পুরান ঢাকার ‘ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল’-এর প্যাথলজি ল্যাবের সামনে হৈ-হুল্লোড়। জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তি আর তাদের স্বজনের চিৎকার। ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে যেতেই কানে এলো এক নারীর ক্ষুব্ধ কণ্ঠ- ‘পরীক্ষা করাবার পারবেন না, রক্ত নিলেন কেন?
আমার ছেলের রক্ত ফেরত দেন।’
ঘটনা জানতে চাইলে ল্যাবের কেউই কথা বলতে চাইলেন না। অবশ্য আফরোজা বেগম নামে ওই নারী বলছিলেন, শনিবার ডেঙ্গু শনাক্তের জন্য তার ৪ বছরের ছেলের রক্তের নমুনা দিয়েছিলেন। গতকাল রোববার সকালে রিপোর্ট দেওয়ার কথা থাকলেও এখন বলা হচ্ছে, কিটস নেই। এ জন্য রক্ত পরীক্ষা করা হয়নি।
আফরোজাসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেও মিলল প্রায় অভিন্ন চিত্র। কেউ রক্তের নমুনা দিয়ে বসে আছেন, কেউ ব্যাংক কাউন্টারে রক্ত পরীক্ষার টাকা জমা দিয়ে নমুনা দিতে অপেক্ষা করছেন। তবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার হলেও কিছুই হচ্ছে না। ততক্ষণে রোগীর স্বজনদের তোপের মুখে ল্যাবের লোকজন চলে গেলেও সেখানে রক্তের নমুনা দেওয়ার জন্য বসে ছিলেন ১০ থেকে ১২ জন। তাদেরই একজন টিকাটুলির বাসিন্দা আমির হোসেন বলছিলেন, তিন দিন ধরে জ্বরে ভুগছেন। তার এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে রক্ত পরীক্ষা করতে গেলেও তা পারেননি। শেষ পর্যন্ত এখানে এসেও রক্ত দিতে পারেননি। এখন মরণ ছাড়া আর তো কোনো পথ নেই।
শুধু পুরান ঢাকার স্বায়ত্তশাসিত এই হাসপাতাল নয়; ওই এলাকার বেসরকারি সুমনা হাসপাতাল এবং সরকারি মিটফোর্ড হাসপাতাল ঘুরেও দেখা গেল ডেঙ্গু নির্ণয়ে রোগী আর তাদের স্বজনদের হাহাকার। এক হাসপাতালে রক্ত পরীক্ষা করাতে না পেরে অন্য হাসপাতালে ছুটছেন তারা। অন্য হাসপাতালেও ব্যর্থ হয়ে আতঙ্কিত হচ্ছেন
স্বজনেরা। সব হাসপাতাল থেকেই তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। শুনতে হচ্ছে- ‘কিটস না থাকায় ডেঙ্গু নির্ণয় করা যাচ্ছে না।’ এ অবস্থায় এসব মানুষ কী করবেন, তাও বুঝতে পারছেন না।
পরিস্থিতি জানতে ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের প্যাথলজিক্যাল বিভাগের প্রধান চিকিৎসক ফারহা শারমিনের কক্ষে গিয়ে তাকে পাওয়া গেল না। দীর্ঘ অপেক্ষার পরও কেউ বলতে পারেননি তিনি কোথায় আছেন। তবে হাসপাতালের উপপরিচালকের কক্ষে পাওয়া গেল এ চিকিৎসককে। তিনি জানালেন, রোগীর স্বজনেরা বিক্ষোভ করছেন। কিটস না থাকায় তিনি রক্ত পরীক্ষা করতে পারছেন না। এ অবস্থায় তাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
হাসপাতালের উপপরিচালক একেএম নুরুন্নবী বলেন, চাহিদার তুলনায় তাদের কাছে কিটস নেই। এ জন্য রক্তের নমুনা পরীক্ষা করতে পারছেন না। তার ওপর হাসপাতালে গতকাল রোববার পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত নারী-শিশুসহ ১১৭ জন চিকিৎসাধীন। তাদের নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে।
হাসপাতালটির ব্যবস্থাপনা বোর্ডের এক সদস্য গাজী সারোয়ার হোসেন বাবু বলেন, হাসপাতালে মেডিসিন বিভাগে মাত্র ৩০টি শয্যা রয়েছে। এর বিপরীতে তারা শতাধিক ডেঙ্গু রোগীকে চিকিৎসা দিচ্ছেন। আজকালের মধ্যে ৪০ শয্যার ডেঙ্গু ওয়ার্ড চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, দেড় থেকে দুইশ’ টাকার কিটস এখন ৫০০ টাকাতেও পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগেও বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও সরবরাহকারীদের কাছ থেকে কিটস সংগ্রহের চেষ্টা করছেন। তবে চাহিদামতো পাচ্ছেন না।
৭০ শয্যার হাসপাতালে ৫০ জনই ডেঙ্গু রোগী :পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলী সড়কে বেসরকারি সুমনা হাসপাতালে কেবিন মিলিয়ে রোগীর শয্যা ৭০টি। এর মধ্যে গতকাল দুপুর পর্যন্ত সেখানে ভর্তি থাকা রোগীদের ৫০ জনই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। হাসপাতালটির প্যাথলজি বিভাগে প্রতিদিন গড়ে ৩০ জন ডেঙ্গু শনাক্তে রক্তের নমুনা পরীক্ষার জন্য আসেন। এর মধ্যে গড়ে তিনজনের শরীরে ডেঙ্গু পাওয়া যাচ্ছে। তবে গতকাল থেকে কিটস না থাকায় সেই রক্তের নমুনাও নেওয়া হচ্ছে না।
হাসপাতালটির প্যাথলজি বিভাগের ব্যবস্থাপক জামাল হোসেন ভূইয়া বলছিলেন, শয্যা না থাকায় তারা নতুন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রাখতে পারছেন না। অন্যান্য রোগীও ভর্তি রাখা যাচ্ছে না। কিটসের সরবরাহ না থাকায় রক্তও পরীক্ষা করা যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে তারা রোগী ফিরিয়ে দিচ্ছেন।
প্যাথলজি বিভাগের অপর এক কর্মী বলছিলেন, আগে ডেঙ্গু শনাক্তের একটি কিটস বা রি-এজেন্ট ২০০ টাকায় কেনা হতো। ডেঙ্গু নির্ণয়ে তারা ১২শ’ টাকা নিতেন। এখন সরকার ৫০০ টাকা বেঁধে দিয়েছে। তবে ৮০০ টাকাতেও কিটস পাওয়া যাচ্ছে না।
শেষ ভরসার সরকারি হাসপাতাল থেকেও ফিরে যেতে হচ্ছে রোগীদের :স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকার মানুষ ছাড়াও কেরানীগঞ্জের বিশাল এলাকা থেকে শুরু করে মুন্সীগঞ্জের মানুষও চিকিৎসা নেয়। চিকিৎসার শেষ ভরসা সরকারি এই হাসপাতালেও গতকাল থেকে ডেঙ্গু নির্ণয় করতে এসে ফেরত যেতে হয়েছে শত শত মানুষকে। সকালের দিকে রক্তের কিছু নমুনা পরীক্ষা করা হলেও কিটস শেষ হয়ে যাওয়ায় দুপুরের আগেই তা বন্ধ হয়ে যায়।
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়া এলাকা থেকে জ্বরাক্রান্ত স্ত্রী সুফিয়া বেগমকে নিয়ে এসেছিলেন পেশায় অটোরিকশা চালক হুমায়ুন কবির। তিনি বলছিলেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে তার স্ত্রীকে মিটফোর্ড হাসপাতালে রক্ত পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। তবে এখানেও কেউ রক্ত পরীক্ষার জন্য নমুনা নিচ্ছে না। বলা হচ্ছে, রক্ত পরীক্ষার যে ওষুধ লাগে, তা শেষ হয়ে গেছে। এখন তিনি কী করবেন, বুঝতে পারছেন না।
হাসপাতালটির বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেল, ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের শিশু ও সাধারণ রোগীদের পাশাপাশি শয্যায় রাখা হয়েছে। যাকে যেখানে জায়গা দেওয়া গেছে, তাকে সেখানেই স্যালাইন পুশ করে রাখা হয়েছে। গতকাল বিকেল পর্যন্ত হাসপাতালটিতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ৪২৮ জন ভর্তি রয়েছে। এর মধ্যে গতকাল সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছে ৯৭ জন। গতকাল ভোরে শেফালী বেগম (৫০) নামে একজন মারা গেছেন। তার বাড়ি কেরানীগঞ্জের নগরমহলে।
মিটফোর্ড হাসপাতালের সহকারী পরিচালক আবদুর রশিদ বলেন, কিটস না থাকায় বহির্বিভাগে রক্তের নমুনা পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। এ জন্য তারা বাধ্য হয়ে রোগ নির্ণয় ছাড়াই লোকজনকে ফেরত পাঠাচ্ছেন। কিটস সরবরাহ স্বাভাবিক হলে আবারও পরীক্ষা শুরু হবে। এ চিকিৎসক বলেন, প্রতিদিন গড়ে সাড়ে চারশ’ মানুষের ডেঙ্গু নির্ণয়ের জন্য রক্তের নমুনা নেওয়া হয়। এর মধ্যে মাত্র ২৫ ভাগ মানুষের ডেঙ্গু ধরা পড়ছে। মানুষ আতঙ্ক থেকেও রক্তের নমুনা পরীক্ষা করতে দিচ্ছে। এ কারণেও কিটস সংকট দেখা দিয়েছে।