তাইওয়ানের প্রতিষ্ঠান ‘তৈরি করেনি’, তাহলে পেজারগুলো এল কোথা থেকে

0
44
বিস্ফোরিত একটি পেজার। লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর কাছে থাকা এ রকম পাঁচ হাজার পেজার মঙ্গলবার একই সময়ে বিস্ফোরিত হয়েছে, ছবি: এএফপি

লেবাননে পেজার (যোগাযোগের যন্ত্র) বিস্ফোরণের পর এই যন্ত্রের নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে নানা প্রশ্ন উঠছে। আজ বুধবার সকাল পর্যন্ত তাইওয়ানের যে প্রতিষ্ঠানের নাম অনেকেই জানত না, বিস্ফোরণের সে ঘটনার পর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে প্রতিষ্ঠানটি।

স্থানীয় সময় মঙ্গলবার লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর সদস্যদের নিশানা করে পেজার হামলার এ ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত ১২ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় তিন হাজার মানুষ। হামলার এ ঘটনার পর মধ্যপ্রাচ্যে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা ও তোলপাড় শুরু হয়েছে।

পেজার বিস্ফোরণের ঘটনায় উদ্ভূত সংকটের মধ্যে পড়ে তাইওয়ানের প্রতিষ্ঠান গোল্ড অ্যাপোলোর প্রতিষ্ঠাতা হসু চিং–কুয়াং দাবি করেছেন, পেজার হামলার এ ঘটনায় তাঁদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।

গোল্ড অ্যাপোলোর প্রতিষ্ঠাতার দাবি, এসব পেজার তৈরি করেছে বিএসি কনসাল্টিং নামের হাঙ্গেরির একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটিকে গোল্ড অ্যাপোলোর ট্রেডমার্ক ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এ অনুমতি থাকায় প্রতিষ্ঠানটি নিজেরা তৈরি করলেও পেজারে গোল্ড অ্যাপোলোর নাম ব্যবহার করেছে। বিবিসির পক্ষ থেকে বিএসি কনসাল্টিংয়ের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করে সাড়া পাওয়া যায়নি।

গোল্ড অ্যাপোলোর কার্যালয়ের বাইরে হসু চিং-কুয়াং আজ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আপনি লেবানন থেকে আসা ছবিগুলো দেখুন। সেসবে (পেজারে) তাইওয়ানে তৈরি এমন কোনো চিহ্ন দেখতে পাবেন না। আমরা এসব পেজার তৈরি করিনি।’

তাওয়ানের রাজধানী তাইপের উপকণ্ঠে গোল্ড অ্যাপোলোর কার্যালয়। আজ অন্য অনেক প্রতিষ্ঠানের মতো প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়ে গিয়ে ব্যতিক্রম কিছু দেখা যায়নি। কার্যালয়ের মূল ফটকে শুধু দুজন পুলিশ সদস্যকে দেখা গেল।

গোল্ড অ্যাপোলোর কার্যালয়ের দেয়ালে প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন পণ্যের পোস্টার সাঁটানো। এসব পণ্যের মধ্যে ছোট একটি বাক্সের মতো প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি যন্ত্র, যার মধ্যে ধূসররঙা ছোট একটি এলসিডি পর্দাও রয়েছে। এসবই হচ্ছে পেজার।

আজ সকাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে অন্যান্য পণ্যের মতো পেজারের জন্যও একটি পৃথক পৃষ্ঠা (পেজ) ছিল। কিন্তু লেবাননে হামলার ঘটনার পর বিস্ফোরিত পেজারগুলোর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গোল্ড অ্যাপোলোর নাম আলোচনায় আসার পর থেকে প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে প্রবেশ করা যাচ্ছে না।

লেবাননে হামলায় ব্যবহৃত পেজারগুলো বিএসি কনসাল্টিংয়ের তৈরি বলে জানিয়েছেন গোল্ড অ্যাপোলোর প্রতিষ্ঠাতা হসু চিং-কুয়াং। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, তিন বছর আগে তাঁর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছিল বিএসি কনসাল্টিং।

পেজার বিস্ফোরণে গুরুতর আহত এক ব্যক্তির চিকিৎসা চলছে হাসপাতালে
পেজার বিস্ফোরণে গুরুতর আহত এক ব্যক্তির চিকিৎসা চলছে হাসপাতালে, ছবি: রয়টার্স

হসু চিং-কুয়াং বলেন, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিক্রির জন্য গোল্ড অ্যাপোলোর কাছ থেকে প্রথমে পেজার কিনতে চেয়েছিল বিএসি কনসাল্টিং। কিন্তু প্রায় এক বছর পর প্রতিষ্ঠানটি একটি নতুন প্রস্তাব দেয়। বিএসি কনসাল্টিং জানায়, গোল্ড অ্যাপোলো থেকে সরাসরি পেজার না কিনে তারা নিজেরাই তৈরি করবে; কিন্তু পেজারগুলো তৈরি হবে গোল্ড অ্যাপোলোর নামে।

বিএসি কনসাল্টিং থেকে অর্থ পাওয়ার বিষয়টি খুবই অদ্ভূত ছিল বলে জানান হসু চিং-কুয়াং। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ওই অর্থ আসত মধ্যপ্রাচ্য হয়ে। কিন্তু এ বিষয়ে আর বিস্তারিত জানাতে রাজি হননি গোল্ড অ্যাপোলোর প্রতিষ্ঠাতা।

গোল্ড অ্যাপোলো এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘আমরা শুধু পেজারে আমাদের ব্র্যান্ড নাম ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছি। পেজারের নকশা বা উৎপাদনে আমাদের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না।’

কিন্তু গোল্ড অ্যাপোলের পক্ষ থেকে এসব দাবি করা হলেও লেবাননে বিস্ফোরণের ঘটনার পর তাইওয়ানের তদন্ত সংস্থার একদল তদন্ত কর্মকর্তা হাজির হয়েছেন হসু চিং-কুয়াংয়ের কার্যালয়ে। এতে বোঝা যাচ্ছে, গোল্ড অ্যাপোলোর পক্ষ থেকে যতই দাবি করা হোক, তাইওয়ানের কর্তৃপক্ষ তাতে আশ্বস্ত হতে পারছে না। তারা বিষয়টি তদন্ত করে দেখবে।

প্রযুক্তিপণ্য তৈরির ক্ষেত্রে বিশ্বজুড়ে খ্যাতি আছে তাইওয়ানের। তবে দেশটিতে প্রযুক্তিপণ্য তৈরির এ প্রক্রিয়া অবশ্য কিছুটা জটিলও। অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, তারা যেসব পণ্য বিক্রি করে, সেসব পণ্য আদতে তারা তৈরি করে না। তারা ব্র্যান্ড নাম ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে।

পেজার তেমন কোনো আধুনিক প্রযুক্তিপণ্য নয়। এর ব্যবহার অনেক আগে থেকে আছে। বিশ্বের অনেক প্রতিষ্ঠান পেজার তৈরির সক্ষমতা রাখে।

পেজার বিস্ফোরণে নিহত এক ব্যক্তির মরদেহ ঘিরে স্বজন ও অন্যদের আহাজারি
পেজার বিস্ফোরণে নিহত এক ব্যক্তির মরদেহ ঘিরে স্বজন ও অন্যদের আহাজারি, ছবি: এএফপি

পেজার মূলত ছোট একটি যন্ত্র, যা দিয়ে বেতার তরঙ্গের সাহায্যে যোগাযোগ করা হয়। এতে একটি এলসিডি পর্দা আছে। কথা বলার পাশাপাশি এই পর্দার মাধ্যমে বার্তা আদান–প্রদান করা যায়। গত শতকের আশি ও নব্বইয়ের দশকে পেজার ছিল যোগাযোগের আধুনিক একটি যন্ত্র। কোটি কোটি মানুষ ছোট এই যন্ত্র ব্যবহার করতেন। মুঠোফোন আসার আগে মাঠে থাকা কর্মীদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য পেজারের ব্যবহার হতো বেশি।

কিন্তু গত দুই দশকে মুঠোফোন, বিশেষ করে স্মার্টফোনের ব্যবহারের কারণে পেজারের ব্যবহার প্রায় বিলুপ্তির পথে। বিশ্লেষকদের ধারণা, পেজার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গোল্ড অ্যাপোলোর সুনামকে কাজে লাগানো হয়েছে, যাতে হিজবুল্লাহর মতো ক্রেতার কাছে বিক্রি করতে কোনো সমস্যা না হয়। কিন্তু লেবাননে পেজার বিস্ফোরণের এ ঘটনার পর এমন অনেক প্রশ্ন উঠেছে, যার উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না।

বিএসি কনসাল্টিং কে বা কারা, এ বিষয়ে বিবিসির পক্ষ থেকে এখনো তেমন কিছুই জানা সম্ভব হয়নি। এর নেপথ্যে কে আছে বা ছিল, তা-ও জানা যায়নি। এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—লেবাননে হামলায় ব্যবহৃত এসব পেজার যদি গোল্ড অ্যাপোলো তৈরি না করে থাকে, তাহলে কে পেজারগুলো তৈরি করেছে বা কোথায় এগুলো তৈরি করা হয়েছে?

তাইপে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.