দুই পক্ষের দ্বন্দ্বের জেরে ভবনে অব্যবস্থাপনা, ৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র

0
196
২০১৯ সালের ২৮ মার্চ বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুন লাগে

ফারুক জমির মূল মালিক। বিএনপি নেতা তাজভীরুল ভবন পরিচালনা কমিটির সভাপতি। বাকি ছয়জন ভবন পরিচালনা কমিটির সদস্য। ফারুক ও তাজভীরুল নিজেদের নির্দোষ দাবি করেছেন।

ভবন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান রূপায়ণ গ্রুপের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী খানকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য অভিযোগপত্রে আবেদন করেছে ডিবি।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক সমীর চন্দ্র সূত্রধর  বলেন, ‘এফআর টাওয়ারে আগুনে এতগুলো মানুষের মৃত্যুর পেছনে অনেকগুলো কারণ ছিল। তার মধ্যে অন্যতম কারণ হলো—ভবনের জমির মালিক ও ভবন পরিচালনা কমিটির সদস্যদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব। ভবনে অগ্নিপ্রতিরোধক ব্যবস্থা ছিল না। ভবনের দুটি সিঁড়ির একটি সার্বক্ষণিক বন্ধ থাকত।’

২০১৯ সালের ২৮ মার্চ এফআর টাওয়ারে আগুন লাগে। এই ঘটনায় ২৭ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন অন্তত ৭৫ জন। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে বনানী থানায় মামলা হয়। মামলার বাদী বনানী থানা-পুলিশ। মামলায় ফারুক, তাজভীরুল ও লিয়াকতকে আসামি করা হয়।

দুই কমিটি

মামলার তদন্ত সংস্থা ডিবি বলছে, ১৯৮৯ সালে তৎকালীন ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (ডিআইটি) থেকে ৯৯ বছরের জন্য আট কাঠা জমির ইজারা পান ফারুক। ১৮ তলা ভবন তৈরির জন্য তিনি শেখ আজহার হোসেন নামের এক আবাসন ব্যবসায়ীর সঙ্গে চুক্তি করেন। আজহারের আর্থিক অক্ষমতার কারণে ১৯৯৯ সালে চুক্তিটি বাতিল হয়। পরে ভবন নির্মাণের জন্য রূপায়ণ গ্রুপের সঙ্গে চুক্তি করেন ফারুক। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অনুমোদন নিয়ে ভবনটি ২৩ তলা পর্যন্ত করা হয়।

ডিবির অভিযোগপত্রের তথ্য অনুযায়ী, রূপায়ণ গ্রুপ জমির মালিক ফারুককে তাঁর প্রাপ্য ফ্লোর–ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেয়। রূপায়ণ গ্রুপ তার ফ্লোর–ফ্ল্যাটগুলো বিভিন্ন ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে। কাসেম ড্রাইসেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাজভীরুল রূপায়ণের কাছ থেকে ২১, ২২ ও ২৩ তলা কিনে নেন। ভবন পরিচালনার জন্য ফারুককে সভাপতি করে ৯ সদস্যের একটি অ্যাডহক কমিটি করা হয়। অন্যদিকে তাজভীরুলকে সভাপতি করে সাত সদস্যের আরেকটি অ্যাডহক কমিটি হয়।

দ্বন্দ্বের জেরে নিরাপত্তায় ঘাটতি

ডিবির অভিযোগপত্রে বলা হয়, ভবন পরিচালনার ক্ষেত্রে ফারুক ও তাজভীরুল নিজ নিজ বলয় তৈরি করেন। উভয়ে নিজ নিজ কমিটি দিয়ে ভবন পরিচালনা করে আসছিলেন। দুজনের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে দ্বন্দ্ব চলছিল। দ্বন্দ্বের জেরে একাধিক মামলাও হয়। দুজনের দ্বন্দ্বের কারণে ভবনে কোনো ধরনের পরিচর্যা ছিল না। এতে ভবনের সামগ্রিক নিরাপত্তায় গুরুতর ঘাটতি দেখা হয়। ভবনে প্রশিক্ষিত জনবল রাখার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা রাখা হয়নি। ফ্ল্যাটের মালিকেরা ইচ্ছেমতো ভবনের ফাঁকা জায়গায় বিভিন্ন জিনিসপত্র রেখে দেন। তাঁরা ভবনের ‘ফায়ার এক্সিট’ বন্ধ করে দেন। ‘ফায়ার এক্সিট’ বন্ধ থাকায় জরুরি নির্গমনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। ভবনের প্রথম থেকে ২৩ তলা পর্যন্ত অগ্নিপ্রতিরোধক কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ভবনে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র, হস পাইপসহ বিভিন্ন সরঞ্জামের মেয়াদ ছিল না। ভবনে ফায়ার প্রোটেকশন ব্যবস্থা কার্যকর ছিল না। ভবনের ফায়ার অ্যালার্ম সচল ছিল না। ভবনে কোনো প্রকার ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা ছিল না। ভবনের দুটি সিঁড়ির একটি সার্বক্ষণিক বন্ধ করে রাখা হতো। দাহ্য পদার্থ দিয়ে ভবনের অনেক ফ্ল্যাট সজ্জিত করা হয়েছিল। ভবনে অগ্নি দুর্ঘটনা সম্পর্কে কেউ সচেতন ছিলেন না। এসব বিষয় দেখার দায়িত্ব ছিল ভবন পরিচালনা কমিটির। কিন্তু তারা তা দেখেনি। ফারুক ও তাজভীরুলের দ্বন্দ্বের কারণে ভবনের নিরাপত্তার কোনো ধরনের পদক্ষেপ না নেওয়ায় অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার সঙ্গে ভবন পরিচালনা কমিটির সবাই জড়িত।

আটতলায় আগুনের সূত্রপাত

অভিযোগপত্রের তথ্য অনুযায়ী, ভবনের অষ্টম তলার মালিক সেলিম উল্লাহ। তিনি অধিক দাহ্য বস্তু দিয়ে অষ্টম তলার কক্ষগুলো সাজিয়েছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে এই তলায় বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম এলোমেলোভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল।

সঠিক পরিচর্যা না থাকায় বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে অষ্টম তলার শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রে আগুন ধরে যায়। এই আগুন দ্রুত অষ্টমতলার বিভিন্ন কক্ষে ছড়িয়ে পড়ে। পরে আগুন ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। ভবনে গ্লাস নল ব্যবহার করায় অগ্নিকাণ্ডের ফলে তাপমাত্রা অনেক বেড়ে যায়।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.