তিনটি পরীক্ষা করে মশক নিধনের ওষুধ কেনার পরও বিপাকে পড়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। তারা বুঝতে পারছে না এখন কী করণীয়। এ জন্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হলেও তারা এ পর্যন্ত কোনো সুপারিশ দিতে পারেনি। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে সুপারিশ দেবে বলে জানা গেছে। তবে ওই কমিটির সদস্যরাই বুঝতে পারছেন না কী সুপারিশ দেওয়া উচিত।
জানা গেছে, সুপারিশে বিদ্যমান ওষুধের পরিবর্তে নতুন ওষুধ কেনার মতামত থাকতে পারে। সুপারিশ গ্রহণ করা হলেও নতুন ওষুধ আসতে অন্তত আরও ১৫ দিন সময় লাগবে। তার আগ পর্যন্ত বিদ্যমান ওষুধই ব্যবহার করা হবে। এতদিন যে ওষুধ ব্যবহার করা হতো তার মাত্রা বাড়িয়ে দেওয়া হবে। পাশাপাশি সপ্তাহে এক দিনের পরিবর্তে দু’দিন স্প্রে করা হবে। ইতিমধ্যে সেভাবেই কার্যক্রম শুরু করেছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও মশা গবেষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সারা বিশ্বেই মশক নিধনে লার্ভিসাইড ও অ্যাডাল্টিসাইড ওষুধ ব্যবহার করা হয়। লার্ভিসাইডের মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন না উঠলেও অ্যাডাল্টিসাইডের মান নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। আন্তর্জাতিক উদারাময় গবেষণা কেন্দ্রের (আইসিডিডিআর’বি) এক গবেষণায় বলা হয়েছে দুই সিটি করপোরেশনের ব্যবহূত অ্যাডাল্টিসাইডে মশা মরছে না। দীর্ঘদিন একই ওষুধ ব্যবহারের কারণে মশার প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়েছে। কিন্তু এই গবেষণার ফলাফলের সঙ্গে অন্য গবেষকরা একমত হতে পারছেন না।
জানা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) পূর্ণ বয়স্ক মশা মারতে এক লিটার কেরোসিনের সঙ্গে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ পারমেথ্রিন, শূন্য দশমিক ২ শতাংশ টেট্রামেথ্রিন এবং শূন্য দশমিক ১ শতাংশ এস বায়ো অ্যালাথ্রিন যুক্ত করে ফগার মেশিন দিয়ে ছিটিয়ে দেয় উড়ন্ত মশা মারার জন্য। পাশাপাশি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এক লিটার কেরোসিনের সঙ্গে শূন্য দশমিক ২ শতাংশ পারমেথ্রিন, শূন্য দশমিক ২ শতাংশ টেট্রামেথ্রিন এবং শূন্য দশমিক ২ শতাংশ এস বায়ো অ্যালেথ্রিন মিশিয়ে স্প্রে করে। পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষায় জন্য এটাই নিয়ম। তবে মশক নিধনে বেশি কার্যকর ফল পাওয়ার জন্য ওষুধের মাত্রা সর্বোচ্চ বাড়িয়ে ব্যবহার করছে ডিএনসিসি। এর চেয়ে বেশি বাড়ালে সেটা পরিবেশ-প্রতিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। নগরবাসী মুখোমুখি হতে পারেন শারীরিক সমস্যার।
তবে মশা নিধনে নতুন ওষুধ আনার জন্যও সময়ের প্রয়োজন। আবার নতুন কী ওষুধ আনা হবে, সে ব্যাপারেও একমত হতে পারছেন না বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, নতুন ওষুধ আনার আগে সেটাও পরীক্ষা করা প্রয়োজন। পরীক্ষা না করে তাড়াহুড়া করে একটা ওষুধ এনেই ব্যবহার করলে তাতে বড় ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টি হতে পারে। তখন হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা আছে। ততক্ষণ পর্যন্ত বিদ্যমান ওষুধই ব্যবহার করা হবে।
জানা গেছে, বর্তমানে চীন থেকে আমদানি করা ওষুধ ব্যবহার করছে দুই সিটি করপোরেশন। এর মধ্যে ডিএনসিসি উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ও ডিএসসিসি নৌবাহিনীর ডক ইয়ার্ডের মাধ্যমে ওষুধ কেনে। ওষুধ গ্রহণের আগে মাঠ পর্যায়ে কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় ৯০ শতাংশর বেশি মশা মারা গেলে সেটাকে পরীক্ষার জন্য খামারবাড়ি ও মহাখালীর রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর-এ পাঠানো হয়। এ দুটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর ওষুধ গ্রহণ করে সিটি করপোরেশন। গত বছর এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়ায় লিমিট এগ্রো লিমিটেডের সরবরাহ করা তিন কোটি টাকার ওষুধ বাতিল করে ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করেছিলেন ডিএনসিসির সাবেক ভারপ্রাপ্ত মেয়র জামাল মোস্তফা। সমকালকে তিনি বলেন, ওই সময় প্রতিষ্ঠানটি ভেজাল ওষুধ গছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। ধরা না পড়লে এবার ডেঙ্গুর অবস্থা আরও খারাপ হতো। এখন তো কমিটি হয়েছে। মেয়র তো এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ না। যারা বিশেষজ্ঞ তাদের পরামর্শেই কাজ করতে হবে।
ডিএসসিসির একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তারাও মাঠ পর্যায়ে কিছু পরীক্ষা করেছেন। তাতে দেখা যায় একই ওষুধ ধানমণ্ডির মশা মারতে কার্যকর হলেও অন্য এলাকায় ব্যর্থ হচ্ছে। এলাকাভেদে মশার রাসায়নিক প্রতিরোধের ক্ষমতাও ভিন্ন বলে তার ধারণা।
মশক নিধনে করণীয় নির্ধারণে গঠিত কমিটির সদস্য সিডিসির (সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল) ডেপুটি প্রজেক্ট ম্যানেজার সানিয়া তহমিনা বলেন, মশার বিষয়ে তারা অনেক ধরনের কাজ করছেন। কমিটির একটি মিটিং হয়েছে। শিগগিরই আরেকটি বৈঠক হবে। রিপোর্ট দেওয়ার আগে তারা অনেক বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছেন। অনেক কিছু পর্যবেক্ষণ করছেন। কারণ এমন কোনো সুপারিশ করা যাবে না যেটা জনস্বাস্থ্যের জন্য আরও বড় হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোমিনুর রহমান মামুন বলেন, মশক নিধনের ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বাংলাদেশে যে ওষুধ ব্যবহার করা হয়, সেই একই ওষুধ ব্যবহার করে থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, মিয়ানমারসহ আরও কিছু দেশ। এসব দেশের শহরগুলো আমাদের চেয়ে অনেক পরিচ্ছন্ন। তার পরও সেখানে মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন। আমাদের চেয়ে বেশি লোক মারা যাচ্ছেন। তাহলে কি বলা যায়, বাংলাদেশের ওষুধ অকার্যকর? এটা বলার আগে আরও গবেষণা প্রয়োজন। এ জন্যই তাড়াহুড়া করে আরেকটি ওষুধ কিনেই ব্যবহার করার যৌক্তিকতা নিয়ে তারা ভাবছেন।