ট্রাম্প-মামদানির বিস্ময়কর বৈঠকে যা ঘটল, হঠাৎ মামদানির এত প্রশংসার কারণ কী

0
26
হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জোহরান মামদানি। ওয়াশিংটন, যুক্তরাষ্ট্র, ২১ নভেম্বর ২০২৫ছবি: রয়টার্স

দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওভাল অফিসের বৈঠকগুলো এখন নিয়মিত আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে।

তবে গতকাল শুক্রবার দুপুরে নিউইয়র্ক সিটির নবনির্বাচিত মেয়র জোহরান মামদানিকে ট্রাম্প স্বাগত জানানোর সময় যে ধরনের আগ্রহ তৈরি হয়েছিল, তা খুব কম বৈঠকেই দেখা গেছে।

অনেকেই ভেবেছিলেন, রিপাবলিকানরা যে তরুণ রাজনীতিবিদকে ভবিষ্যতের ‘খলনায়ক’ বানানোর চেষ্টায় ছিলেন,  সেই গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী মামদানির সঙ্গে ট্রাম্পের হয়তো তীব্র বাক্‌যুদ্ধ হবে, তেমনটাই মনে করা হচ্ছিল ব্যাপকভাবে।

কিন্তু যা হলো, মোটেও তা নয়। নিচে অদ্ভুত এ বন্ধুসুলভ বৈঠকের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয় তুলে ধরা হলো।

এটি ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত বন্ধুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎ

এমন কিছু হতে পারে, কেউ কেউ আগে থেকেই ধারণা করেছিলেন। তবুও ঘটনাটি ছিল খানিকটা বিস্ময়কর; বিশেষ করে এ সাক্ষাৎ যখন হোয়াইট হাউসে ডেকে নিয়ে ট্রাম্পের মতো কারও সঙ্গে হয়।

সংবাদকর্মীরা দুই রাজনীতিককে বারবার তাঁদের মতপার্থক্য ও একে অপরের সম্পর্কে কঠোর মন্তব্যের কথা মনে করিয়ে প্রশ্ন করছিলেন।

কিন্তু দুজনই সেই সুযোগ এড়িয়ে গিয়ে মিলের জায়গাগুলোই তুলে ধরছিলেন।

ট্রাম্পের কয়েকটি মন্তব্য ছিল এমন:

‘আমি মনে করি, প্রকৃতপক্ষে তিনি (মামদানি) কিছু রক্ষণশীল মানুষকে চমকে দেবেন।’

‘ওনার কিছু ভাবনা সত্যি আমার ভাবনার মতোই।’

‘আমার ভাবনার চেয়েও বেশি বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি।’

‘আমি মনে করি, এই মেয়র কিছু দারুণ কাজ করবেন।’

বৈঠকে এক সাংবাদিক মনে করিয়ে দেন, মামদানি নির্বাচিত হলে ট্রাম্প নাকি নিউইয়র্ক সিটির তহবিল কাটার হুমকি দিয়েছিলেন। ট্রাম্প বলেন, প্রয়োজন হলে সেই কার্ড তিনি খেলবেন। তবে এখন এতে সম্ভাবনা কম মনে হচ্ছে।

ট্রাম্প বলেন, ‘আমার মনে হচ্ছে, তাকে সাহায্যই করব; ক্ষতি নয়।’

হাত মেলাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জোহরান মামদানি। হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে, ওয়াশিংটন, যুক্তরাষ্ট্র, ২১ নভেম্বর ২০২৫
হাত মেলাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জোহরান মামদানি। হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে, ওয়াশিংটন, যুক্তরাষ্ট্র, ২১ নভেম্বর ২০২৫, ছবি: এএফপি

দুই নেতার সাক্ষাতে প্রশংসা বেশি এসেছিল ট্রাম্পের দিক থেকে। তবে মামদানিও ট্রাম্পকে আক্রমণ করার সুযোগ নেননি।

ট্রাম্পের সঙ্গে মতভিন্নতা নিয়ে কথা না বলে মামদানি বেশি মন দেন তাঁর প্রিয় ইস্যু—জীবনযাত্রার খরচে।

গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যায় মার্কিন সরকার জড়িত—এমন মন্তব্য করার কথা স্মরণ করিয়ে দিলে মামদানি তা অস্বীকার করেননি। কিন্তু দ্রুত কথাটিকে আবারও জীবনযাত্রার ব্যয়ের দিকে নিয়ে যান তিনি।

দুই নেতার সাক্ষাতে প্রশংসা বেশি এসেছিল ট্রাম্পের দিক থেকে। তবে মামদানিও ট্রাম্পকে আক্রমণ করার সুযোগ নেননি।

বৈঠকের শেষ দিকে একজন সাংবাদিক ট্রাম্পকে নিউইয়র্কবাসী ভালোবাসেন কি না, প্রশ্ন করেন। মামদানি তখন ট্রাম্পের পক্ষেই সুর মেলান।

মামদানি বলেন, ‘আপনাকে আমি বলতে পারি, সাম্প্রতিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে তাঁর মনোযোগের কারণেই বেশি নিউইয়র্কবাসী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন। আমরা দুজনে মিলে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় কমানোর বিষয়ে কাজ করব, সেদিকে আমি তাকিয়ে আছি।’

মামদানিকে রক্ষায় যেন ঢাল হয়ে দাঁড়ালেন ট্রাম্প

বৈঠকে দুই নেতা শুধু একে অপরের প্রশংসা করাই নয়; মনে হচ্ছিল, ট্রাম্প যেন মামদানির হয়ে রক্ষাকবচের ভূমিকাও পালন করছেন।

এক সাংবাদিক মামদানিকে জিজ্ঞাসা করেন, তিনি আগে ট্রাম্পকে ‘ফ্যাসিস্ট’ বলেছেন কি না। ট্রাম্প নিজেই তাঁকে ‘হ্যাঁ’ বলতে পরামর্শ দেন।

ট্রাম্প বলেন, ‘ঠিক আছে, আপনি ‘‘হ্যাঁ’’ বললেই হলো। ব্যাখ্যা করার চেয়ে এটা সহজ।’

গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যায় মার্কিন সরকার জড়িত—এমন মন্তব্য করার কথা স্মরণ করিয়ে দিলে মামদানি তা অস্বীকার করেননি। কিন্তু দ্রুত কথাকে আবারও জীবনযাত্রার ব্যয়ের দিকে নিয়ে যান তিনি।

আরেকজন সাংবাদিক বলেন, মামদানি নাকি তাঁকে ‘স্বৈরাচারী’ বলেছিলেন। ট্রাম্প হেসে বলেন, ‘আমাকে তো স্বৈরাচারীর চেয়ে অনেক খারাপও বলা হয়েছে।’

আবার যখন একজন প্রশ্ন করেন, মামদানি ট্রাম্পের অভিবাসী বহিষ্কার অভিযানের সমালোচনা করেছিলেন, তখন ট্রাম্প বলেন, এটি তাঁদের আলোচনার বড় বিষয় ছিল না। যদিও গত বছর এ বহিষ্কার অভিযানই ছিল নিউইয়র্ক সিটি নিয়ে ট্রাম্পের বড় রাজনৈতিক উদ্বেগের বিষয়।

ট্রাম্প বলেন, ‘তিনি (মামদানি) অপরাধ দেখতে চান না, আমিও চাই না। আর এ বিষয়ে আমাদের সমস্যা হবে বলে আমার মনে হয় না।’

মানুষ চেনেন ট্রাম্প

তাহলে ট্রাম্প–মামদানির এত বন্ধুসুলভ আচরণের কারণ কী?

ঘটনাটি সেই পুরোনো ট্রাম্প-ধারার মতোই। রাজনৈতিক দ্বিমত থাকলেও শক্তিমান রাজনীতিবিদ ও সফল মানুষকে ট্রাম্প সাধারণত সম্মান করেন। আর এখন মামদানি ঠিক সেই রকম ব্যক্তিই। তিনি একজন বিজয়ী।

মামদানি এমনিতেই একজন প্রতিভাবান রাজনীতিক। তার ওপর তিনি দেশের এমন এক জায়গায় সফল হয়েছেন, যা ট্রাম্পের খুবই প্রিয়—নিউইয়র্কের কুইন্স।

আমার মনে হচ্ছে, তাকে সাহায্যই করব; ক্ষতি নয়।

ডোনাল্ড ট্রাম্প, মার্কিন প্রেসিডেন্ট

ট্রাম্প যে কুইন্সের এ তরুণ, সুদর্শন ও মেধাবী রাজনীতিককে পছন্দ করবেন, তা অস্বাভাবিক নয়।

রাজনৈতিক হিসাবের দিক থেকেও হোয়াইট হাউস হয়তো এখনই মামদানির সঙ্গে সংঘাতে যেতে চায়নি। কারণ, মামদানি যে ইস্যুতে সফল হয়েছেন; সেই জীবনযাত্রার খরচেই ট্রাম্প এখন সবচেয়ে চাপে রয়েছেন।

মামদানির শৃঙ্খলাবদ্ধ বার্তা দেওয়ার ক্ষমতা জানার পর হয়তো ট্রাম্প তাঁকে নিয়ে ঝামেলায় যেতে চাননি।

রিপাবলিকান কৌশলের বড় ধরনের ক্ষতি

এ বন্ধুত্বপূর্ণ দৃশ্য রাজনৈতিকভাবে রিপাবলিকানদের জন্য সম্ভাব্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাঁরা যেভাবে ঘটনা তুলে ধরছিলেন, তা ঘটল সম্পূর্ণ উল্টো; আর অনেকে এটি আশাও করেননি।

হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র ক্যারোলাইন লেভিট গত বৃহস্পতিবার বলেছিলেন, এটা অনেক কিছু বলে দেয় যে আগামীকাল (গতকাল শুক্রবার) হোয়াইট হাউসে একজন কমিউনিস্ট আসছেন। কেননা, দেশের সবচেয়ে বড় শহরের মেয়র হিসেবে ডেমোক্র্যাটরা তাঁকে বেছে নিয়েছেন।

ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স মজা করে বলেন, ‘মামদানির সঙ্গে দেখা এড়াতে তাঁর হয়তো ‘‘পেটের সমস্যা’’ হবে।’

সাম্প্রতিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে তাঁর মনোযোগের কারণেই বেশি নিউইয়র্কবাসী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন। আমরা দুজন মিলে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় কমানোর বিষয়ে কাজ করব, সেদিকে আমি তাকিয়ে আছি।

জোহরান মামদানি, নিউইয়র্কের নবনির্বাচিত মেয়র

গতকাল দুপুরে ফ্লোরিডার রিপাবলিকান সিনেটর রিক স্কট মামদানিকে ‘আক্ষরিক অর্থেই একজন কমিউনিস্ট’ উল্লেখ করে ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে ‘তিনি হোয়াইট হাউসে যাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে রাজনৈতিক শিক্ষা নিতে।’

কিন্তু সত্য হলো এমন কিছুই ঘটেনি। রিপাবলিকানদের জন্য এটি শুধু বিস্ময়কর নয়; বরং খানিকটা সমস্যারও।

কারণ, রিপাবলিকানরা বেশ কয়েক সপ্তাহ, এমনকি কয়েক মাস ধরে বলে আসছেন যে ডেমোক্রেটিক পার্টির অনেক নেতাকে তাঁরা মামদানির রাজনীতির (বাম ধারার) সঙ্গে যুক্ত করবেন। ডেমোক্র্যাটরাও এটি ভয় পাচ্ছিলেন। এ জন্য তাঁদের কেউ কেউ মামদানিকে সমর্থন দিতেও দ্বিধায় ছিলেন। কারণ, সমর্থন দিলে রিপাবলিকানরা তাঁদেরও মামদানির মতো ‘উগ্র বাম’ বলে আক্রমণ করতে পারতেন।

ট্রাম্পের নীতি আর ডেমোক্র্যাটদের কথিত ‘কমিউনিজম’-এর মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য দেখানোর জন্য এ বৈঠক ছিল রিপাবলিকানদের প্রথম বড় সুযোগ।

কিন্তু ট্রাম্প সেই কৌশলকে সম্পূর্ণভাবে নাকচ করে দিলেন।

এর মানে এ নয় যে রিপাবলিকানরা তাঁদের কৌশল থেকে সরে আসবেন। তবে কাজটি কঠিন হয়ে গেল। কারণ, এখন ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে ট্রাম্প নিজেই মামদানির পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের মিলের জায়গাগুলো তুলে ধরছেন এবং বলছেন, রক্ষণশীলরাও মামদানিকে দেখে অবাক হতে পারেন।

হাত মেলাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জোহরান মামদানি। হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে, ওয়াশিংটন, যুক্তরাষ্ট্র, ২১ নভেম্বর ২০২৫ছবি: এএফপি

এমনকি মামদানিকে ‘জিহাদি’ বলা; রিপাবলিকানদের সেই সাধারণ অভিযোগও ট্রাম্প প্রত্যাখ্যান করেন। নিউইয়র্কের রিপাবলিকান গভর্নর পদপ্রার্থী এলিস স্টেফানিক তাঁকে এ কথা বলেছিলেন কি না, জানতে চাইলে ট্রাম্প বলেন, ‘না, আমি তা মনে করি না।’

ট্রাম্প আরও বলেন, ‘তিনি (এলিস স্টেফানিক) এখন প্রচার চালাচ্ছেন, আর প্রচারে অনেক কিছু বলা হয়ে থাকে।’ এর মধ্য দিয়ে স্পষ্ট, মামদানিকে নিয়ে রিপাবলিকানদের আক্রমণকে ট্রাম্প খুব একটা গুরুত্ব দিতে চাননি।

এখন সবচেয়ে মজার প্রশ্ন হলো এই ‘কমিউনিস্ট জিহাদি’কে (রিপাবলিকানদের ভাষায়) পুরোপুরি ছাড় দেওয়ার জন্য ট্রাম্পকে নিজেদের দল থেকে কেউ কি সমালোচনা করবেন?

সিএনএন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.