দর কড়াকড়ির পর পতন রেমিট্যান্সে

0
165
ডলার

লন্ডনপ্রবাসী ইমরান হোসেন তিন মাস অন্তর ১ হাজার ২০০ ব্রিটিশ পাউন্ড দেশে পাঠাতেন। বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকার একটি অংশ ব্যয় হতো পরিবারের খরচ মেটাতে। আরেকটি অংশ জমা রাখতেন ব্যাংকে। তবে আপাতত আর বিদেশ থেকে অর্থ না পাঠিয়ে দেশে জমানো টাকা থেকে পরিবারের খরচ মেটাচ্ছেন। দুটি কারণে তিনি এমন কৌশল নিয়েছেন।

তাঁর ধারণা, বৈদেশিক মুদ্রার দর আরও বাড়বে। আবার লন্ডনের ব্যাংকে অর্থ রেখেও এখন ভালো মুনাফা পাচ্ছেন।
ইমরান হোসেনের রেমিট্যান্সের সুবিধাভোগীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক যোগাযোগ করে জানতে পেরেছে, লন্ডনে তিন মাস মেয়াদে অর্থ রেখে ৬ শতাংশ হারে সুদ পাওয়া যাচ্ছে। দেশে ভালো ব্যাংকে আমানতের সুদহার এ রকমই। আবার বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে প্রতিনিয়ত টাকা দুর্বল হচ্ছে। ফলে যত দেরিতে অর্থ পাঠাবেন, দর মিলবে তত বেশি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রবাসী আয়ের চলতি মাসের চিত্র দেখলেও এর সত্যতা মেলে। গত ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত মাত্র ১৪৯ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। মাসের প্রথম দিকে বিনিময় হারে শিথিলতা ছিল। যে কারণে প্রথম ১০ দিনে ৭৯ কোটি ৪৪ লাখ ডলার তথা দৈনিক গড়ে ৭ কোটি ৯৪ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার আলোকে ৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় এবিবি ও বাফেদা বৈঠক করে জানিয়ে দেয়, নির্ধারিত দরেই ডলার কিনতে হবে। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঢাকায় চারটি টিম গঠন করে বিভিন্ন ব্যাংকে পরিদর্শনে পাঠায়। ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন ব্যাংকে পরিদর্শন চলছে। এ পরিস্থিতিতে গত ১১ নভেম্বর থেকে পরের ১৪ দিনে এসেছে মাত্র ৬৯ কোটি ৮৫ লাখ ডলার, যা দৈনিক ৪ কোটি ৯৯ লাখ ডলার। এর মানে, দর নিয়ে কড়াকড়ির পরই প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩ কোটি ডলার কম এসেছে। গত মাসে ১৯৮ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স আসে।

বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, প্রবাসীরা যেখানে দর বেশি পাবেন, সেখানে অর্থ পাঠাবেন– এটাই স্বাভাবিক। বর্তমান পরিস্থিতিতে ডলারের দরে শিথিলতা দেখালেই রেমিট্যান্স বাড়ছে। আবার কড়াকড়ি করলে কমছে। তিনি বলেন, প্রতি মাসে ২ বিলিয়ন ডলারের মতো রেমিট্যান্স আসে। তবে গত সেপ্টেম্বরে কড়াকড়ির কারণে রেমিট্যান্স কমে ১৩৩ কোটি ডলারে নেমেছিল। এখন আবার কমছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রবাসীদের পাশাপাশি বিদেশি অনেক এক্সচেঞ্জ হাউস এবং রপ্তানিকারক ডলার ধরে রাখছেন। দর বেশি দিলেই তারা ডলার ছাড়ছেন। আবার কমালেই ধরে রাখছেন। ব্যাংকগুলোতে এখন ডলারের ব্যাপক চাহিদা। যে কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শিথিলতা দেখালেই ব্যাংকগুলো বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে বাড়তি দরে ডলার কিনছে।

জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের পাশাপাশি ঢাকার বাইরে বিভিন্ন ব্যাংকে রেমিট্যান্স বিষয়ে পরিদর্শন চলছে। অনেক ক্ষেত্রে রেমিট্যান্সের সুবিধাভোগীকে টেলিফোন করে বিভিন্ন তথ্য জানতে চাওয়া হচ্ছে। এসব ঘটনা ব্যাংকার ও সুবিধাভোগীর মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি করছে। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দল সব ব্যাংকেই যে পরিদর্শনে যাচ্ছে, তেমন নয়। অনেক ক্ষেত্রে দেশের প্রথম সারির কিছু ব্যাংকে বারবার পরিদর্শনে পাঠানো হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ডলারের দর নিয়ে বিভ্রান্তি আছে। এ কারণে অনেকে মনে করছেন, দর আরও বাড়বে এবং ডলার ধরে রাখছেন। তিনি মনে করেন, সামগ্রিকভাবে ডলার সংকট কাটাতে হলে বিদেশি বিনিয়োগ এবং সহজ শর্তের বিদেশি ঋণ বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে।

ব্যাংকাররা জানান, ডলার বাজার নিয়ন্ত্রণে আমদানিতে কড়াকড়ি, এলসির বিপরীতে শতভাগ পর্যন্ত মার্জিনের বিধান, শুল্ক বাড়ানোসহ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে করে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবে আগের ঘাটতি থেকে উদ্বৃত্ত হয়েছে। তবে আর্থিক হিসাবে বড়  ঘাটতি রয়েছে। সংকট কাটাতে গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর থেকে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকের সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) এবং ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) মাধ্যমে ডলার বেচাকেনার একটি দর ঘোষণা করাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ঘোষিত দর  কার্যকর থাকছে না। বর্তমানে বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউজ থেকে ১১৮ থেকে ১২২ টাকা পর্যন্ত দরে ডলার কিনছে কিছু ব্যাংক। চলতি মাসের শুরুর দিকে যেখানে ডলারের দর উঠেছিল ১২৪ টাকা পর্যন্ত। অথচ বর্তমানে ঘোষিত দর ১১০ টাকা।

ধারাবাহিকভাবে কমছে রিজার্ভ
বিভিন্ন উপায়ে ডলারের খরচ কমানোর উদ্যোগের পরও সংকট না কমে বাড়ছে। কোনো ব্যাংক যেন দেশের বাইরে খেলাপি হয়ে না পড়ে, সেজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারি আমদানির বিপরীতে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে। ২০২১ সালের আগস্টে সংকট শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ২৬ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে এখন ১৯ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। এখান থেকে এক বছরের দায় বাদ দিয়ে আইএমএফ নিট রিজার্ভের হিসাব করে। সে অনুযায়ী নিট রিজার্ভ এখন ১৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে। ২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভ  ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ওপরে ছিল।

আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের প্রথম কিস্তি পেয়েছে বাংলাদেশ। আগামী ডিসেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া সংকট কাটাতে বিভিন্ন সংস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার চেষ্টা করছে সরকার। যদিও পরিস্থিতির উন্নতির তেমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.