ডলার সংকটে পণ্য খালাস বন্ধ পাঁচ জাহাজে

0
200
চট্টগ্রাম বন্দর

ডলার সংকটে দিনের পর দিন সাগরে ভাসছে পণ্যভর্তি পাঁচ জাহাজ। ১ লাখ ৩৫ হাজার ৪০১ টন তেল ও চিনিবোঝাই এসব জাহাজের কোনোটি ভাসছে ৫৬ দিন ধরে। আমদানিকারকরা এরই মধ্যে ব্যাংকে স্থানীয় টাকায় পণ্যের মূল্য পরিশোধ করে দিয়েছেন। ব্যাংক রপ্তানিকারককে এ দাম পরিশোধ করবে ডলারে। কিন্তু ডলারের অভাবে ব্যাংক তা পরিশোধ করতে পারছে না। এ কারণে বিদেশি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান জাহাজ থেকে পণ্য খালাসের অনুমতি দিচ্ছে না। পাঁচটি জাহাজের জন্য এখন প্রতিদিন জরিমানা গুনতে হচ্ছে প্রায় এক লাখ ডলার।

সাগরে এভাবে পণ্য ভাসার খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকেই। কারণ, ভোজ্যতেল ও চিনির আমদানিকারকরা বাড়তি টাকা তুলে নিচ্ছেন বাজার থেকে। বাজারে ভোজ্যতেল ও চিনির সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন তাঁরা। তাই অস্থির হয়ে উঠেছে এ দুটি পণ্যের বাজার। তিন দিনের ব্যবধানে খুচরা বাজারে এ দুটি পণ্যের দাম কেজিতে বেড়ে গেছে ১০ থেকে ১৫ টাকা। সাগরে থাকা পণ্য দ্রুত খালাস করা না হলে তেল ও চিনির দাম আরও বাড়বে বলে ধারণা করছেন পাইকাররা।

এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি শনিবার বলেছেন, ডলার সংকটে সাগরে জাহাজ ভাসার বিষয়টি সম্পর্কে তাঁরা অবগত। এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন বাণিজ্য সচিব। রমজান মাসের পণ্য আমদানিতে যাতে কোনো সংকট না হয়, সে জন্য সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত আছে। রিজার্ভ ঠিক রেখে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সঙ্গে কথাও বলেছেন তাঁরা। বিষয়টি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীও অবগত।

দেশে ভোজ্যতেল ও চিনির শীর্ষ আমদানিকারক গুটি কয়েক ব্যবসায়ী। ৬ থেকে ১০টি প্রতিষ্ঠান এ দুটি পণ্যের ৯০ শতাংশ বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। অপরিশোধিত তেল ও চিনি এনে তাঁরা দেশে পরিশোধন করেন। এতে বিনিয়োগ করতে হয় প্রচুর টাকা। তাই শীর্ষ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের হাতেই আছে দুটি পণ্যের বাজার। আমদানিকারকরা বলছেন, সাগরে পণ্য আটকে থাকলেও তাঁরা বাজারে সরবরাহ ঠিক রেখেছেন। কিন্তু পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানিকারকরা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বাজারে এখনই সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন। এ জন্য দুটি পণ্যের দাম বাড়ছে প্রতিদিন। খুচরা বাজারে এর প্রভাব পড়েছে আরও বেশি।

সাগরে আটকে থাকা এসব পণ্য আমদানি করেছে চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপ, ঢাকার মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ (এমজিআই) ও দেশবন্ধু গ্রুপ। ডলারের অভাবে ব্যাংক মূল্য পরিশোধ করতে না পারায় কিছু পণ্য খালাস করার পরেই রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বেঁকে বসে। ডলারে মূল্য না পাওয়ার শঙ্কা তৈরি হওয়ায় এক পর্যায়ে তারা পণ্য খালাস বন্ধ রাখতে বলে। এখন জাহাজগুলো অলস বসে আছে। একেকটি জাহাজের জন্য প্রতিদিন গুনতে হচ্ছে ১৬ হাজার ডলার করে। নাবিক ও ক্রুদের থাকা-খাওয়া, জ্বালানি খরচ ও ভাড়া বাবদ বাড়তি এ টাকা খরচ হচ্ছে। এতে পণ্যের পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। বিদেশে ক্ষুণ্ণ হচ্ছে দেশের সুনামও।

চিনি আটকে আছে ১ লাখ ১৭ হাজার ৫০০ টন: আটকে থাকা পাঁচ জাহাজের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আছে অপরিশোধিত চিনি। এর পরিমাণ ১ লাখ ১৭ হাজার ৫০০ টন। রমজান সামনে রেখে আগেভাগে এসব পণ্য এনেছিলেন আমদানিকারকরা। কারণ, অপরিশোধিত চিনি দেশে এনে পরিশোধন করতে আরও মাসখানেক সময় লাগতে পারে। রমজানের আগে যাতে এসব পণ্য বাজারে সরবরাহ করা যায়, সেভাবে আগেভাগে এলসিও খুলেছিলেন তাঁরা। কিন্তু এখন তাঁদের এ পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে বসেছে। ‘এমভি একিলিস’ নামে জাহাজটি এস আলম গ্রুপের ৫৫ হাজার ৬৫০ টন চিনি নিয়ে বন্দরসীমায় আসে গত ২৪ ডিসেম্বর। কিন্তু ঋণপত্রের বিল ব্যাংক ডলারে পরিশোধ করতে না পারায় রপ্তানিকারক জাহাজটি থেকে পণ্য খালাসের অনুমতি দিচ্ছে না। ‘এমভি ট্রুঅং মিন প্রসপারিটি’ জাহাজটি দেশবন্ধু গ্রুপের ৫৫ হাজার টন চিনি নিয়ে বন্দরে আসে গত ১৮ অক্টোবর। ৯২ দিনে জাহাজটি থেকে ২৯ হাজার ২৩৯ টন চিনি খালাস হয়েছে। কিন্তু ডলারে আমদানিমূল্য শোধ না করায় বাকি ২৫ হাজার ৭৫১ টন চিনি খালাস করতে দিচ্ছে না রপ্তানিকারক। ‘এমভি কমন অ্যাটলাস’ জাহাজ ব্রাজিল থেকে মেঘনা গ্রুপের সাড়ে ৬০ হাজার টন চিনি নিয়ে বন্দরে আসে ৫ জানুয়ারি। জাহাজটি থেকে ২৩ হাজার ৬৫০ টন চিনি খালাস হয়েছিল।

তেল আটকে আছে ৫৬ দিন ধরে: মালয়েশিয়া থেকে প্রায় ১২ হাজার টন পাম অয়েল নিয়ে ‘এমটি সুপার ফরটি’ জাহাজ বন্দরসীমায় আসে ২৫ নভেম্বর। ১ কোটি ২৪ লাখ ডলার মূল্যের এই তেল আমদানি করেছে চট্টগ্রামের এস আলম সুপার এডিবল অয়েল লিমিটেড। কিন্তু ডলারে মূল্য না পাওয়ায় রপ্তানিকারক পণ্য খালাস করতে দিচ্ছে না। ব্রাজিল থেকে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল নিয়ে মেঘনা গ্রুপের ‘এমটি সোগান’ জাহাজ আসে ৬ জানুয়ারি। এ জাহাজে আমদানিকারক বাংলাদেশ এডিবল অয়েল ও মেঘনা অয়েল রিফাইনারি লিমিটেডের তেল ছিল। বাংলাদেশ এডিবল অয়েলের তেল এর মধ্যে খালাস করা হয়েছে। আটকে আছে মেঘনা এডিবলের ৬২ লাখ ডলারের প্রায় ৫ হাজার টন তেল। এমটি সুপার ফরটি জাহাজ তেল নিয়ে সাগরে ভাসছে ৫৬ দিন ধরে।

ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ মানুষ: পানিতে এভাবে দিনের পর দিন পণ্য ভেসে থাকার খেসারত এরই মধ্যে গুনতে শুরু করেছেন ভোক্তারা। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, ক্ষতির টাকা পুষিয়ে নিতেই মিল মালিকরা সরবরাহ কমিয়ে দাম বাড়িয়েছেন। তবে মিল মালিকরা বলছেন, সরবরাহ স্বাভাবিক আছে। জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণবিষয়ক সংগঠন ক্যাব বলেছে, ক্ষতির এ টাকা বাজার থেকে তুলে নেওয়ায় অস্থির হচ্ছে চিনি ও ভোজ্যতেলের বাজার। ক্যাবের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘ব্যবসায়ী কখনোই পণ্যের পরিবহন খরচ বহন করে না। এ টাকা ভোক্তা থেকেই আদায় করে তারা। ডলার সংকটে পণ্য খালাস করতে না পেরে এখন বাজারে সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে তারা। সরকারকে এ অস্থিরতা দূর করতে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। বাজার নিয়ে যদি কারসাজি হয়, তবে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.