তথ্য আপা, জয়িতা, ডে কেয়ারের কর্মীদের কী হবে

0
15
এক টেবিলে শেখায় ব্যস্ত কয়েকটি শিশু। গত ১৮ ডিসেম্বর পানি ভবনে অবস্থিত দিবাযত্নকেন্দ্রে

কর্মজীবী তানজিলা মোস্তাফিজের সন্তানের বয়স ১ বছর ১১ মাস। অনেক ছোটাছুটি করার পর রাজধানীর আগারগাঁওয়ে জাতীয় গ্রন্থাগার ভবনে থাকা সরকারি দিবাযত্ন কেন্দ্রে সন্তানের জন্য একটি আসন পান তিনি।

এ দিবাযত্ন কেন্দ্রটি মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের ‘২০টি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন’ প্রকল্পের অধীনে পরিচালিত হয়। আসন পেতে মা–বাবার করা ৫৫০টি আবেদন এখন অপেক্ষমাণ তালিকায় রয়েছে।

এই প্রকল্পের মেয়াদ গত ৩০ জুন শেষ হয়ে গেছে। কেন্দ্রটির কর্মকর্তা–কর্মচারীরা বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকল্প বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়নি। কাজেই মা–বাবারা কেন্দ্রে সন্তান রাখতে পারছেন। তবে কর্মীরা বেতন পাচ্ছেন না।

তানজিলা বলেন, তাঁর সন্তান এ দিবাযত্ন কেন্দ্রে থাকতে পছন্দ করে। কেন্দ্রটি বাসার কাছে, নিরাপদ, খরচও কম। বেসরকারি দিবাযত্ন কেন্দ্রে খরচ অনেক বেশি। তাই কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে গেলে সন্তানকে কোথায় রাখবেন, এ নিয়ে তিনি বেশ দুশ্চিন্তায় ভুগছেন।

তথ্য আপারা শিশু সন্তানদের নিয়েও আন্দোলন করেছে। রোদ-বৃষ্টি ছাপিয়ে রাত-দিন ফুটপাতে এসব নারীদের অবস্থান কর্মসূচি অনেককেই নাড়া দিয়েছে।

শুধু এই কেন্দ্রের কর্মীরাই নন।  মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কয়েকটি প্রকল্পের কর্মীরা বছরজুড়ে রয়েছে দুশ্চিন্তায়। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ‘মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রাম’ ও ‘তথ্য আপা: তথ্য যোগাযোগপ্রযুক্তির মাধ্যমে নারীদের ক্ষমতায়ন’ প্রকল্প, জয়িতা ফাউন্ডেশন পরিচালিত রাপা প্লাজায় ‘জয়িতা বিপণনকেন্দ্র ও জয়িতা ফুডকোর্ট প্রকল্পে আড়াই হাজারের বেশি কর্মকর্তা ও কর্মচারী রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ১ হাজার ৭০০ জনের বেশি নারী। কাজ হারিয়ে, বেতন না পেয়ে তারা পড়েছেন বিপাকে।

মন্ত্রণালয় কী বলছে

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, কীভাবে গ্রহণ করলে প্রকল্পগুলো টিকে থাকবে, প্রকল্পের উদ্দেশ্য পূরণ হবে, সেসব দিকে কোনো চিন্তা করা হয় না। ফলে হুটহাট প্রকল্প নেওয়া হয়। সেসব প্রকল্পে নতুন করে জনবল নেওয়া হয়। পুরোনো প্রকল্পের জনবল প্রশিক্ষণ ও কাজের মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন করলেও তাঁদের চাকরির নিশ্চয়তা তৈরি হয় না। কোনো ক্ষেত্রে দাতাগোষ্ঠী নিজেরাই একেকটা প্রকল্প প্রস্তাব করে। নিজেরাই পরামর্শক হিসেবে নিযুক্ত হয়। ফলে প্রকল্পের সংখ্যা বাড়ে, কিন্তু নারী–শিশুর উন্নয়নে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণ হয় না।

নতুন জয়িতা টাওয়ারে যদি আমাদের পণ্যগুলো নেয়, তাহলে হয়তো চলতে পারব। এখন চলতে খুব কষ্ট হচ্ছে।

শারমিন রহমান, রাপা প্লাজার জয়িতার উদ্যোক্তা।

কর্মকর্তাদের মতে, কোনো কোনো প্রকল্পের প্রস্তাবও ত্রুটিযুক্ত। যেমন তথ্য আপা প্রকল্পের মূল উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) না থাকলেও প্রথম সংশোধনীতে চাকরি রাজস্ব খাতে নেওয়ার উল্লেখ ছিল। দ্বিতীয় সংশোধনীতে সেটা বাদ দেওয়া হয়। এর আগেই প্রায় দেড় হাজার নারীকে নিয়োগ দেওয়া হয়।

শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রে বেতন বন্ধ

‘২০টি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন’ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালে। শুরুতে ১১টি কেন্দ্র স্থাপনের কথা ছিল। পরে ২০১৮ সালে তা বাড়িয়ে ২০টি করা হয়। এর মধ্যে ঢাকায় ১১টি, ঢাকার বাইরে ৯টি। এসব দিবাযত্ন কেন্দ্রে ১ হাজার ১০০টির বেশি শিশু রয়েছে। প্রকল্পের ব্যয় ৮৪ কোটি টাকা।

দুই দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত করা হয়। ২০১৮–১৯ অর্থবছরে এসব কেন্দ্র থেকে বছরে আয় হয়েছিল প্রায় ৭ লাখ টাকা। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে আয় বেড়ে এক কোটি টাকা হয়েছে। জনবল রয়েছে ২৪৩ জন। তাঁদের মধ্যে নারী কমপক্ষে ১৭০ জন।

রাজধানীর রাপা প্লাজায় ১৪ বছর ধরে চলা জয়িতার কার্যক্রম গত ১৩ মে বন্ধ হয়ে যায়। কার্যক্রম চালিয়ে যেতে আবেদন উচ্চ আদালতে খারিজ হয়ে গেলে ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে রাপা প্লাজায় জয়িতা বিপণনকেন্দ্র ও ফুড কোর্ট বন্ধের নোটিশ টানিয়ে দেওয়া হয়।

মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়া এসব কেন্দ্রের কর্মকর্তা–কর্মচারীরা এখন বেতন পাচ্ছেন না। তাঁদের একজন নাম প্রকাশ না করে বললেন, ‘আমরা বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটাই। ওদের দেখভাল করি। কিন্তু চাকরি নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণে নিজেদেরই মানসিক অবস্থা ভালো না।’ তিনি আরও বলেন, ‘নতুন করে ৬০টি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। সেখানে নতুন করে নিয়োগ দেওয়া হবে। আমরা চাকরি পাব কিনা, এ কেন্দ্রগুলো থাকবে কি না, সে সম্পর্কে এখনো মন্ত্রণালয় কিছু জানায়নি।’

সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক অতিরিক্ত সচিব শবনম মোস্তারী বলেন, ‘আশা করা যায়, এ প্রকল্পের শিশুসেবা কার্যক্রম অব্যাহত রাখার বিষয়ে কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। প্রকল্পটি কর্মজীবী নারীদের কাছে সমাদৃত হয়েছে। তাই একই মডেলে সব সরকারি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র পরিচালনার পরামর্শ দেন তিনি।

আমরা বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটাই। ওদের দেখভাল করি। কিন্তু চাকরি নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণে নিজেদেরই মানসিক অবস্থা ভালো না।

কর্মী, দিবাযত্ন কেন্দ্র

‘তথ্য আপা প্রকল্পের’ কর্মীরা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করেন। গত ৩০ মে তোলা
‘তথ্য আপা প্রকল্পের’ কর্মীরা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করেন। গত ৩০ মে তোলা

মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রামে আউটসোর্সিং নিয়ে অসন্তোষ

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রাম। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ২৫ বছর ধরে প্রকল্পটি চলছে। সরাসরি নিয়োগ পাওয়া ২৬২ জনসহ মোট জনবল ৩৮১। তাঁদের মধ্যে নারী ১০২ জন।

প্রকল্পটি শুরু হয় ২০০০ সালের জুলাইয়ে। বাংলাদেশ সরকার ও ডেনমার্কের সরকারি সংস্থা ড্যানিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির (ডানিডা) যৌথ উদ্যোগে প্রকল্পটি শুরু হয়। প্রকল্পের চতুর্থ পর্ব ২০১৬ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত চলেছে।

২০২২ সালের জুনের পর ডানিডা প্রকল্প থেকে সরে যায়। এরপর প্রকল্পের ব্যয় কমিয়ে আনে বাংলাদেশ সরকার। ‘এ গ্রেডের’ ফ্ল্যাগশিপ (অতীব গুরুত্বপূর্ণ) থেকে প্রকল্পটি ‘বি গ্রেডে’ নামিয়ে আনা হলেও দফায় দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে প্রকল্প চালু রাখা হয়। কয়েক মাস বেতন ছিল অনিয়মিত। চলতি বছর থেকে মন্ত্রণালয়ের পরিচালন বাজেটের অধীনে প্রকল্পের ব্যয় বহন করা হচ্ছে।

প্রকল্পটিতে এক যুগের বেশি সময় ধরে কাজ করা একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আগে বেতন পেতাম ৩২ হাজার টাকার বেশি। এখন পাই ২৯ হাজার টাকা। পরিচালন বাজেট থেকে বেতন শুরু হওয়ার পর ১০ শতাংশ (সম্মানি খাত হিসেবে) করে কেটে রাখা হচ্ছে। মানুষের বেতন বাড়ে, আর আমাদের কমে। চাকরিটা থাকে কিনা, সেটা নিয়েও দুশ্চিন্তা আছে।’

একটি প্রকল্প কিছুদিন চলার পর সেটিকে বাণিজ্যিক মডেলে দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই করার পরিবর্তে নতুন ভাবে প্রকল্প নেওয়া হয়। এতে করে প্রকল্পে কাজ করা নারীরা মধ্যবয়সে কাজ হারিয়ে চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েন। এর দায় মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকেরা এড়াতে পারেন না।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, সিপিডির গবেষণা পরিচালক।

এ প্রকল্পের পরিবর্তে এখন ‘নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ ও প্রতিকারে সমন্বিত সেবা জোরদারকরণ এবং কুইক রেসপন্স টিম কার্যক্রম’ শিরোনামে ৫৫৪ জনবলের নতুন একটি প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। পুরোনো জনবলের কেউ নিয়োগ পেতে চাইলে নতুন প্রকল্পের জন্য পৃথক আবেদন করতে হবে। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে জনবল নিয়োগের জন্য ইতিমধ্যে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।

প্রকল্পের একজন কর্মকর্তা বলেন, এতদিন সবাই জানত, সরকারি চাকরি করেন। এখন আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগ নিতে সামাজিকভাবে বিব্রত হওয়ার আশঙ্কায় ভুগছেন তিনি। এ ছাড়া নতুন প্রকল্পে চাকরি হবেই, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই।

প্রকল্প পরিচালক যুগ্ম সচিব প্রকাশ কান্তি চৌধুরী বলেন, আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় সেবা গ্রহণ নীতিমালা ২০২৫ অনুসারে নতুন প্রকল্পের জনবল আউটসোর্সিং ছাড়া অর্থ বিভাগ অনুমোদন দেয় না। ফলে নতুন প্রকল্পে জনবল নিয়োগ আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমেই হবে। নতুন প্রকল্পে পুরোনো জনবল ও নারীরা অগ্রাধিকার পাবেন। প্রকল্প নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে টানাপোড়েনে নারী–শিশুর জন্য সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার অভিযোগ তিনি নাকচ করে দেন।

প্রকল্পের আওতায় ১৪টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি), জেলা সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৬৭টি ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেল (ওসিসি সেল), ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরি, ৮টি বিভাগীয় ডিএনএ স্ক্রিনিং ল্যাব, ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার, ৮টি আঞ্চলিক ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ন্যাশনাল হেল্পলাইন সেন্টার ১০৯–এর কার্যক্রম রয়েছে।

তথ্য আপা প্রকল্প নিয়ে টানা আন্দোলন

চাকরি স্থায়ী করার দাবিতে টানা ৭২ দিন রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাব এলাকায় আন্দোলন করেন তথ্য আপা প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কোনো কোনো তথ্য আপা শিশুসন্তানদের নিয়েও আন্দোলন করেছে। রোদ-বৃষ্টি ছাপিয়ে রাত-দিন ফুটপাতে এসব নারীদের অবস্থান কর্মসূচি অনেককেই নাড়া দিয়েছে। তাঁদের আন্দোলনে রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের কেউ কেউ সংহতি প্রকাশ করেছেন। শেষ পর্যন্ত আশ্বাস পেয়ে তথ্য আপারা গত ৭ আগস্ট কাজে যোগ দেন।

‘জাতীয় মহিলা সংস্থা’র বাস্তবায়ন করা এ প্রকল্পের পুরো নাম ছিল ‘তথ্য আপা: ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তথ্য যোগাযোগপ্রযুক্তির মাধ্যমে মহিলাদের ক্ষমতায়ন’। গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত একনেক সভায় প্রকল্পটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে-‘তথ্য আপা: তথ্য যোগাযোগপ্রযুক্তির মাধ্যমে নারীদের ক্ষমতায়ন প্রকল্প (২য় পর্যায়) (২য় সংশোধিত)’।

২০১১ সালে পাইলট আকারে ১৩টি উপজেলায় ‘তথ্য আপা’ প্রকল্প শুরু হয়। পরে ২০১৮ সালের শেষ দিকে ৪৯২টি উপজেলায় প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হয়। মোট ১ হাজার ৪৮৩টি পদের মধ্যে নারী রয়েছেন ১ হাজার ১৭২ জন। ৩১১ জন চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। এর বাইরে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ৪৯৭টি পদ রয়েছে অফিস সহায়কের। সেখানেও শ খানেকের বেশি নারী।

এ প্রকল্পের আওতায় সারা দেশের উপজেলায় তথ্যকেন্দ্র স্থাপন, নারীদের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিনির্ভর বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া, বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য দেওয়া এবং অনলাইনে যেকোনো আবেদন করতে সেবা দেওয়াসহ নারীদের অধিকার ও ক্ষমতায়ণ নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করা হয়।

ঝালকাঠি সদরের তথ্য সেবা কর্মকর্তা ও আন্দোলন পরিচালনা কমিটির সভাপতি সংগীতা সরকার প্রথম আলোকে বলেন, চাকরি স্থায়ী করার জন্য এক সপ্তাহের মধ্যে জাতীয় মহিলা সংস্থাকে একটি প্রস্তাব তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর আশ্বাস দিয়ে তথ্য আপাদের কাজে ফিরে যেতে বলা হয়। দুই সপ্তাহ হয়ে গেলেও প্রস্তাব তৈরি হয়নি।

কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার তথ্যসেবা সহকারী রুমি আক্তার বলেন, ‘স্বামী অসুস্থ। একার আয়ে সংসার চলে। এখন সেই চাকরিটাও চলে গেলে কী হবে, ভাবতে পারছি না।’

তথ্য আপা প্রকল্পের উপ প্রকল্প পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) যুগ্ম সচিব এস এম নাজিমুল ইসলাম জানান, এর আগে প্রকল্পের মেয়াদ দুই দফায় বাড়িয়ে ২০২৪ সালের ৩০ জুন করা হয়। গত বছর আরও এক বছর বাড়িয়ে ২০২৫ সালের ৩০ জুন করা হয়। এবার আরও এক বছর মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব একনেক সভায় অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।

এদিকে এদিকে ৪ আগস্ট দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান কার্যালয় থেকে একটি এনফোর্সমেন্ট দল তথ্য আপা প্রকল্পে অনিয়ম ও সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে অভিযান পরিচালনা করেছে। নথিপত্র পর্যালোচনা করে তাঁরা কমিশনে প্রতিবেদন জমা দেবেন বলে জানা গেছে।

রাপা প্লাজায় জয়িতার কার্যক্রম বন্ধ

রাপা প্লাজার চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় জয়িতা বিপণনকেন্দ্রের ৭৮টি এবং ফুড কোর্টের ১৬টিসহ মোট ৯৪টি স্টল ছিল। স্টল প্রতি ভাড়া ছিল ৫ হাজার টাকা। স্টলগুলো বরাদ্দ ছিল নারী উদ্যোক্তাদের সমিতির নামে। অল্প কয়েকজন পুরুষ ছাড়া স্টলগুলোর কর্মীরাও ছিলেন নারী। এ সংখ্যা ২০০ জনের মতো।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংস্থা জয়িতা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে জয়িতার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছিল। ২০১১ সালের নভেম্বরে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এর যাত্রা শুরু হয়। এটি ফাউন্ডেশন হয় ২০১৬ সালে।

বাইরে দোকান নিতে গেলে কমপক্ষে ৫ লাখ টাকা লাগবে। এত টাকা আমার নেই।

শারমিন রহমান

জয়িতার কার্যক্রম গত ১৩ মে বন্ধ হয়ে যায়। সেখানে কার্যক্রম চালিয়ে যেতে জয়িতা ফাউন্ডেশনের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালান সেখানকার উদ্যোক্তারা। তবে সেই আবেদন উচ্চ আদালতে খারিজ হয়ে গেলে ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে রাপা প্লাজায় জয়িতা বিপণনকেন্দ্র ও ফুড কোর্ট বন্ধের নোটিশ টানিয়ে দেওয়া হয়।

রাজধানীর ধানমন্ডির রাপা প্লাজায় জয়িতা বিপণনকেন্দ্রের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে
রাজধানীর ধানমন্ডির রাপা প্লাজায় জয়িতা বিপণনকেন্দ্রের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে

ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে ১২ তলা ‘জয়িতা টাওয়ার’ নির্মাণ করা হয়েছে। যদিও সেটা এখনো চালু হয়নি। নতুন টাওয়ারে উদ্যোক্তারা সরাসরি স্থানান্তর চাইলে তা নাকচ করে দেয় ফাউন্ডেশন। এ নিয়েই শুরু হয় দ্বন্দ্ব, যা আদালতে গড়ায়।

রাপা প্লাজায় কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর কোনো কোনো উদ্যোক্তা নতুন করে কিছু করার চেষ্টা করছেন। অনেকেই এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি। তাঁদের একজন শারমিন রহমান। ২০১১ সালের শুরু থেকে তিনি জয়িতা বিপণন কেন্দ্রে (স্টল এ–ওয়ান) ছিলেন। হাতের কাজের শাড়ি ও পোশাক বিক্রি করতেন।তিনি বলেন, ‘বাইরে দোকান নিতে গেলে কমপক্ষে ৫ লাখ টাকা লাগবে। এত টাকা আমার নেই।’ তাঁর সঙ্গে কর্মী ও কারিগর মিলে ২০ জনের মতো বেকার হয়ে পড়েছেন বলেও জানান তিনি।

শারমিন বলেন, ‘নতুন জয়িতা টাওয়ারে যদি আমাদের পণ্যগুলো নেয়, তাহলে হয়তো চলতে পারব। এখন চলতে খুব কষ্ট হচ্ছে।’

শারমিনের স্টলের কর্মী ছিলেন আইরিন আক্তার। ওই স্টলে যোগ দেওয়ার পর দুই সন্তানের জন্ম দেন তিনি। ছোট সন্তানের বয়স আড়াই বছর, বড় জনের ৭ বছর। সন্তানদের নিয়েই তিনি ওই স্টলে কাজ করতেন। এখন তাঁকে কেউ সন্তানসহ কাজে নিতে চায় না। স্বামী অটোরিকশাচালক। সংসার চালাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে।

জয়িতা বিপণনকেন্দ্রের উদ্যোক্তা শাহনাজ বেগম বলেন, এখন ২০ জন উদ্যোক্তার সঙ্গে মিলে ধানমন্ডির ১৩ নম্বরে মানামা টাওয়ারে দোকান নিয়েছেন। ভাড়া ও আনুষঙ্গিক খরচসহ দোকানের জন্য প্রতি মাসে ১২ লাখ টাকা দিতে হবে। এত বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে উদ্যোগ চালাতে পারবেন কি না, তা নিয়ে তিনি সংশয়ে ভুগছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জয়িতা ফাউন্ডেশনের এক কর্মকর্তা বলেন, জয়িতা টাওয়ারে রাপা প্লাজার উদ্যোক্তারা পণ্য দেওয়ার সুযোগ পাবেন কি না, সে সম্পর্কে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

‘মন্ত্রণালয় দায় এড়াতে পারে না’

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সময়ে সময়ে সরকার পরিবর্তন, এক সরকারের সময়ে নেওয়া প্রকল্পকে অন্য সরকারের সময়ে গুরুত্ব না দেওয়ার প্রবণতা ও নানা ধরনের চাপ থেকে প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রাধিকার পরিবর্তন হয়। ফলে একটি প্রকল্প কিছুদিন চলার পর সেটিকে বাণিজ্যিক মডেলে দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই করার পরিবর্তে নতুন ভাবে প্রকল্প নেওয়া হয়। এতে করে প্রকল্পে কাজ করা নারীরা মধ্য বয়সে কাজ হারিয়ে চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েন। এর দায় মন্ত্রণালয়ের নীতি–নির্ধারকেরা এড়াতে পারেন না। এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে প্রকল্পগুলোর মাঝামাঝি সময়ে মূল্যায়ন-পর্যালোচনা করা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

ঢাকা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.