগ ও বিনিয়োগের ত্রিমাত্রিক সংমিশ্রণ হতে হবে এফটিএর দর্শন—এ কথাটি আমাদের মাথায় রাখতে হবে।’

ফখরুল ইসলাম

ঢাকা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.