তাইওয়ানের অবিবাহিত নারীরা কেন ডিম্বাণু সংরক্ষণ করছেন

0
119
ভিভিয়ান তুং। পেটে ইনজেকশনের মাধ্যমে হরমোন নিচ্ছেন। তাইপে, তাইওয়ান, ১২ জুন, ২০২৩, ছবি: রয়টার্স

বসার ঘরে পা মেলে বসেছেন ভিভিয়ান তুং। পেটের মধ্যে হাতড়ে এমন একটি জায়গা খুঁজছেন, যেখানে ইনজেকশনের সুই ফুটানো যাবে। দুই সপ্তাহ ধরে তিনি একধরনের হরমোন শরীরে নিচ্ছেন, যাতে তার ডিম্বাণু পরিপক্ক হয়।

৩৩ বছর বয়সী এই নারী তাইওয়ানের একটি ব্র্যান্ডের বিপণন পরিচালক। তিনি তাঁর ডিম্বাণুকে হিমায়িত অবস্থায় সংরক্ষণ করতে চান। তুং শুধু একাই নন, তাঁর মতো তাইওয়ানে এমন নারীদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ভবিষ্যতে তাঁরা যেন সন্তান নিতে পারেন, তাই এই সুযোগ দেওয়া হয়েছে। যদিও এখন দেশটিতে কোনো নারী অবিবাহিত অবস্থায় এই ডিম্বাণুকে ব্যবহার করতে পারেন না।

স্বশাসিত তাইওয়ানে প্রজনন হার নারীপ্রতি শূন্য দশমিক ৮৯ শতাংশ
স্বশাসিত তাইওয়ানে প্রজনন হার নারী প্রতি শূন্য দশমিক ৮৯ শতাংশ, ছবি: রয়টার্স

তুং বলেন, ‘এটি আমার বিমা নীতি। তাইওয়ানে এখন অনেক নারী স্বাধীন জীবনযাপন করেন। তাঁরা নিজেদের ক্যারিয়ারকে প্রাধান্য দিচ্ছেন এবং শুধু সন্তানের জন্য বিয়ে করতে হবে, এমনটা তাঁরা মনে করছেন না।’

তুং বলেন, ‘আমার পরিবার খুবই সহায়ক ও আমার সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তারা যখন শুনেছে আমি নিজের জন্য একটি বিমা কিনেছি, তারা খুশি হয়েছে।’

স্বশাসিত তাইওয়ানে প্রজনন হার নারীপ্রতি শূন্য দশমিক ৮৯ শতাংশ। বিশ্বের সবচেয়ে কম জন্মহারের তালিকায় দক্ষিণ কোরিয়া ও হংকংয়ের পরেই রয়েছে তাইওয়ান।

তাইওয়ানে একক নারী তাঁর ডিম্বাণু সংরক্ষণ করতে পারলেও চীনে এটি নিষিদ্ধ। তবে তাইওয়ানে একজন নারী যদি একজন পুরুষকে বিয়ে করেন, কেবল তখনই এই ডিম্বাণুকে ব্যবহার করতে পারবেন। অবিবাহিত বা সমকামীদের মধ্যে বিয়ে হলে এই ডিম্বাণু ব্যবহার করা যাবে না।

আলট্রাসনোতে দেখা যাচ্ছে ডিম্বাশয়ে ডিম্বানুগুলোর আকার কতটা বড় হয়েছে
আলট্রাসনোতে দেখা যাচ্ছে ডিম্বাশয়ে ডিম্বানুগুলোর আকার কতটা বড় হয়েছে’ ছবি: রয়টার্স

তাইওয়ানের চিকিৎসকেরা বলছেন, এসব বিধিনিষেধের কারণে মাত্র ৮ শতাংশ নারী তাঁদের হিমায়িত ডিম্বাণু ব্যবহার করে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে এই সংখ্যা প্রায় ৩৮ শতাংশ।

আইন পরিবর্তন

আইন পরিবর্তন হবে, এমনটাই আশা তুং আশাবাদী, গণতান্ত্রিক এই দ্বীপ নিয়ম বদলে ভবিষ্যতে হয়তো অবিবাহিত নারীদের সন্তানধারণের সুযোগ করে দেবে।

অস্ত্রোপচার হওয়ার আগে প্রতি দুই–তিন দিন পরপর একবার করে রক্ত পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে যেতে হয়েছে তুংকে। ডিম্বাণু কতটা বড় হচ্ছে, তা যাচাই করতে রক্ত পরীক্ষা করে হরমোনের স্তরটা দেখা হতো।

স্বশাসিত তাইওয়ানে প্রজনন হার নারীপ্রতি শূন্য দশমিক ৮৯ শতাংশ। বিশ্বের সবচেয়ে কম জন্মহারের তালিকায় দক্ষিণ কোরিয়া ও হংকংয়ের পরেই রয়েছে তাইওয়ান।

তুং বলেন, মানুষের মধ্যে প্রবণতা দেখে হয়তো কয়েক বছরের মধ্যে তাইওয়ানের আইন অনেকটা উদার হবে। অথবা মানুষের মধ্যে এ বিষয়ে যেভাবে সচেতনতা বাড়ছে, তাতে সরকার হয়তো আইনে পরিবর্তন আনবে।

ছোট্ট একটি অস্ত্রোপচারের মধ্য দিয়ে নারীর শরীর থেকে ডিম্বানু বের করে আনা হয়। অস্ত্রোপচারের টেবিলে তুং। ১৯ জুন ২০২৩
ছোট্ট একটি অস্ত্রোপচারের মধ্য দিয়ে নারীর শরীর থেকে ডিম্বানু বের করে আনা হয়। অস্ত্রোপচারের টেবিলে তুং। ১৯ জুন ২০২৩, ছবি: রয়টার্স

এশিয়ার মধ্যে তাইওয়ানই প্রথম দেশ, যেখানে সমকামীদের মধ্যে বিয়েকে বৈধতা দেওয়া হয়। ২০১৯ সালে এই বৈধতা দেওয়া হয়। আর গত মে মাসে সমকামী দম্পতিকে যৌথভাবে সন্তান দত্তক নেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়।

কিন্তু তাইওয়ানে শিশুদের মধ্যে মাত্র ৪ শতাংশ অবিবাহিত যুগলের। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে এই সংখ্যা ৪০ শতাংশ।

তাইওয়ানে একজন নারী যদি একজন পুরুষকে বিয়ে করেন, কেবল তখনই এই ডিম্বাণুকে ব্যবহার করতে পারবেন। অবিবাহিত বা সমকামীদের মধ্যে বিয়ে হলে এই ডিম্বাণু ব্যবহার করা যাবে না।

রাজধানী তাইপের শিন কং ও হু–সু মেমোরিয়াল হাসপাতালের রিপ্রোডাকশন মেডিকেল সেন্টারের প্রধান পরিচালক লি ই–পিং বলেন, তাইওয়ান রিপ্রোডাকটিভ অ্যাসোসিয়েশন ও সরকারের মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে ডিম্বাণু বিষয়ে নীতি পরিবর্তনের বেশ সম্ভাবনা রয়েছে। তবে প্রশ্ন হলো, এই পরিবর্তন আসতে কত সময় লাগবে।

লি বলেন, ‘এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যু। এখন আমাদের ঐকমত্য তৈরির জন্য অপেক্ষা করতে হবে।’

চাহিদা বাড়ছে

তাইওয়ানে ডিম্বাণু সংরক্ষণের চাহিদা বাড়ছে। ন্যাশনাল তাইওয়ান ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের এক জরিপ দেখা গেছে, তিন বছর ধরে ৩৫ থেকে ৩৯ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে এই প্রযুক্তি বেছে নেওয়ার হার বেড়ে ৮৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

ডা. লাই হাসিং–হুয়া তাইওয়ানের প্রথম ডিম্বাণু ব্যাংক স্টক ফার্টিলিটি ক্লিনিক গড়ে তোলেন। তিনি বলেন, করোনা মহামারির পর এক ডজনের বেশি কেন্দ্র চালু করা হয়েছে, যারা এই ডিম্বাণু সংরক্ষণের কাজ করে।

তাইওয়ানের শিন কং উ হো-সু মেমোরিয়াল হাসপাতালের পরীক্ষাগার এবং ডিম্বাণু সংরক্ষণ কক্ষ
তাইওয়ানের শিন কং উ হো-সু মেমোরিয়াল হাসপাতালের পরীক্ষাগার এবং ডিম্বাণু সংরক্ষণ কক্ষ, ছবি: রয়টার্স

লাই বলেন, তাইপে ও সিঞ্চুতে স্টর্কস ক্লিনিকে নতুন রোগীর সংখ্যা বছর বছর ৫০ শতাংশ হারে বেড়েছে। এই ক্লিনিকে এখন আট শতাধিক নারীর ডিম্বাণু হিমায়িত করে রাখা হয়েছে।

সিঞ্চু ও তাওইউয়ানের স্থানীয় সরকার চলতি বছর থেকে এই খাতে ভর্তুকি দিচ্ছে। এখন তাইওয়ানে এক হাজার কেন্দ্র রয়েছে, যেখানে ডিম্বাণু সংরক্ষণ করা যায়। তবে ব্যয়বহুল হওয়ায় বার্ষিক আয় ১৯ হাজার ডলারের নিচে এমন নারীদের ডিম্বাণু সংরক্ষণ বেশ কঠিন।

অস্ত্রোপচারের পর একটি কক্ষে বিশ্রাম নিচ্ছেন তুং। শিন কং উ হো-সু মেমোরিয়াল হাসপাতাল
অস্ত্রোপচারের পর একটি কক্ষে বিশ্রাম নিচ্ছেন তুং। শিন কং উ হো-সু মেমোরিয়াল হাসপাতাল, ছবি: রয়টার্স

একজন নারীকে চিকিৎসাপদ্ধতির পেছনে সব মিলিয়ে ২ হাজার ৬০০ থেকে ৩ হাজার ৯০০ মার্কিন ডলার খরচ করতে হয়। আর স্টোরেজ ফি দিতে হয় ১৬০ থেকে ৩২০ ডলার।

তুং নিজেই তাঁর এই খরচ বহন করেছেন। তবে অস্ত্রোপচারের দিন সকালে তাঁর মা–বাবা তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলেন। তখনো তুংয়ের সঙ্গে ছিল ল্যাপটপ। কারণ, শেষ মুহূর্তের কিছু কাজ বাকি রয়ে গেছে, তা সারতে হবে।

তুংকে অবচেতন করে ৪০ মিনিটের মধ্যে পুরো অস্ত্রোপচার শেষ করা হয়। অস্ত্রোপচারের পর তাঁকে দুই ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। বাড়ি ফেরার পর তুং বলেন, ‘আমার প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছে।’

তবে তুং বলেন, ‘সত্যি এখন আমি অনেক শান্তিতে আছি। ভবিষ্যতে সুযোগ হলে আমি একটি সন্তান নিতে চাই, অন্তত আমার সেই সুযোগ তৈরি হলো।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.