গত বুধবার দুপুরে চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলার পশ্চিম হিংগুলী এলাকার রেললাইনে শিশুটিকে প্রথম দেখেন ৩১ বছরের আশরাফুল ভূঁইয়া। আশরাফুল শিশুটিকে চিকিৎসকের কাছে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। শিশুটি সুস্থ আছে বলে জানান চিকিৎসক। এক্স-রে করা হলে তাতেও বড় কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
আশরাফুল ভূঁইয়া মুঠোফোনে বলেন, ‘আমি প্রথম দেখে ভেবেছিলাম, বাচ্চাটি মারা গেছে। কোলে নেওয়ার পর কান্না করে। শুধু কপালের এক জায়গায় একটু লাল হয়ে ছিল। আল্লাহর অশেষ রহমত ছাড়া এই বাচ্চাটির বেঁচে থাকার কথা নয়। ট্রেনের শব্দে বা ভয়ে বাচ্চাটি হয়তো অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল, তা না হলে যদি দাঁড়াত বা নড়াচাড়া করত, তাহলে সব শেষ হয়ে যেত।’
ট্রেনের চালক যা বললেন
ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা চট্টগ্রামগামী মহানগর প্রভাতি ট্রেনটি চালাচ্ছিলেন চালক হেমায়েত হোসেন।
আজ শনিবার দুপুরে কথা হলো এই চালকের সঙ্গে। প্রতিবেদকের কাছ থেকেই তিনি জানতে পারেন, শিশুটি বেঁচে আছে। এ খবর শুনে মুঠোফোনে বলেন, ‘ওহ! বাচ্চাটা বেঁচে আছে। আলহামদুলিল্লাহ। খুব ভালো একটি সংবাদ শোনালেন। ঘটনার পর থেকে আজ বলতে পারেন আমি এ পর্যন্ত এক ঘণ্টাও ঘুমাইনি। বাচ্চাটার মুখ দেখছিলাম একঝলক। আমি কিছুই করতে পারছিলাম না। কী যে কষ্ট, তা বলে বোঝাতে পারব না।’
চালক হেমায়েত হোসেন বলেন, ট্রেনটি ৭৫ কিলোমিটার গতিতে চলছিল। ২০০ মিটার আগে তিনি বুঝতে পারেন, রেললাইনে কিছু পড়ে আছে। তবে সেখানে মানুষ কি না, তা বুঝতে পারছিলেন না। পরে দেখেন, এক নারী তাঁর ছোট বাচ্চাকে নিয়ে শুয়ে আছেন। হাত দিয়ে বাচ্চাটিকে চেপে রেখেছেন।
হেমায়েত হোসেন বলেন, ‘বারবার ট্রেনের হুইসেল বাজাচ্ছিলাম, কিন্তু কোনো লাভ হলো না। ট্রেনের গতি, দূরত্ব—সব মিলে তখন ট্রেন থামানোর কোনো সুযোগই ছিল না। জীবনে ট্রেনের নিচে অনেক আত্মহত্যা করার ঘটনা দেখতে বাধ্য হয়েছি। তবে এই দৃশ্য খুব মর্মান্তিক ছিল। চোখের সামনে ঘটনা ঘটছে, অথচ আমি কিছু করতে পারছি না, কী যে অসহায় অবস্থা।’
ওই নারীর শরীরে লেগে ট্রেনের দ্বিতীয় বগির পাইপ ছিঁড়ে গেলে ঘটনাস্থল থেকে ৩০০–৪০০ মিটার দূরে গিয়ে ট্রেনটি থেমে যায় বলে জানালেন হেমায়েত হোসেন। বললেন, ‘আমি আশপাশের মানুষকে চিৎকার করে বলছিলাম, মনে হয় বাচ্চাটি বেঁচে আছে, আপনারা আগে বাচ্চাটিকে বাঁচান। যাক আল্লাহর রহমতে বাচ্চাটি বেঁচে আছে।’
শিশুটি এখন নানার কাছে
শিশুটিকে উদ্ধার করে চিকিৎসকের কাছে নেওয়া আশরাফুল ভূঁইয়া বলেন, ‘দুর্ঘটনা কেমনে ঘটেছে, জানি না। আমি আমার দুই চাচাতো ভাইকে নিয়ে দুটি মোটরসাইকেলে করে রেললাইনের কাছ দিয়ে ফিরছিলাম। ট্রেনটি অনেক জোরে হুইসেল বাজিয়ে খানিক দূর গিয়ে থেমে যায়। আমি যখন যাই, তখন বাচ্চাটির কাছে আর কেউ ছিল না। চারপাশের অবস্থা দেখে মনে হলো, দুর্ঘটনায় অন্য কেউ মারা গেছে। তবে তখন আগে বাচ্চাটি সুস্থ আছে কি না, সে চিন্তাই মাথায় ছিল। তাই প্রথমেই তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাই।’
আশরাফুল ভূঁইয়া বলেন, চিকিৎসকের কাছ থেকে ফিরে তিনি শিশুটিকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যান। তাঁর চাচাতো ভাই জামশেদ আলম বাচ্চাটিকে উদ্ধার করা হয়েছে, কোনো অভিভাবক আছেন কি না, তা জানতে চেয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেন। পরে থানা-পুলিশ, এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে বাচ্চাটিকে তার নানার হাতে তুলে দেওয়া হয়। এ সময় শিশুটির নানিসহ পরিবারের অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
আশরাফুল ভূঁইয়া জানালেন, শিশুটির নানা আজ সকালে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। নাতিকে তিনি তাঁর নিজের কাছেই রাখতে চান বলে জানান। তবে নাতির বাবাও তাকে নিতে চাচ্ছেন। শিশুটির মায়ের বয়স ৩০ বা ৩২ বছর হবে বলে জানান তাঁর বাবা।
চট্টগ্রাম রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহারুল করিম বলেন, তিনি যেখানে থাকেন আর ঘটনা যেখানে ঘটেছে, এর মধ্যে দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার। তবে ঘটনাস্থল থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা ঘটনা ঘটার পরেই সেখানে যান। ঘটনার পর ওই নারীর স্বামী বা বাবা কোনো অভিযোগ করেননি। তাই অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। আর শিশুটিকে তার নানার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
ওসি মাজহারুল করিম আরও বলেন, শিশুটির নানার আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। শিশুটির বাবা রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। তিনি বলেন, ঘটনার দিন ওই নারী স্বামী–সন্তান নিয়ে তাঁর বাবার বাড়িতেই ছিলেন। পারিবারিক কলহের কারণে ওই নারী সন্তান নিয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন বলে তাঁর ধারণা। শিশুটি বাবা নাকি নানা কার কাছে ভালো থাকবে, সে দিকটি বিবেচনা করা হবে বলছে পুলিশ।