মহাসড়কটি প্রশস্ত করতে কত টাকা খরচ হতে পারে, তার একটি হিসাব দাঁড় করিয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। নথি ঘেঁটে দেখা যায়, ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে চট্টগ্রামের সিটি গেটের দূরত্ব ২৩২ কিলোমিটার। মহাসড়কটি আট লেনে উন্নীত করতে খরচ হবে ৭৩ হাজার কোটি টাকার বেশি।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, আলাদা তিনটি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশস্ত করা হবে মহাসড়কটি। একটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে বৃহত্তর ঢাকা অংশের তিনটি জেলায় (ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জ)। এ অংশে সড়কের দৈর্ঘ্য ৩৮ কিলোমিটার; যা বাস্তবায়নে খরচ হবে ৮ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা। আরেকটি প্রকল্প হবে বৃহত্তর কুমিল্লা অংশের দুটি জেলায় (কুমিল্লা ও ফেনী)। এ অংশে সড়কের দৈর্ঘ্য ১২৫ কিলোমিটার। এটি বাস্তবায়নে খরচ হবে ৪৫ হাজার ৯৪১ কোটি টাকা। আরেকটি বাস্তবায়িত হবে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অংশে; যেটি হবে মূলত ফেনী থেকে চট্টগ্রামের সিটি গেট পর্যন্ত। এতে খরচ হবে ১৮ হাজার ৯৪২ কোটি টাকা। এই অংশের দৈর্ঘ্য ৬৯ কিলোমিটার।
তিনটি প্রকল্পের মোট ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ৭৩ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে ঋণ চাওয়া হচ্ছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। বাকি টাকা সরকার জোগান দেবে। ২০২৪ সালে শুরু হয়ে ২০২৯ সালে সড়ক প্রশস্তের কাজ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সড়ক ও জনপথ (সওজ)।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, চলমান অর্থনৈতিক সংকটে প্রকল্পের পুরো টাকা সরকারি কোষাগার থেকে জোগান দেওয়া সম্ভব নয়। উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া হবে। অর্থায়নে উন্নয়ন সহযোগীদের অনুরোধ জানাতে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি তিনটি প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।
মহাসড়কটি আট লেনে উন্নীত করতে কেন আলাদা তিনটি প্রকল্প নেওয়া হলো, জানতে কথা হয় সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের কয়েকজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সঙ্গে। তাঁরা বলেন, ২৩২ কিলোমিটারের কাজ একটি প্রকল্পের আওতায় বাস্তবায়ন করলে খরচ পড়বে বেশি। তখন এত টাকা একসঙ্গে কোনো উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ঋণ দিতে রাজি হবে না। প্রকল্পে জটিলতাও বাড়বে। সে কারণেই আলাদা তিনটি প্রকল্পের প্রস্তাব।
এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা অনুবিভাগ) জাকির হোসেন বলেন, ‘তিনটি প্রকল্প নেওয়ার কারণ, এত বড় প্রকল্প একসঙ্গে বাস্তবায়ন করা কঠিন। তা ছাড়া, এত বিপুল পরিমাণ অর্থ একসঙ্গে কেউই দিতে রাজি হবে না। সে কারণে কাজ ভাগ করা হয়েছে।’
নিয়ম অনুযায়ী পরিকল্পনা কমিশন থেকে এখন তিনটি প্রকল্প অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) পাঠানো হবে। কোন কোন দেশ ও সংস্থা এসব প্রকল্পে অর্থায়ন করবে তা খোঁজ করবে ইআরডি। অবশ্য তিনটি প্রকল্প এখনো ইআরডিতে পাঠায়নি কমিশন।
তবে কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা জানান, কিসের ভিত্তিতে প্রকল্পের ব্যয় ৭৩ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা মহাসড়ক বিভাগের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে। তা ছাড়া, এ–সংক্রান্ত কোনো সমীক্ষা আছে কি না, জানতে চাওয়া হয়েছে। এসব তথ্যউপাত্ত পেয়ে সন্তুষ্ট হলে তবে প্রকল্পটি ইআরডিতে পাঠানো হবে।
এর আগে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করতে ২০০৬ সালে একটি প্রকল্প নিয়েছিল সরকার। দুই দফায় বাড়িয়ে প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হয় ২০১৬ সালে। প্রকল্পের খরচ ২ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকায় ঠেকে। নানা ঝক্কি–ঝামেলার পর কুমিল্লার দাউদকান্দি টোল প্লাজা থেকে চট্টগ্রাম সিটি গেট পর্যন্ত ১৯২ কিলোমিটার চার লেন সড়কটি ২০১৬ সালে চালু হয়।
পরামর্শক নিয়োগ মার্চে
মহাসড়কটি আট লেনে উন্নীত করতে প্রয়োজন একটি বিস্তারিত নকশা ও সমীক্ষা। এ দুটি কাজ করতে গত বছর পরামর্শক নিয়োগপ্রক্রিয়া শুরু করে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। আন্তর্জাতিক দরপত্রে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। ঠিকাদার নিয়োগপ্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে। আগামী মার্চের মধ্যে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে প্রস্তাবটি অনুমোদনের কথা রয়েছে।
এরপর নির্বাচিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হবে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের। চুক্তির পর ১৮ মাসের মধ্যে বিস্তারিত নকশা ও সমীক্ষা করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ দুই কাজে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক প্রায় ৩৫ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সাব্বির হাসান খান বলেন, ‘কোন এলাকায় ছয় লেন; কোন এলাকায় আট লেন হবে তা সমীক্ষায় নির্ধারণ করা হবে। এটি নির্ধারিত হবে যানবাহনের চাপের ওপর ভিত্তি করে। কোথায় ওভারপাস হবে, কোথায় সড়ক সোজা করতে হবে—এসব সমীক্ষায় থাকবে।’
সড়ক বিভাগ বলছে, একদিকে সমীক্ষার কাজ চলতে থাকবে। অন্যদিকে বিদেশিদের কাছ থেকে অর্থায়ন খোঁজা হবে। ২০২৩ সালের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হবে বলে তাদের আশা। কারণ, এরই মধ্যে এডিবি মহাসড়ক প্রশস্তকরণে অর্থায়নে আগ্রহ দেখিয়েছে।
কেন দরকার ৮ লেন
মহাসড়ক আট লেন করার যুক্তি হিসেবে এই প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, এই সড়কে যানবাহন বাড়ছে। অনেক স্থানে যানজট তৈরি হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসায়ীরা এটিকে আট লেনে উন্নীত করার দাবি জানিয়ে আসছেন। দিনে এ সড়কে শুধু ১০ হাজার ট্রাক চলাচল করে। নিরবচ্ছিন্ন যান চলাচলের লক্ষ্যে সড়ক প্রশস্তকরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
প্রথম ২০১৩ সালে এ মহাসড়ক সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) ভিত্তিতে এক্সপ্রেসওয়ে করার সিদ্ধান্ত হয়। গত বছর অক্টোবরে পিপিপি পদ্ধতিতে প্রকল্পটি বাতিল করে সরকার। পিপিপিতে না করে বিদ্যমান চার লেনবিশিষ্ট মহাসড়কটি প্রশস্তকরণ ও উভয় পাশে সার্ভিস লেন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সড়ক বিভাগের যুক্তি, এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের খরচ বেশি; যা বহন করার সক্ষমতা সরকারের নেই। এ ছাড়া, এক্সপ্রেসওয়ের সুবিধা সাধারণ মানুষের পাওয়ার সম্ভাবনা কম। এই সুবিধা পাবে একটি বিশেষ গোষ্ঠী। এসব দিক বিবেচনা করে এক্সপ্রেসওয়ে থেকে সরে আসে সরকার। তবে পরবর্তী সময়ে এক্সপ্রেসওয়ে করা যেতে পারে।
জানা গেছে, নতুন প্রকল্পের আওতায় নারায়ণগঞ্জের মদনপুর, কুমিল্লার গৌরীপুরসহ যেসব স্থানে যানজট তৈরি হতে পারে, সেসব স্থানে ওভারপাস করে দেওয়া হবে। যেসব স্থানে সড়ক বাঁকা, সেগুলো সোজা করা হবে। এটি সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্প। প্রকল্পটিতে অর্থায়নে অনেক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা আগ্রহ দেখিয়েছে।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়ক। চার লেন দিয়ে এখন চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না। যানজটের কারণে ব্যবসার ক্ষতি হচ্ছে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে সড়কটি আট লেনে উন্নীত করার দাবি জানিয়ে আসছি। আট লেনে উন্নীত হলে যানজট কমবে, খরচও কমবে।’