ঢাকা উত্তরে মশা নিধনের ব্যাকটেরিয়া আমদানিতে ‘জালিয়াতি’

0
176

ঢাকা উত্তর সিটিতে মশার লার্ভা নিধনের ব্যাকটেরিয়া বিটিআই (বাসিলাস থুরিনজেনসিস ইসরায়েলেনসিস) আমদানিতে জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। সিঙ্গাপুরের কথা বলে ব্যাকটেরিয়াটি আমদানি করা হয়েছে চীন থেকে। দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী বিটিআই ব্যাকটেরিয়াটি চীন থেকে আমদানির কোনো সুযোগ ছিল না।

ঢাকা উত্তর সিটিকে (ডিএনসিসি) মশা নিধনের নতুন এই ব্যাকটেরিয়া সরবরাহ করেছে বাংলাদেশি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মার্শাল অ্যাগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। তারা সিটি করপোরেশনকে যে বিটিআই ব্যাকটেরিয়া বুঝিয়ে দিয়েছে, ওই মোড়কের গায়ে প্রস্তুতকারক হিসেবে সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যাল লিমিটেডের নাম লেখা রয়েছে।

সে (মার্শাল এগ্রো) যা মন চায়, তা–ই করুক, যদি এ রকম হয়, ও তো ব্ল্যাকলিস্টেট (কালো তালিকাভুক্ত) হয়ে যাবে। তবে যেটা হয়েছে, সেটি আমাদের সিটি করপোরেশনের জন্য বড় একটি শিক্ষা হয়েছে

ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম

মশক নিধন কার্যক্রম
মশক নিধন কার্যক্রম

তবে চট্টগ্রাম বন্দরের আমদানির তথ্যে দেখা যায়, গত ২৬ জুলাই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে কনটেইনারে করে বিটিআই ব্যাকটেরিয়া আমদানি করে মার্শাল অ্যাগ্রোভেট লিমিটেড। যা চীনের ‘শানডং গানন অ্যাগ্রোকেমিক্যাল কোম্পানি’ থেকে আনা হয়েছে।

গত ৩০ জুলাই কাস্টমস কর্তৃপক্ষের কাছে ৫ লাখ ৩৮ হাজার টাকা শুল্ককর পরিশোধ করে বিটিআইয়ের ওই চালানটি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস নেয় প্রতিষ্ঠানটি। আমদানির তথ্য অনুযায়ী, চালানটিতে পাঁচ টন বিটিআই ছিল। আমদানিমূল্য দেখানো হয় ৪৮ হাজার ৫০০ ডলার।

এ ছাড়া মার্শাল অ্যাগ্রোভেটের আমদানির তথ্যে দেখা যায়, শুধু গত মাসে নয়, প্রতিষ্ঠানটি এ বছর সিঙ্গাপুর থেকে কোনো রাসায়নিক আমদানি করেনি।

দরপত্রের বিজ্ঞপ্তি থেকে দেখা যায়, গত ১১ এপ্রিল মশার লার্ভা নিধনের উদ্দেশ্যে বিটিআই ব্যাকটেরিয়া কেনার বিজ্ঞপ্তি দেয় ঢাকা উত্তর সিটির রাজস্ব বিভাগ। এতে বিটিআইয়ের উৎপাদক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ, সিঙ্গাপুর, ভারত অথবা মালয়েশিয়ার নাম ছিল। অর্থাৎ এই দেশগুলোর কোনো একটি থেকেই ব্যাকটেরিয়াটি আমদানি করতে হবে।

এখানে তিনটি বিষয় ঘটেছে। ক্ষমতার অপব্যবহার, জালিয়াতি এবং প্রতারণা। সিটি করপোরেশনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের যাঁরা, তাঁদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এর দায়িত্ব তাঁদের নিতে হবে। তাঁদের জবাবদিহি করতে হবে

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান

কিন্তু মার্শাল অ্যাগ্রোভেট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড দরপত্রের ওই শর্ত ভঙ্গ করে বিটিআই ব্যাকটেরিয়াটি চীন থেকে আমদানি করেছে। চীনা কোম্পানির তথ্য গোপন করতেই প্রস্তুতকারক হিসেবে তারা সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যালের নাম ব্যবহার করেছে।

বিষয়টি নিয়ে কথা হয় মার্শাল অ্যাগ্রোভেটের নির্বাহী পরিচালক নাসির উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে। তাঁর দাবি, তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে পণ্যটি আমদানি করানো হয়েছে। দরপত্রে তিনি যেসব প্রয়োজনীয় নথি জমা দিয়েছেন সেখানে তৃতীয় পক্ষ শানডংয়ের সঙ্গে সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যালের চুক্তির বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। ওই কোম্পানির (শানডং) মাধ্যমেই বিটিআই আমদানি করা হয়েছে।

দরপত্রের শর্তে চীন থেকে আমদানির সুযোগ না থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি যদি যেকোনো মাধ্যমে ওই দেশের (সিঙ্গাপুর) পণ্য আনতে পারি, তাহলে তো হয়ে যাওয়ার কথা। আমি সেভাবেই ডকুমেন্ট জমা দিয়েছি।’

এদিকে ঠিকাদার আমদানি করা বিটিআই ব্যাকটেরিয়াকে সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যাল লিমিটেডের প্রস্তুত করা বলে দাবি করলেও সেটি সত্য নয় বলে দাবি করেছে বেস্ট কেমিক্যাল কোম্পানি। এ নিয়ে তারা নিজেদের ফেসবুক পেজে একটি সতর্কবার্তাও দিয়েছে।

‘জালিয়াতির সতর্কবার্তা’ (স্ক্যাম অ্যালার্ট) শিরোনামে গত সোমবার সকালে দেওয়া ওই বার্তায় লেখা হয়, ‘বাংলাদেশের মার্শাল অ্যাগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড পাঁচ টন বিটিআই লার্ভিসাইড পণ্য ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) সরবরাহ করেছিল। এতে তারা জালিয়াতির মাধ্যমে (ফ্রডলি) আমাদের কোম্পানির নাম (বেস্ট কেমিক্যাল) বিটিআইয়ের প্রস্তুতকারক হিসেবে ব্যবহার করেছে।’ মার্শাল অ্যাগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড বেস্ট কেমিক্যালের নিযুক্ত কোনো পরিবেশক নয় বলেও জানায় কোম্পানিটি।

অন্যদিকে মার্শাল অ্যাগ্রোভেট মি. লি শিয়াং নামের যে ব্যক্তিকে বেস্ট কেমিক্যালের রপ্তানি ব্যবস্থাপক (এক্সপোর্ট ম্যানেজার) এবং বিটিআই–বিশেষজ্ঞ দাবি করেছিল, তিনি বেস্ট কেমিক্যালের কোনো কর্মী নন। সর্বশেষ গতকাল বুধবার বেস্ট কেমিক্যালের ফেসবুক পেজে এ–সংক্রান্ত আরেকটি বিবৃতি দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, তারা মার্শাল অ্যাগ্রোভেটের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

এদিকে আমদানি করা বিটিআই ব্যাকটেরিয়ার প্রস্তুতকারক যে সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যাল লিমিটেড, এ-সংক্রান্ত সব প্রমাণ দেখাতে ঠিকাদার মার্শাল অ্যাগ্রোভেটকে গত সোমবার চিঠি দিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি।

বিটিআই ব্যাকটেরিয়া চীন থেকে আমদানি করা হয়েছে জানিয়ে এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলামের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সে (মার্শাল এগ্রো) যা মন চায়, তা–ই করুক, যদি এ রকম হয়, ও তো ব্ল্যাকলিস্টেট (কালো তালিকাভুক্ত) হয়ে যাবে। তবে যেটা হয়েছে, সেটি আমাদের সিটি করপোরেশনের জন্য বড় একটি শিক্ষা হয়েছে।’

মেয়র আরও বলেন, ‘ওর (ঠিকাদার) কাছে প্রমাণ চাওয়া হয়েছে। যদি না দিতে পারে, তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শুক্রবার দিনের মধ্যে দিতে না পারলে ব্ল্যাকলিস্ট করে দেওয়া হবে।’

দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান গতরাতে বলেন, এখানে তিনটি বিষয় ঘটেছে। ক্ষমতার অপব্যবহার, জালিয়াতি এবং প্রতারণা। সিটি করপোরেশনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের যাঁরা, তাঁদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এর দায়িত্ব তাঁদের নিতে হবে। তাঁদের জবাবদিহি করতে হবে।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.