তারল্য সংকটে পড়ে এখন ধার করে চলছে অনেক ব্যাংক। দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে এক ব্যাংক আরেক ব্যাংক এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের ধার নিচ্ছে। গত বুধবার ব্যাংকগুলোর স্বল্পমেয়াদি ধারের স্থিতি দাঁড়ায় ৪৪ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা। সাধারণভাবে ব্যাংকগুলোকে এত বেশি ধার নিতে দেখা যায় না। আমানত সংগ্রহ কমে যাওয়া এবং ঋণ আটকে থাকা এর বড় কারণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ডলার কিনতে বড় অঙ্কের টাকা পরিশোধ করাও অন্যতম কারণ।
ব্যাংকাররা জানান, করোনা কিংবা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণ দেখিয়ে ঋণ পরিশোধে বিভিন্ন ছাড় দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আবার বড় গ্রাহকদের একটি অংশ বছরের পর বছর ঋণ বাড়ালেও টাকা ফেরত দিচ্ছে না। এতে করে ব্যাংকের নগদ প্রবাহে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি দেখানো হয় ১ লাখ ২০ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকার ঋণ। অথচ একই সময়ে দুর্দশাগ্রস্ত বা ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের পরিমাণ ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। মোট ঋণের যা ২৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ।
আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে ব্যাংকগুলো এক দিন মেয়াদি কলমানি ছাড়াও ৩৬৫ দিন পর্যন্ত মেয়াদি ধার নেয়। এসব ধার নিয়ে ৯ শতাংশ পর্যন্ত সুদ গুনতে হয়। আর বাংলাদেশ ব্যাংক সাধারণত ১, ৭, ১৪ ও ২৮ দিন মেয়াদি ধার দেয়। বর্তমানে যার সুদহার সাড়ে ৬ থেকে সাড়ে ৮ শতাংশ। গত বুধবার ১৩টি ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার করেছে। এ ছাড়া আন্তঃব্যাংক ধারের ক্ষেত্রে ১৪৯টি লেনদেন হয়েছে। বেশ কয়েকটি ব্যাংক এতে অংশ নেয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলো রেপোসহ বিভিন্ন উপায়ে ধার করেছে ৩ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ওই দিন ধারের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা। বুধবার আন্তঃব্যাংকে ধারের পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ওই দিন পর্যন্ত আন্তঃব্যাংকে ধারের স্থিতি ছিল ১৮ হাজার ৮৮৩ কোটি টাকা। অবশ্য বর্তমানের তারল্য সংকট কাটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত অর্থবছর বেশ কয়েকটি পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করে। শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে দেড় শতাংশ সুদে এসব তহবিল থেকে অর্থ পাচ্ছে ব্যাংক। তবে পুনঃঅর্থায়নে তেমন সাড়া নেই। ঝামেলা বিবেচনায় এসব তহবিলে আগ্রহ দেখায় না বলে জানা গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের কারণে রিজার্ভ থেকে গত দুই বছরে ২৩ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছে। এর বিপরীতে বাজার থেকে উঠে এসেছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। আবার উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে খরচ মিটিয়ে সঞ্চয় করার মতো টাকা থাকছে না। এতে করে গত জুন পর্যন্ত আমানত বেড়েছে মাত্র ৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ। আবার গত অর্থবছর সঞ্চয়পত্র কেনার চেয়ে বেশি ভাঙিয়েছেন ৩ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে আস্থাহীনতার কারণে কিছু ব্যাংক থেকে টাকা তুলে কাছে রাখছেন অনেকে। বেশি লাভের আশায় অনেকে আবার এমএলএম বা অবৈধ ফরেক্স ট্রেডিংয়ের মতো ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। এ রকম অবস্থায় ব্যাংকগুলো ধার বাড়িয়েছে।
অর্থনীতি বিশ্লেষক ও বেসরকারি সিটি ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক মঈনউদ্দীন বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক মেয়াদি ঋণে খেলাপি হওয়ার সময় বাড়িয়েছে। এ কারণে যথাসময়ে টাকা ফেরত আসছে না। ফলে তারল্য সংকট হবে– এটাই স্বাভাবিক। অথচ নির্বাচনের আগে সব সময়ই বিনিয়োগে স্থবিরতা থাকে। এ সময় ব্যাংকগুলোতে উদ্বৃত্ত টাকা পড়ে থাকার কথা। অথচ ব্যাংকগুলো এখন তারল্য সংকটে ভুগছে।
ব্যাংক খাতে তারল্য সংকটের বিষয়টি উঠে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে। গত ব্যাংকার্স সভায় উত্থাপিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্য কমে ৩ হাজার ৯০৯ কোটি টাকায় নেমেছে। এক বছর আগেও যা ২ লাখ ৩ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা ছিল। ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সিআরআর ও এসএলআর রাখার পর যে অর্থ উদ্বৃত্ত থাকে, তা অতিরিক্ত তারল্য হিসেবে বিবেচিত। সামগ্রিক খাতে উদ্বৃত্ত অর্থ এত কমার মানে অনেক ব্যাংক চরম সংকটে পড়েছে। বিশেষ করে শরিয়াহ্ভিত্তিক পরিচালিত পাঁচটি ব্যাংক নিয়মিত সিআরআর রাখতে ব্যর্থ হয়ে জরিমানায় পড়েছে। এ সময়ে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে টাকা তুলে হাতে রাখছেন অনেকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুন পর্যন্ত এক বছরে মানুষের হাতে টাকা বেড়েছে ৫৫ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা, বা ২৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ। জুন পর্যন্ত মোট প্রচলনে থাকা টাকার পরিমাণ উঠেছে রেকর্ড ৩ লাখ ১১ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকায়। এর মধ্যে মানুষের হাতে ছিল ২ লাখ ৯১ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা। গত বছরের জুনে প্রচলনে থাকা ২ লাখ ৫৪ হাজার ৫২০ কোটি টাকার মধ্যে মানুষের হাতে ছিল ২ লাখ ৩৬ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা। ব্যবসায়িক লেনদেনের জন্য নগদ টাকার প্রয়োজন হয়। একইভাবে দৈনন্দিন কেনাকাটা, বাড়ি ভাড়া, বিভিন্ন ধরনের বিল পরিশোধসহ নানা কারণে একটি অংশ সব সময় মানুষ নগদে কাছে রাখে। জিনিসের দর বাড়লে ব্যবসা বা ব্যক্তি টাকা রাখার প্রয়োজনীয়তা বাড়ে। এর বাইরে অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানুষ নগদে হাতে রাখে। আবার হুন্ডিতে প্রবাসী আয় বাড়লে তখনও নগদ টাকা বাড়ে।