টঙ্গীর ভোট পাল্টে দিতে পারে নির্বাচনের হিসাব

সামছুর রহমান ওমাসুদ রানা

0
166
গাজীপুর সিটি করপোরেশন

দীর্ঘদিন টঙ্গী পৌরসভার মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী আজমত উল্লা খান। টঙ্গী আজমত উল্লার নিজের এলাকা ও ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। তবে এবারের নির্বাচনে টঙ্গী এলাকার ভোট কোনো একক প্রার্থীর পক্ষে থাকবে, নাকি হিসাব-নিকাশ পাল্টে দেবে, এই প্রশ্নে ভোটের মাঠে চলছে নানা আলোচনা।

গাজীপুর সিটির নির্বাচনের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে সেখানকার রাজনৈতিক দলের নেতা, রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি ও সাধারণ ভোটারদের মতে, ২০১৩ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে টঙ্গী এলাকায় আজমত উল্লার ফলাফল ভালো ছিল না। এবার টঙ্গী এলাকায় জনপ্রিয় ‘সরকার’ পরিবারের স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছে।

পাশাপাশি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থীও টঙ্গী এলাকার। ফলে এবারও এই এলাকার ভোট আজমত উল্লার একচেটিয়া পাওয়ার সম্ভাবনা কম।

টঙ্গী ও গাজীপুর পৌরসভা এবং কোনাবাড়ি, কাশিমপুর, গাছা, পূবাইল, কাউলতিয়া ও বাসন—এ ছয় ইউনিয়ন নিয়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠা হয়েছে ২০১৩ সালে। গাজীপুর সিটির মোট ভোটার সংখ্যা ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৭৬। মোট ভোটারের ৩০ শতাংশের মতো ভোটার টঙ্গী এলাকার। ফলে টঙ্গী এলাকার ভোট নির্বাচনের ফলাফলে বড় ভূমিকা রাখবে।

গাজীপুর সিটি করপোরেশন গঠিত হওয়ার পর প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৩ সালে। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লা খান। এর আগে তিনি ১৮ বছর টঙ্গী পৌরসভার মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন। ফলে টঙ্গী এলাকায় আজমতের প্রভাব রয়েছে বলে রাজনৈতিক মহলের ধারণা।

তবে ২০১৩ সালের গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফলে ভিন্ন চিত্রই উঠে আসে। ওই নির্বাচনে মোট ৩৯২টি কেন্দ্রের মধ্যে ৩৩৪টিতেই হেরেছিলেন আজমত উল্লা। এর মধ্যে টঙ্গীর ১৩৩ কেন্দ্রের মধ্যে ১০০টিতেই হারেন তিনি। ২০১৩ সালের নির্বাচনে টঙ্গী এলাকার কেন্দ্রগুলোয় তুলনামূলক ভোটও কম পড়ে। অন্য এলাকাগুলোয় যেখানে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ ভোট পড়েছিল, সেখানে টঙ্গীর অধিকাংশ কেন্দ্রে ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ ভোট পড়ে। ফলে ২০১৩ সালের নির্বাচনে টঙ্গী এলাকার ফলাফল আজমত উল্লার জন্য অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না।

বর্তমান সরকারের অধীন কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। তবে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হাসান উদ্দিন সরকারের ভাতিজা সরকার শাহনুর ইসলাম মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। তাঁর প্রতীক হাতি। হাসান উদ্দিন সরকার গাজীপুর সিটি করপোরেশনের গত নির্বাচনে বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী ছিলেন। শাহনুর ইসলামের পরিবারের রাজনীতিও টঙ্গীকেন্দ্রিক। শাহনুর টঙ্গীতেই প্রচারে জোর দিচ্ছেন। এই এলাকার বিএনপির ভোটারদের ভোট টানতে পারেন শাহনুর।

স্থানীয় সরকার নির্বাচনে টঙ্গী এলাকায় সরকার পরিবারের প্রভাব সব সময় ছিল। টঙ্গী পৌরসভা হওয়ার পর এর প্রথম চেয়ারম্যান হন হাসান উদ্দিন সরকার। পরেরবারও তিনি চেয়ারম্যান হন। টঙ্গী পৌরসভা সরকার পরিবারমুক্ত করেন এ পৌরসভার তিনবারের চেয়ারম্যান ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লা খান। গাজীপুর সিটি করপোরেশনে পরিণত হওয়ার আগপর্যন্ত তিনি এর মেয়র ছিলেন।

শাহনুর ইসলামের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়ক মোহাম্মদ আলাউদ্দিন বলেন, টঙ্গীতে সরকার পরিবার এবং বিএনপির সমর্থক বেশি। ২০১৮ সালে হাসান সরকারের ভোট ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এবার তেমন না হলে টঙ্গী অঞ্চলে নৌকার চেয়ে হাতি বেশি ভোট পাবে।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের গত নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী হাতপাখা প্রতীকে প্রায় ২৭ হাজার ভোট পেয়েছিলেন। গাজীপুরে হাতপাখার কিছু নিজস্ব ভোট রয়েছে। এবার মেয়র নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী গাজী আতাউর রহমানের এলাকাও টঙ্গী। আজমত উল্লা ও আতাউর রহমান একই ওয়ার্ডের বাসিন্দা। আতাউর রহমানও টঙ্গীকে প্রাধান্য দিচ্ছেন।

আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বলছেন, টঙ্গীতে আওয়ামী লীগের অবস্থান শক্তিশালী। দলীয় প্রতীকের এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ‘নৌকা’ অবশ্যই সুবিধা পাবে। ব্যক্তি আজমত উল্লার একটি পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি রয়েছে। এবার টঙ্গীতে আজমত উল্লা ভোটারদের টানতে পারবেন বলে তাঁরা মনে করেন।

আজমত উল্লা খানের নির্বাচনের প্রধান সমন্বয়কারী ও গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউল্লাহ মণ্ডল বলেন, আগের ফলাফল কী হয়েছে, তা এখন ভেবে লাভ নেই৷ এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ আছে। টঙ্গীতে আজমত উল্লার সঙ্গে অন্য প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে মনে হয় না।

এবার গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লার জন্য চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছেন স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী ও সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন। মূল প্রতিদ্বন্দ্বী টেবিলঘড়ি প্রতীকের জায়েদাকে হারাতে নানা হিসাব–নিকাশ মেলাতে হচ্ছে নৌকার প্রার্থীকে। জাহাঙ্গীর আলমও তাঁর মাকে নিয়ে টঙ্গী এলাকায় জনসংযোগে জোর দিয়েছেন।

টঙ্গী এলাকায় প্রচারণা চালাতে গিয়ে জাহাঙ্গীর ও তাঁর মা জায়েদা খাতুন বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। অভিযোগের তির আওয়ামী লীগ প্রার্থীর দিকে। গত চার দিনে জায়েদা খাতুনের জনসংযোগে দুবার হামলার অভিযোগ ওঠে। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় টঙ্গীর পূর্ব গোপালপুর এলাকায় এবং শনিবার বিকেলে টঙ্গী পূর্ব বউবাজার এলাকায় জায়েদা খাতুনের জনসংযোগের সময় হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় গণসংযোগে ব্যবহৃত গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। ২টি হামলার ঘটনায় তাঁর ৯ জন কর্মী আহত হয়েছেন বলে জায়েদা খাতুন অভিযোগ করেন।

গত শনিবার রাতে নিজ বাড়িতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জায়েদা খাতুন বলেন, ‘৫৭টি ওয়ার্ডে গেলে সবাই ভোট দিতে চায়। কিন্তু টঙ্গীতে গেলেই হামলা করে। যে কয় দিন গেছি, হামলা হয়েছে।’

এবার টঙ্গী এলাকার ভোট ভাগাভাগি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সে কারণেই আজমত উল্লার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠা জাহাঙ্গীরের মা জায়েদা খাতুনের প্রচারে বাধা দেওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে বলে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা রয়েছে।

অবশ্য টঙ্গী এলাকার ভোটারদের নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাদের ভাবনা ভিন্ন জায়গাতেও। শিল্প এলাকা টঙ্গীর জনসংখ্যার বড় অংশ এখানকার স্থানীয় নয়। তাঁরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জীবিকার সন্ধানে এসে এখানে স্থায়ী হয়েছেন। তাঁদের কাছে আঞ্চলিকতার বিষয় নেই। কোনো প্রার্থী নির্বাচনের আগে কালোটাকা ছড়ালে ভোটের চিত্র বদলে যেতে পারে বলে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর লোকজনের আশঙ্কা।

গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউল্লাহ মণ্ডল বলেন, নির্বাচনের শেষ মুহূর্তে কালোটাকা ছড়ানো হতে পারে। এই কালোটাকা প্রতিরোধ করতে আওয়ামী লীগ মাঠেই থাকবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.