জোড়া গোলে আর্জেন্টিনার মাটিতে ‘লাস্ট ড্যান্স’ রাঙালেন মেসি

0
16
জোড়া গোল করেছেন মেসি, এএফপি

আর্জেন্টিনা ৩-০ ভেনেজুয়েলা

আর্জেন্টিনা দলের গা গরমের সময় দৃশ্যটা চোখে বিঁধতে পারে। জাতীয় দলের কালো জ্যাকেট পরে স্ট্রেচিং করছিলেন লিওনেল মেসি। একটু ভালা করে তাকাতেই বোঝা গেল, বাইরে থেকে দেখতে গা গরম করা মনে হলেও ভেতরে–ভেতরে আরও কিছু একটা হচ্ছে—তোলপাড়!

ক্যারিয়ারজুড়ে শুধু গোল করেছেন আর গোল বানিয়েছেন। কোনোকিছু ঠেকাতে তো শেখেননি। চোখের পানি আটকাতে কষ্ট হচ্ছিল মেসির। চোখ দুটি ভেজা ভেজা, যেমনটা এস্তাদিও মনুমন্তোলের টইটম্বুর গ্যালারিরও। আর্জেন্টিনার জার্সিতে দেশের মাটিতে তাঁর প্রথম ম্যাচটা ছিল ২০ বছর আগে এই স্টেডিয়ামেই। ২০০৫ সালের ৯ অক্টোবর। সেটাও  ছিল বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ঘরের মাঠে আর্জেন্টিনার শেষ ম্যাচ। দুই দশক পর সেই একই স্টেডিয়াম ও একই ‘মঞ্চ’—শুধু অনুভূতিটা আলাদা; আর্জেন্টিনার জার্সিতে দেশের মাটিতে এটাই তাঁর শেষ প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ। এএফএ প্রীতি ম্যাচ আয়োজন না করলে নিজের মানুষদের সামনে, নিজের মাটিতে এরপর আর কখনো জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চাপানো হবে না!

মনুমেন্তালের গ্যালারিতে উৎসবের ঢাকে তাই বিদায়ের রাগিনীর সুরও বেজেছে। মেসি সেই সুরে ভেসেই শুনিয়েছেন চেনা গানটি। বলা ভালো, দর্শকেরাই তাঁর হয়ে গেয়েছেন, ‘ওলে, ওলে, ওলে…মেসি, মেসি, মেসি!’

যে কেউ ওখান থেকে জোরাল শটে গোল নিশ্চিত করতে চাইবেন, কারণ, সামনে গোলকিপারসহ ভেনেজুয়েলার দুই ডিফেন্ডার। কিন্তু লোকটির নাম তো মেসি, তাই কাঁটা-কম্পাসের মাপে চিপ দেখা গেল। বলটাও বাতাসে ভাসতে ভাসতে জাল ছুঁয়ে যেন অমর কোনো চিত্রকর্মের রূপ পেল!

মেসি গোল করলে যে গানটা আর্জেন্টাইনদের জাতীয় সংগীত, কিংবদন্তি সেই সংগীত বাজালেন একবার। কিন্তু দর্শকেরা গাইলেন ম্যাচ শুরুর বেশ আগে থেকে শেষ পর্যন্ত। যদিও এই ম্যাচ কোনো দিন শেষ হোক, সেটা সম্ভবত কোনো আর্জেন্টাইন-ই চাননি!

কিন্তু শুরু থাকলে তার শেষ প্রকৃতিরই বেঁধে দেওয়া নিয়ম। বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ঘরের মাঠে শেষ ম্যাচ তো বটেই, জাতীয় দলের জার্সিতে ঘরের মাঠে শেষ প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচটা তাই খেলে ফেললেন মেসি। আর এর মধ্য দিয়ে পৃথিবীর দু-একটি প্রজন্মও হয়তো টের পেল, মেসিতে সওয়ার হয়ে দেখতে দেখতে তাদেরও আসলেই বয়স হয়ে গেছে। কিন্তু ছবিটা পাল্টায়নি। ৩৮ বছর বয়সেও মেসি পাল্টাতে দেননি। ভেনেজুয়েলার বিপক্ষে আর্জেন্টিনার ৩-০ গোলের জয়ে স্কোরশিটে তাঁর নাম, কিন্তু সেটা যে আসলে গোলের নামে তুলির আঁচড় নয়, দেখলে বিশ্বাস হবে না।

জাতীয় সংগীতের সময় মেসির সঙ্গে তাঁর তিন ছেলে
জাতীয় সংগীতের সময় মেসির সঙ্গে তাঁর তিন ছেলে,কনমেবল এক্স হ্যান্ডল

৩৯ মিনিটে সেই ক্যানভাস তৈরি করেছিলেন লিয়ান্দ্রো পারেদেস। মাঝমাঠে ভেনেজুয়েলার মিডফিল্ডারের বলের নিয়ন্ত্রণ হারানোর সুযোগ নিয়ে হুলিয়ান আলভারেজকে লম্বা পাস দেন পারেদেস। ডান প্রান্ত থেকে আলভারেজ একটু ভেতরে ঢুকে ভেনেজুয়েলার এক ডিফেন্ডারকে ডজ দিয়ে আলতো করে পাস দেন বক্সের মাঝে দাঁড়ানো মেসিকে। যে কেউ ওখান থেকে জোরাল শটে গোল নিশ্চিত করতে চাইবেন, কারণ, সামনে গোলকিপারসহ ভেনেজুয়েলার দুই ডিফেন্ডার। কিন্তু লোকটির নাম তো মেসি, তাই কাঁটা-কম্পাসের মাপে চিপ দেখা গেল। বলটাও বাতাসে ভাসতে ভাসতে জাল ছুঁয়ে যেন অমর কোনো চিত্রকর্মের রূপ পেল!

৩২৪ দিন পর আর্জেন্টিনার জার্সিতে মেসির গোল। ৭ গোল করে এবারের বিশ্বকাপ বাছাইয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় শীর্ষে থাকা লুইস দিয়াজের পাশেও বসলেন, কিন্তু সেটা বেশিক্ষণের জন্য নয়। দিয়াজ পেছনে পড়লেন ৭৯ মিনিটে। এবারও ডান প্রান্ত থেকে আলভারেজের ক্রস, বক্সের মাঝে দাঁড়ানো মেসি শুধু বাঁ পায়ের ছোঁয়ার বলের গতিপথ পাল্টে জালে পাঠিয়েছেন। কিংবা অন্য চোখে, আর্জেন্টিনা দলে বিদায়ী পূর্বসূরিকে ‘চামচে করে রসগোল্লা’ খাওয়ালেন উত্তর প্রজন্মের প্রতিনিধি!

অ্যাকশনে মেসি
অ্যাকশনে মেসি, কনমেবল এক্স হ্যান্ডল

আর্জেন্টিনার এই ম্যাচে মেসির এসব মুহূর্তই বারবার মূর্ত হয়ে উঠেছে। যেমন ধরুন, বল যতবার তাঁর পায়ে গেছে গ্যালারিও গলা ফাটিয়েছে। বেচারা লাওতারো মার্তিনেজের গোলটি তাই সম্ভবত শুধু স্কোরশিট ছাড়া কেউ মনে রাখবেন না! ৭৪ মিনিটে আলভারেজের বদলি হয়ে নামার ২ মিনিট পরই নিকো পাজের ক্রস থেকে হেডে গোল করেন। অবশ্য মেসির কারণেও গোলটি কেউ কেউ মনে রাখতে পারেন। ফ্রি–কিক থেকে পাজকে ডিফেন্সচেরা পাসটি মেসির ছিল।

তবে মার্তিনেজের গোলের চেয়েও লোকে সম্ভবত বেশি মনে রাখবেন, এই ম্যাচে মেসি হ্যাটট্রিক পেতে পারতেন। ৮৯ মিনিটে রদ্রিগো দি পলের দারুণ পাস থেকে গোল করলেও ভিএআর জানিয়ে দেয় অফসাইডের ভুল ছিল।

আর্জেন্টিনা এই ম্যাচে ৯টি শট নিয়েছে ভেনেজুয়েলার গোলপোস্টে। ভেনেজুয়েলা কোনো শট নিতে পারেনি। কিংবা বলার মতো আক্রমণও নেই। বিশ্বকাপে খেলা আগেই নিশ্চিত হওয়ায় ম্যাচটা কাগজে-কলমে আর্জেন্টিনার জন্যও হয়ে গিয়েছিল আনুষ্ঠানিকতার। এমন ম্যাচে মেসিকে নিয়ে থই থই আবেগ দিয়েছিল অন্য মাত্রা।

আর্জেন্টিনা দলের জাতীয় সংগীতের সময় তিন সন্তানকে নিয়ে সতীর্থদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। আর্জেন্টাইন গায়িকা ইউজেনি কুয়েভেদো জাতীয় সংগীত গাওয়ার সময় মেসি স্বাভাবিকই ছিলেন। কিক অফের আগে একবার ক্যামেরা ধরলে ছলছল চোখ দুটি দেখা গেল। শেষের শুরু যে, তাই!

গ্যালারিতে তাই মেসির পরিবার। রোকুজ্জোকে দু-একবার দেখা গেল। প্রথমবার হাসছিলেন, তখন ম্যাচের শুরু। পরেরবার মুখটা শুকনা, তখন ম্যাচের শেষ অর্ধের খেলা চলছিল।

ম্যাচ অফিশিয়ালদের শাপ-শাপান্ত করতে পারেন আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা। দুই অর্ধে মাত্র দুই মিনিট করে যোগ করা সময় দেওয়া হয়েছে ! আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (এএফএ) আগামী জুনে বিশ্বকাপের আগে দেশের মাটিতে একটি প্রীতি ম্যাচ আয়োজন করতে পারে বলে জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম ‘লা নাসিওন’। সেটা না হলে এই ম্যাচই হয়ে যাবে জাতীয় দলের জার্সিতে দেশের মাটিতে মেসির শেষ ম্যাচ! ১০ সেপ্টেম্বর ইকুয়েডরের মুখোমুখি হবে আর্জেন্টিনা। বিশ্বকাপ বাছাইয়ে এটাই লিওনেল স্কালোনির দলের শেষ ম্যাচ, কিন্তু সেটা হবে ইকুয়েডরে।

মেসিকে দেশের মাটিতে আরেকটু বেশি সময় মাঠে দেখার ইচ্ছা থেকে আর্জেন্টাইন সমর্থকেরা তাই ভাবতেই পারেন, রেফারিরা যোগ করা সময়টা অনন্তকাল দিলে এমন কীই-বা হতো!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.