ঢাকায় বিভিন্ন পার্টিতে অজান্তেই তরুণীদের খাওয়ানো হতো ভয়ংকর মাদক

0
203
ঢাকার বনানীর একটি ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান সৈয়দ নওশাদ প্রায় এক দশকের বেশি সময় ধরে চেতনানাশক ওষুধ কেটামিন থেকে তৈরি করা মাদক গুলশান–বনানীর পার্টিতে যাওয়া তরুণ–যুবকদের সরবরাহ করে আসছিলেন, ছবি: সংগৃহীত

সম্প্রতি সৈয়দ নওশাদ (৩৮) নামের ওই যুবককে গ্রেপ্তার করেছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) কর্মকর্তারা। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে কর্মকর্তারা বলছেন, এক দশকের বেশি সময় ধরে নওশাদ নিজের বাসায় তৈরি করা মাদকটি কোকেন নাম দিয়ে সরবরাহ করে আসছিলেন। তরুণ–যুবকেরা মাদকটি হাতে পেতেন গুঁড়া হিসেবে। পার্টিতে যোগ দেওয়া তরুণীদের অজান্তে কোমল পানীয়ের সঙ্গে তা মিশিয়ে খাওয়ানো হতো।

ডিএনসির কর্মকর্তারা জানান, নওশাদের বাবা একজন ব্যবসায়ী। উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর নওশাদ উচ্চশিক্ষার জন্য মালয়েশিয়ায় যান। তবে তিনি লেখাপড়া শেষ না করেই ২০০৩ সালে দেশে ফিরে আসেন। তরল কেটামিনকে পাউডারে পরিণত করার কৌশল তিনি মালয়েশিয়াতেই রপ্ত করেন। দেশে ফিরে তিনি বিভিন্ন পার্টিতে যাওয়া শুরু করেন। সেখানে নিয়মিত মাদক সেবন করতেন। একপর্যায়ে তিনি বাসাতেই মাদক সেবন শুরু করেন। একটি কক্ষকে ল্যাব বানিয়ে তিনি সেখানে কেটামিন তৈরি করতেন।

যেভাবে তৈরি করা হতো মাদক

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) ঢাকা মহানগর উত্তর অঞ্চলের সহকারী পরিচালক মেহেদি হাসান বলেন, ওষুধের দোকান থেকে কেটামিন ইনজেকশন কিনে নিতেন নওশাদ। পরে তার সঙ্গে একটি বিশেষ রাসায়নিক মেশাতেন তিনি। তখন ওই মিশ্রণ বাসার ওভেনে নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রায় পাউডারে পরিণত করতেন। নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করে এই মাদক তিনি বিক্রি করে আসছিলেন। এক গ্রাম পাউডার ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করতেন নওশাদ।

মেহেদি হাসান বলেন, কেটামিন মূলত অস্ত্রোপচারের রোগীকে অজ্ঞান করতে নির্দিষ্ট মাত্রায় ব্যবহার করেন চিকিৎসকেরা। এটা চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া বিক্রির কোনো সুযোগ নেই। নওশাদ কিছু অসাধু ওষুধ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে এটা সংগ্রহ করতেন।

কেটামিনকে ভয়ংকর মাদক হিসেবে বর্ণনা করেছেন ডিএনসির প্রধান রাসায়নিক কর্মকর্তা দুলাল কৃষ্ণ সাহা। তিনি বলেন, এই মাদক কেউ সেবন করলে বাস্তব জ্ঞান লোপ পায়। অনেকটা কল্পনার জগতে চলে যান তিনি। দীর্ঘদিন এটা সেবনে স্মৃতিবিভ্রম, কিডনি বিকল হওয়াসহ নানা জটিলতা তৈরি হতে পারে।

কৌশলে এই মাদক সেবন করিয়ে তরুণীদের ধর্ষণ করার ঘটনা ঘটেছে বলে জানান দুলাল কৃষ্ণ সাহা। তিনি বলেন, বিভিন্ন পার্টিতে তরুণীদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে কেটামিন সেবন করানো হয়। মূলত কোমল পানীয়ের সঙ্গে পাউডারজাতীয় মাদকটি মিশিয়ে সেবন করালে অনেকে সেটি বুঝতে পারেন না। এটি সেবনের পর অনেকের স্বাভাবিক জ্ঞান থাকে না। তখন তাঁদের সঙ্গে অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে।

চেতনানাশক ইনজেকশন কেটামিন থেকে তৈরি করা এই মাদক ঢাকার গুলশান–বনানীর ধনাঢ্য পরিবারের তরুণদের কাছে সরবরাহ করে আসছিলেন সৈয়দ নওশাদ

চেতনানাশক ইনজেকশন কেটামিন থেকে তৈরি করা এই মাদক ঢাকার গুলশান–বনানীর ধনাঢ্য পরিবারের তরুণদের কাছে সরবরাহ করে আসছিলেন সৈয়দ নওশাদ
ছবি: সংগৃহীত

ডিএনসির একজন কর্মকর্তা জানান, নওশাদ দীর্ঘদিন ধরে মাদক সেবন করেন, সেটি পরিবারের সদস্যরা জানতেন। তবে পরিবারের সম্মানের কথা চিন্তা করে তাঁরা বিষয়টি গোপন করেছেন। নওশাদ একজন আইনজীবীকে বিয়ে করেছিলেন। মাদকের কারণে তাঁর সেই সংসার টেকেনি। নওশাদ দাবি করেছেন, তিনি মতিঝিলে একটি প্রতিষ্ঠানে উচ্চ বেতনে চাকরি করেন। তবে তাঁর বাবা জানিয়েছেন, নওশাদ কিছুই করতেন না।

নওশাদের বাবা জানিয়েছেন, নওশাদকে কয়েক বছর আগে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে তাঁর উন্নতিও হয়েছিল। নওশাদের স্ত্রীর অনুরোধে তাঁকে ফিরিয়ে আনা হয়। পরে আবার মাদকাসক্ত হওয়ার কারণে স্ত্রী–ও তাঁকে ছেড়ে চলে গেছেন।

পাচার হয় কেটামিন

ডিএনসির কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে কেটামিন মাদক হিসেবে বহুল প্রচলিত নয়। অর্থাৎ এটি এখনো ব্যাপক আকারে ছড়ায়নি। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এই মাদক ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। সেখানে এটি ‘পার্টি ড্রাগ’ বা ‘ডেট রেপ ড্রাগ’ নামে পরিচিত। এই মাদক দেশের মাদকসেবীরা গ্রহণ করছেন, এমন তথ্য তাঁদের কাছে ছিল না। নওশাদকে গ্রেপ্তারের পর অভিজাত এলাকার বিভিন্ন পার্টিতে এই মাদক ব্যবহারের তথ্য পাওয়া গেছে।

ডিএনসির কর্মকর্তা মেহেদি হাসান বলেন, এর আগে একটি কেটামিনের চালান ধরা পড়ার কথা তাঁরা জানেন। সেটি বিদেশে পাচার করা হচ্ছিল। এবার দেশেই কেটামিন মাদক হিসেবে ব্যবহারের তথ্য তাঁরা পেয়েছেন।

কর্মকর্তারা জানান, ইউরোপে এই মাদকের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তবে সেখানে এটা সহজলভ্য নয়। সে কারণে বাংলাদেশ থেকে বিশেষ কৌশলে তরল কেটামিন পাচার করছেন মাদক কারবারিরা। এর আগে ২০১৭ সালে ঢাকার মিরপুর থেকে আন্তর্জাতিক মাদক চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছিল র‌্যাব। তখন র‌্যাব জানিয়েছিল, নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় তরল কেটামিন তোয়ালেতে মেশানো হতো। সেটি দেখে কেউ বুঝতেই পারতেন না তোয়ালেতে কেটামিন রয়েছে। কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে বিদেশে পাচারের পর সেটিকে বিশেষ কৌশলে আবার তরল কেটামিনে রূপান্তর করা হতো।

আহমদুল হাসান

ঢাকা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.