বড় ক্ষতি নতুন রেলপথের

0
102
তলিয়ে গেছে বৃহত্তর চট্টগ্রাম। সড়ক ও ফসলের ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে নতুন রেললাইনও। বুধবার সাতকানিয়া এলাকায় - সংগৃহীত ছবি
  • পেছাতে পারে সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকায় নির্মিত এ রেলপথের উদ্বোধন
  • বাঁধ ও পাথর ভেসে গিয়ে রেলট্র্যাকও হতে পারে আঁকাবাঁকা
  • রেলওয়ের দাবি, পানি নিষ্কাশনে বাধা নেই

উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকা সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকায় নির্মিত চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার রেলপথ বন্যায় ডুবেছে। যে বাঁধের (এমব্যাংকমেন্ট) ওপর রেলপথ তৈরি করা হয়েছে, সেটির মাটি ও রেললাইনের পাথর (ব্যালাস্ট) বানের তোড়ে ভেসে বড় ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। স্থানীয়দের ভাষ্য, তাদের ক্ষতিও বাড়িয়েছে নতুন রেলপথটি। বাঁধ, রেললাইনের সেতু ও কালভার্টে পানি আটকে বন্যার ভয়াবহতা বেড়েছে। এ দাবি নাকচ করলেও রেলওয়ে জানিয়েছে, বন্যার ক্ষতির কারণে সরকারের অগ্রাধিকারের (ফাস্ট ট্র্যাক) দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথের উদ্বোধন পিছিয়ে যেতে পারে।

সরেজমিন দেখা গেছে, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, চন্দনাইশ; কক্সবাজারের চকরিয়া, ঈদগাহ ও রামুতে রেলপথের দুই পাশে থইথই পানি। কোথাও কোথাও রেলপথ ডুবে গেছে। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার রেলপথের কতটুকু ডুবেছে, তা জানা যায়নি।

প্রকল্প পরিচালক মো. মফিজুর রহমান বলেন, বন্যার কারণে সড়ক বন্ধ থাকায় গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে এখনই বলা যাচ্ছে না, কত কিলোমিটার রেলপথ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানি নামার পর বলা যাবে। এর পর মেরামতের বিষয়টি আসবে।

গত বছর সুনামগঞ্জ এবং সিলেট এলাকায় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় রেলপথের বড় ক্ষতি হয়েছিল। এবার দোহাজারী-কক্সবাজার সেকশনেও পানির তোড়ে বাঁধের মাটি এবং ব্যালাস্ট ওয়াশআউটের (ধুয়ে যাওয়া) শঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক। তিনি বলেন, যদি ওয়াশআউট হয়, তাহলে রেলট্র্যাক বেঁকে যাওয়ার শঙ্কা থাকে। গত বছর সুনামগঞ্জে এমনটি হয়েছিল।

রেল সচিব ড. হুমায়ুন কবীর গত সপ্তাহে জানিয়েছিলেন, এ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন উদ্বোধনের সারসংক্ষেপ পাঠানো হতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর সময় পাওয়াসাপেক্ষে সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে রেলপথটি উদ্বোধনের কথা রয়েছে।

দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার-ঘুমধুম রেলপথ সরকারের অগ্রাধিকারের ১০ প্রকল্পের একটি। আগামী জাতীয় নির্বাচনের তপশিলের আগে এটি চালুর তোড়জোড় ছিল। এখন উদ্বোধন পিছিয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। রেলওয়ের মহাপরিচালক কামরুল আহসান বলেন, পানি নামার পর ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে তা মেরামত করা হবে। অক্টোবরে উদ্বোধনের পরিকল্পনা রয়েছে।

কক্সবাজারে ট্রেন নেওয়ার প্রকল্পটি ২০১০ সালে সরকারের অনুমোদন পায়। তখন ব্যয় প্রাক্কলন করা হয় ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে প্রকল্পটি সংশোধন হলে খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নির্মাণ ব্যয় ১৫ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা। কক্সবাজার থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে খরচ ধরা হয়েছে ২ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা। যদিও মিয়ানমারের আপত্তিতে এই অংশের নির্মাণকাজ এখনও শুরু হয়নি। গত ৩০ জুন প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে ৮৭ শতাংশ। সেতু ও কালভার্টের কাজ এগিয়েছে ৯৯ দশমিক ৬ শতাংশ। আর বাঁধের কাজ হয়েছে ৯১ শতাংশ।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) দোহাজারী-কক্সবাজার অংশে ঋণ দিচ্ছে ১১ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা। প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষায় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান যুক্ত ছিল। অন্য বিষয়ের সঙ্গে পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা (ইএমপি) করা হয়েছিল। এর ভিত্তিতে বিস্তারিত নকশা করা হয়। সমীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বনভূমি ও বন্যপ্রাণী রক্ষা, দূষণ প্রতিরোধ এবং বৃক্ষরোপণে গুরুত্ব দেওয়া হলেও বন্যা, পানি ব্যবস্থাপনা এবং নদী গুরুত্ব পায়নি। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে এডিবিকে দেওয়া স্বতন্ত্র পর্যবেক্ষকের পরিবেশগত পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে জীববৈচিত্র্য গুরুত্ব পেলেও পানি ব্যবস্থাপনার বিষয়টি নেই। প্রতিবেদনটি তৈরি করা ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল কনসালট্যান্টের আসিফ ইমরানের বক্তব্য জানতে পারেনি সমকাল।

২০১৬ সালের মে মাসে এডিবিকে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন প্রতিবেদন দেয় রেলওয়ে। এতে বলা হয়েছে, ১০০ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার রেলপথে ১৭৭টি পানিপ্রবাহের পথ রয়েছে। ১০০ মিটারের বেশি দৈর্ঘ্যের ছয়টি বড় সেতু নির্মাণ করতে হবে। ১০০ বছরের বন্যার রেকর্ড বিবেচনায় নিয়ে পানির সর্বোচ্চ স্তরের এক মিটার উঁচু সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। কালভার্টের দৈর্ঘ্যও নির্ধারণ করা হয়েছে একই পদ্ধতিতে। জলবায়ু পরিবর্তনে ভবিষ্যতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৩০ সেন্টিমিটার বাড়লেও এই রেলপথ ডুববে না।

তবে বাস্তবতা এই প্রতিবেদনের সঙ্গে মিলছে না। রেলপথটি ডুবেছে। ২২৪টি কালভার্ট দিয়ে বৃষ্টি এবং পাহাড়ি ঢলের পানি নামছে না। এ বক্তব্য নাকচ করে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ১০০ বছরের বন্যার ইতিহাসের ভিত্তিতে সেতু ও কালভার্টের দৈর্ঘ্য নির্ধারণ করে নকশা করা হয়েছে। রেলপথের কারণে পানি আটকে বন্যা হওয়ার কারণ নেই। সাগরে স্বাভাবিকের বেশি উচ্চতার জোয়ার হয়েছে। বৃষ্টি হয়েছে রেকর্ড পরিমাণ। এ দুই কারণে পানি নামছে না।

রেলের মহাপরিচালক বলেন, রেলপথের দুই পাশের পানির উচ্চতা সমান। যদি পানি পূর্ব থেকে পশ্চিম দিক তথা সাগরের দিকে স্রোতের মতো যেত, তাহলে বলা সমীচীন হতো– রেললাইনের বাঁধের কারণে পানি আটকে বন্যা হয়েছে। চট্টগ্রাম নগরে তো রেলপথ করা হয়নি। সেখানেও পানি জমেছে। অর্থাৎ রেলপথের সঙ্গে বন্যার সম্পর্ক নেই।

প্রকল্প সূত্র জানিয়েছে, চকরিয়ায় আট ফুট উঁচু বাঁধ তৈরি করা হয়েছে। এর ওপরে বসানো হয়েছে রেলপথ। তা ডুবে গেছে। বন্যার পানির উচ্চতা ১০ ফুট ছাড়িয়ে যাওয়াকে অস্বাভাবিক ও নজিরবিহীন বলছেন স্থানীয়রা। লোহাগাড়াতেও একই দশা। এই উপজেলার আধুনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নাজিম উদ্দিন বলেন, বহু বন্যা, সাইক্লোন দেখেছি। কখনোই ঘরের চালের ওপর এভাবে পানি উঠতে দেখিনি। রেলপথের কারণে এবার পানি নামতে পারছে না। রেলপথ তৈরি হয়েছে আড়াআড়িভাবে। তাই পানি আটকে বন্যা হয়েছে দুই পাশে।

প্রকল্পের নথি অনুযায়ী, দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ৩৯টি বড় সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। ছোট সেতু ও কালভার্ট আছে ১৪৫টি। লেভেল ক্রসিং রয়েছে ৯৬টি। এগুলোর কারণে পানি নামছে না বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সামছুল হক বলেন, পানি খুব দ্রুত এলেও নামে ধীরে। নিষ্কাশনের পথে রেলের স্থাপনা তৈরি হয়েছে। রেলপথও স্থলভাগ দিয়ে গেছে আড়াআড়িভাবে। এতে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক অলক পালের অভিমত, এবারের বন্যা ভয়াবহ রূপ নেওয়ার কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর একটি প্রাকৃতিক। অন্য বছরের চেয়ে এবার বেশি বৃষ্টি হয়েছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে পাহাড়ি ঢল। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলের পানি প্রবাহিত হয় তিন নদী দিয়ে। সেগুলোর উৎপত্তি পাহাড় থেকে। পাহাড়ে প্রচুর গাছ কাটা ও চাষাবাদ বেড়ে যাওয়ায় মাটি ক্ষয়ে নদী ভরাট হচ্ছে। ফলে বৃষ্টি হলে পানি উপচে বন্যা হচ্ছে।

বন্যায় চকরিয়া, পেকুয়া, ঈদগাহ উপজেলাসহ কক্সবাজার এবং আশপাশ এলাকার লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি। স্থানীয়দের অভিযোগ, ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর এবার সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে। তারা দায়ী করছেন রেলপথকে। চকরিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ফজলুল করিম সাঈদী বলেন, অপরিকল্পিতভাবে রেলপথটি নির্মাণ করা হচ্ছে। যেখানে সেতু ও কালভার্ট প্রয়োজন, সেখানে নির্মাণ করা হয়নি। সওদাগরঘোনা খাল, মাছকাটা খাল, টাওয়ারকাড়িসহ কয়েকটি খাল দখল ও ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণ হওয়ায় পানি নামছে না।

কক্সবাজারের চকরিয়ার বড়ইতলী ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামের বাসিন্দা ৪৫ বছর বয়সী আয়াছুর রহমানের বাস নতুন রেলপথের পাশে। তিনি জানান, গত রোববার থেকে তাঁর ঘর পানির নিচে। পানি ধীরে ধীরে নামছে। রেলপথের কারণে পানি সরছে না।

পাশের ডেইঙ্গাকাটা এলাকার হামিদুল হক জানান, তিন দিন ধরে ঘরে কোমরপানি। আগেও বন্যা হয়েছে, তবে এতটা ভয়াবহ হয়নি। মঙ্গলবার সকাল থেকে পানি কমতে শুরু করেছে। তাঁরও দাবি, রেলপথ না থাকলে পানি দ্রুত নামত।

বড়ইতলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ছালেকুজ্জামান বলেন, অন্য বছর বন্যার পানি এক দিনেই নেমে যেত। এবার রাস্তাঘাট এখনও তিন-চার ফুট পানির নিচে। তাঁরও অভিযোগ, রেলপথ নির্মাণেই এ অবস্থা হয়েছে।

সারোয়ার সুমন চট্টগ্রাম, রাজীব আহাম্মদ ঢাকা, ইব্রাহিম খলিল মামুন কক্সবাজার

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.