কেউ নেই, তবু কারও গলার আওয়াজ বৃষ্টির ছাট পেরিয়ে উঠে আসছে কানে

0
92
বর্ষার বৃষ্টি

বর্ষা এলে মনে পড়ে প্রেম হারানো দিনের কথা—প্রেমিকার কথা, জলের মতো মায়ের কথা। আরও না–থাকা অসংখ্য মুখের স্মৃতিও কি এসে থই থই করে না এই মেঘলা দিনে?

গুড় গুড় করে মেঘ ডাকছে দূরে। বর্ষা এসেছে। চালতাফুলের মতো ফুটে উঠছে সাঁঝ। যূথীবনের ভেতর থেকে ভিজে হাওয়ায় ডেকে উঠছে ঝিঁঝি পোকার দল। শ্যামাসুন্দরী বা সূবর্ণদহ নামে এখানে কোনো নদী নেই। তবু ঘন বর্ষা এসে সেই সব নদীতে জল দেবে, মায়ের মতো দুগ্ধ দেবে। আর অপরিমেয় সম্ভারে ফুলে উঠবে তারা। জলের গা ছুঁয়ে খেলা করতে করতে বহুদূর পেরিয়ে যাবে জলের সন্তান। এসব ভেবে শান্ত চোখের ভেতর ছাপিয়ে উঠছে জল, জলের স্মৃতি। কেউ নেই, তবু যেন কারও গলার আওয়াজ বৃষ্টির ছাট পেরিয়ে উঠে আসছে কানে। পুরোনো মানুষ, ছবি—সব যেন স্পষ্ট হয়ে উঠছে চোখের ভেতর, রাঙা মেঘের মতো, বর্ষা যেমন।

বর্ষার সঙ্গে কীভাবে যেন জড়িয়ে আছে প্রেম-বিরহ ও কাম। জড়িয়ে আছে বিষণ্ন হাহাকার আর না–থাকা মুখের স্মৃতি। এ ঋতু প্রেমের ঋতু। তাই বুকের ভেতর দ্রিমি দ্রিমি বেজে ওঠে প্রেম-হাহাকার। বৃষ্টির সঙ্গে কখনো বাগেশ্রী, কখনোবা মল্লারের সুরে এসব স্মৃতি এসে নিভিয়ে দিয়ে যায় ভেতরের কাঁচা রোদ। এসব কি জানে শ্রাবণের মেঘের দল?

কালিদাসের ‘মেঘদূত’-এ রামগিরি পর্বতে নির্বাসিত কান্তাবিরহী যক্ষের কথা মনে আছে? ঐশ্বর্যের দেবতা কুবেরের পূজার ফুল তোলার দায়িত্ব ছিল তার। প্রেমিকার সঙ্গ ছাড়তে না পেরে দায়িত্বে অবহেলা করে যক্ষ। এ অপরাধে কুবের তাকে নির্বাসনে পাঠান। রামগিরিতে নির্বাসনে থেকে প্রেমিকার বিরহে কাতর যক্ষ। এমন সময় আষাঢ়ের প্রথম দিন পাহাড়ের দিকে সঞ্চারিত মেঘরাশি দেখে অলকানগরীতে থাকা প্রেমিকার কথা মনে পড়ে তার। সে জানে, এই মেঘ ভেসে যাবে অলকায়, যাবে প্রেমিকার দৃষ্টিসীমায়।

তাই মেঘকে দূত হিসেবে প্রেমিকার কাছে প্রেমবার্তা পাঠানোর মনস্থির করে যক্ষ। বার্তা পাঠিয়ে অপেক্ষায় থাকে। মেঘ রেবা, শিপ্রা ও বেত্রবতী নদীর ওপর দিয়ে উজ্জয়নী, অবন্তি ও বিদিশা নগরী পেরিয়ে যায়। মন্দারগাছ, বহু পর্বত ও কেতকীবন পেরিয়ে একসময় বার্তা নিয়ে মেঘ পৌঁছে যায় যক্ষপ্রিয়ার কাছে।
বর্ষা এলে নিজেকেও কেমন যক্ষের মতো হয়। মনে পড়ে প্রেম হারানো দিনের কথা—প্রেমিকার কথা, জলের মতো মায়ের কথা। আরও না–থাকা অসংখ্য মুখের স্মৃতি এসে থই থই করে। জলের চেয়ে কোমল হয়ে আসে সেই সব স্মৃতি। ভিজিয়ে দিয়ে যায়। উবু হয়ে সেই জলে দেখি বর্ষা ও স্মৃতির সম্পর্ক।

দেখি একা নই, হাহাকার নিয়ে জলের ভেতর, সম্পর্কের ভেতর ভাগ হয়ে আছি একা আমি। এই হাহাকার কি শূন্যে ভেসে থাকা মেঘের দল পৌঁছে দেয় কোথাও?

মেঘের দল যদি এসব বার্তা না–ও পৌঁছায়, ক্ষতি নেই। মেঘের না পাঠানো বার্তার কথা ভেবে তবু অপেক্ষায় থাকি। সেই অপেক্ষার পর বর্ষা আসে। বর্ষার জলের মহিমার কাছে আমি নতজানু হয়ে থাকি।

টিউন বাড়ানো জলের স্মৃতি

শ্রাবণ মেঘের ডানা মেলে শ্যামাসুন্দরী বা সূবর্ণদহ নদে ঘন বর্ষা এসে দিত মায়ের মতো দুগ্ধ। চনমনে হয়ে উঠত নদী-জলা-দিঘি। জুবেরি মাঠের শানবাঁধানো দিঘিতেও থই থই করত সেই জল। মেঘ ডাকলেই দিঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে প্রেমিক সেজে অপেক্ষায় থাকত এক তরুণ যক্ষ। বৃষ্টিতে ভিজে একদিন দেখা মেলে প্রেমিকার। কারও মুখে কোনো কথা নেই; বলা হয়নি, ‘শোনো আনমনা’। দুরূহ স্তব্ধতা। অনভ্যাসে ফুরিয়ে যাওয়া কথা যেন সেদিন নির্জনে বলে দিয়েছিল ঝিরিঝিরি জল। সেই থেকে যক্ষ জেনেছে, শুরু আর শেষ প্রেমিক-প্রেমিকার মতো হাত ধরে থাকে। না–বলা কথা নিয়ে বৃষ্টি থামার আগেই আনমনা ফিরে গেছে ঘরে। বৃষ্টির টিউন বাড়ানো জলে ডুকরে ওঠার শব্দ গিলে যক্ষের ভিজে গেছে ভেতর-বাহির।

অভিমানে আকাশের দিকে তাকিয়ে যক্ষ কেবল বলেছে, ‘বৃষ্টি তুমি নামো, এসো নবধারাজল, আমাকে ধ্বংস করো, জারুল ফুল কিংবা নির্জন জলের গর্ভে জন্ম দিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাও বহুদূরে।’ এরপর বহু বর্ষা পেরিয়ে গেছে, সেই প্রেমিকা কি জানে, ডুকরে ওঠার শব্দ চুপচাপ গিলে নেওয়া ব্যথার কোনো নিরাময় নেই?

চিৎকার ভেঙে হিম নামছে চোখের পাতায়। চুমু দিয়ে চোখ থেকে তুলে নিচ্ছি আয়ু। জল সরিয়ে দেখছি—ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে প্রজাপতি। আর অনন্ত হয়ে ঢুকে যাচ্ছে মা, এই চোখের ভেতর।

দীর্ঘ শ্রাবণ ছিল মা

অনন্ত বর্ষাকাল ছিল মা। বলেছিল, যেখানেই থাকো ফিরে এসো সূর্যাস্তের আগে। অথচ দেখেছি, ঝুম জুলাইয়ে সূর্যোদয়ের আগেই নিঝুম অস্তের দিকে চলে যাচ্ছে মা। পাশে বৃষ্টির সুর দিয়ে ব্যথা সারাইয়ের চেষ্টা করছে বাবা, করুণ ও নির্জন। হাত দিই, দেখি মার বুকের ভেতর প্রজাপতিদের ডানার ধড়ফড়।

চোখ বুজে প্রার্থনা করি—হে বৃষ্টির ঝুম, মেঘ-হাওয়া-জল ও নামহীন পাখি, চিৎকার করে বলো, কথা আছে খুব। রোগহীন করো প্রাণ। নিরাময়, নিরাময় দাও।

ভেঙে যাচ্ছে চুপ। সমস্ত অক্ষমতা নিয়ে হাত ছুঁয়ে আছে মা। ইশারায় জানিয়েছে, প্রজাপতির ওড়ার অপেক্ষায় আছি। চোখে রাখা আছে আয়ু।

জাদুরে শেষবার চুমু দাও চোখে। চুমু দাও একবার। চুমু দিয়ে তুলে নাও সমূহ আয়ু আমার। নিশ্চিন্তে অস্তের দিকে ভেসে যাই ঝিরিঝিরি জলে।
চিৎকার ভেঙে হিম নামছে চোখের পাতায়। চুমু দিয়ে চোখ থেকে তুলে নিচ্ছি আয়ু।

জল সরিয়ে দেখছি, ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে প্রজাপতি। আর অনন্ত হয়ে ঢুকে যাচ্ছে মা, এই চোখের ভেতর।

মেঘ, যদি দেখা হয়, তাহলে জেনে এসো, মা কি শেষ করেছে তার পুরোনো শাড়িতে নতুন কাঁথার সেলাই!

ছবি: সৈয়দ লতিফ হোসাইন

মাউথ অর্গানের সুর ও হারানোর ভঙ্গিমা

হনুমানতলার মোড়ে বুড়ো বটগাছের ছায়ায় নাম না–জানা যে লোকটি কিছু কাগজ আর টিয়া পাখি নিয়ে বসে থাকতেন, বহুদিন তাঁর কোনো খোঁজ জানি না। দুই টাকার বিনিময়ে অর্ধেক পালক খসা, আধপেটা টিয়া পাখি মানুষের ভবিষ্যৎ বলে দিত। নিজের রাশিফল আর ভবিষ্যৎ বৃষ্টির কথা জানা ছিল না পাখির।

তাই বৃষ্টি এলে কাগজ-পাখি আর নিজের অন্ধকার মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে লোকটি থাকতেন ঝুপড়ি দোকানের চালার নিচে। বৃষ্টি শেষের আলোয় লোকজন কমে গেলে বটগাছের ছায়া এড়িয়ে পাটি পেতে শুয়ে পড়তেন তিনি। তাঁর মাথার কাছে যত্নে রাখা পাখির খাঁচা। এরপর আকাশের দিকে তাকিয়ে পুরোনো, কিছুটা ক্ষয়ে যাওয়া মাউথ অর্গানে সুর তুলতেন কান্নার মতো। একসময় চিকলি বিলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে হারিয়ে যেতেন কোথাও। তাঁকে কাছের বন্ধু বলে ভাবতে ভালো লাগত। বহু বর্ষা ঋতু পেরিয়েও তাঁর অন্ধকার মুখ মনে পড়ে, হারানোর ভঙ্গিমা আর মনে পড়ে ভেবে নেওয়া বন্ধুর মাউথ অর্গানে কান্নার সুর।

ছবি: সৈয়দ লতিফ হোসাইন

বন্ধু কেমন আছ

প্রিয়রঞ্জন, আমার প্রিয় দা। ঠিক ছিল বন্ধুর মতো। কাঠ কুঁদে কী দারুণ নারীমুখ এঁকে রাখে। কী নিপুণ কাজ তার! সারা দিন বকুলতলায় বসে আপন মনে কাঠ কুঁদে নারীমুখ ফুটিয়ে তোলে। কিন্তু বর্ষা এলে তার দুর্দশার অন্ত ছিল না। খড়ের ঘরের চালা ফুটো হয়ে ভিজে যেত তার শিল্পকর্ম, ভিজে যেত চোখ।

বৃষ্টিতে একদিন তার চালায় ঢুকে দেখি, বড় একটা কাঠ কুঁদে এঁকে রেখেছে না–হওয়া প্রেমিকা চানুর মুখ। এঁকেছে তার মসলিন ডানা। এঁকেছে যোনীপুষ্প। বলেছি তাঁকে, ‘প্রিয় দা কী এঁকেছ তুমি?’ বলেছে, ‘এটা নামহারা পাখি। আর এই যে তার দুটো মখমলি ডানা, এই যে তার ফুল।’

একদিন সন্ধ্যার উলুধ্বনি শেষে ধূপের গন্ধে ভারী হয়ে ওঠে চারদিক। আনন্দলোক শ্মশানের কাছে গাছের ডালে সার্কাসের দড়ির মতো সেন্টার রিংয়ে উল্টো হয়ে ঝুলে আছে চানু। অনিচ্ছার রণ ও রমণে ছিঁড়ে গেছে তার মসলিন ডানা, কেউ ছিন্নভিন্ন করেছে তার পুষ্প। এই অভিমান নিয়ে কাঠ কুঁদে এঁকে রাখা মানুষের মুখ শ্রাবণের জলে ভাসিয়ে দিয়েছে প্রিয় দা। নাম হারানো পাখির খোঁজে ঘর থেকে বেরিয়ে আর ফেরেনি এদিকে। মেঘ, এই বর্ষায় কেমন আছে বন্ধু আমার!

ছবি: সৈয়দ লতিফ হোসাইন

যে শেখাল জলের বর্ণমালা

বউচি খেলার সাথি তুনাই। যে শিখিয়েছে জলের বর্ণমালা, যে শিখিয়েছে আকাশ থেকে খসে পড়া নক্ষত্র ফুটে থাকার ঠিকানা, সে এখন আর পাতার নৌকা ভাসায় না সূবর্ণদহর জলে। গেয়ে ওঠে না অন্তর্ভেদী গান। হয়তো ছিল, তবু আমাদের মাঝে কথা আর নেই। শুনেছি, ঝমঝম বৃষ্টির ভেতর দশমীর রাতে পুঁটিদির ছেলে শ্যামল তাকে ছুঁয়ে দিয়েছিল। তার গায়ে জোর করে এঁকেছিল আগুনের ক্ষত। এই ঘিনঘিনে ক্ষত আর দহন মুছে নিতে ভোরের আলো ফোটার আগেই তুনাই নেমেছিল সূবর্ণদহর জলে।

তারপর ক্রমাগত নিচে নেমে চলে গেছে না–ফেরার কাছে।

সে বলেছিল, নক্ষত্র ডুবে গেলে খুব মেঘ করে আসে। এই ভারী মেঘ নিয়ে আর একান্ত ঘরে যাওয়া হয় না। ঘরে ফেরার পথ আর নেই। ধীরে, নিঃশব্দে পেরিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। মেঘ জানে, তবু সূবর্ণদহর তীর পেরিয়ে জলের কিনারে যাই, জল নড়ে ওঠে। অস্ফুটে ডেকে উঠি—তুনাই তুনাই…

সুজন সুপান্থ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.