গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উদ্যাপন উপলক্ষে ১ জুলাই থেকে ৩৬ দিনব্যাপী (মাঝে বিরতি দিয়ে) অনুষ্ঠানসূচি পালন করছে অন্তর্বর্তী সরকার, চলবে ৫ আগস্ট পর্যন্ত। জুলাই স্মৃতি উদ্যাপন অনুষ্ঠানমালায় আজ ১৪ জুলাই ‘মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম’ স্লোগানে দেশজুড়ে পালন করা হচ্ছে ‘জুলাই উইমেন্স ডে’।
জন্মদিনের উপহার পাওয়া নিয়ে খুব উচ্ছ্বাস ছিল নাঈমা সুলতানার। ডায়েরিতে লিখেছিল, বড় বোন প্রতিবছর জন্মদিনে কীভাবে তাকে ‘সারপ্রাইজ’ (চমকে) দেন। নাঈমার আরও কত কথা উঠে এল মা আইনুন নাহারের স্মৃতিচারণায়। একপর্যায়ে সন্তানহারা এই মা বললেন, ‘এই মাসটা একই সঙ্গে আমার মেয়েকে পাওয়া ও হারানোর মাস!’
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ প্রথম নারী নাঈমা সুলতানা। ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই বিকেল পাঁচটার দিকে রাজধানীর উত্তরার বাসার বারান্দায় শুকাতে দেওয়া কাপড় আনতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় সে। এর পাঁচ দিন পর ২৫ জুলাই ছিল তার ১৫তম জন্মবার্ষিকী।
চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক গোলাম মোস্তফা ও আইনুন নাহার দম্পতির দুই মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে নাঈমা ছিল দ্বিতীয়। সে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়ত।
৫ জুলাই কথা হয় নাঈমার মা আইনুন নাহারের সঙ্গে। তিনি জানান, ভালো পড়ালেখার জন্য সন্তানদের ঢাকার স্কুল-কলেজে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁর স্বামী গ্রামে থাকেন। আর উত্তরার ৯ নম্বর সেক্টরের পাঁচতলা একটি ভবনের চারতলায় সন্তানদের নিয়ে থাকেন তিনি।
আইনুন নাহার বলেন, ‘নাঈমাকে হারিয়ে আমরা পুরো পরিবার মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি। সেদিন বারান্দায় যদি যেতে না দিতাম, তাহলে ও বেঁচে থাকত!’
এখন পর্যন্ত সরকার মোট ৮৪৪ জন শহীদের নাম গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে ৬ থেকে ৬০ বছর বয়সী ১০ জন নারীর নাম রয়েছে। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের করা পৃথক তালিকাতেও এই ১০ জনের নাম শহীদ হিসেবে উল্লেখ রয়েছে। তবে এই ১০ জনের মধ্যে চারজনের বয়স ১৮ বছরের নিচে।
নাঈমাসহ জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ হওয়া নারীরা হলেন মায়া ইসলাম (৬০), শাহিনুর বেগম (৫৫), নাছিমা আক্তার (২৪), মেহেরুন নেছা (২২), লিজা আক্তার (২১), সুমাইয়া আক্তার (২০), নাফিসা হোসেন মারওয়া (১৭), রিতা আক্তার (১৭) ও রিয়া গোপ (৬)। তাঁদের মধ্যে পাঁচজন শিক্ষার্থী, দুজন কর্মজীবী, দুজন গৃহবধূ। একজন শিক্ষা বা প্রাতিষ্ঠানিক কোনো কাজে ছিলেন না।
শহীদ ১০ জন নারীর মধ্যে ৭ জন ঢাকায়, ২ জন নারায়ণগঞ্জে ও ১ জন সাভারে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে ৭ জনই গুলিবিদ্ধ হন নিজ বাসার বারান্দা ও ছাদে। ৩ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন সড়কে।

প্রথমে গুলিবিদ্ধ হন গৃহকর্মী লিজা আক্তার। ঘটনার তিন দিন পর তাঁর মৃত্যু হয়। প্রথম মৃত্যু শিক্ষার্থী নাঈমার—১৯ জুলাই। একই দিন গুলিবিদ্ধ হন মায়া ইসলাম, রিয়া গোপ, নাছিমা আক্তার।
৫ আগস্ট সন্ধ্যায় গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান মেহেরুন নেছা। একই দিন দুপুরে ও বিকেলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হয় আরও দুই শিক্ষার্থীর—রিতা আক্তার ও নাফিসা হোসেন মারওয়া। সর্বশেষ মৃত্যু শাহিনুর বেগমের। তিনি ২২ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন, চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ১ সেপ্টেম্বর। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে প্রথম আলো শহীদ এই ১০ নারীর পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে।
গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উদ্যাপন উপলক্ষে ১ জুলাই থেকে ৩৬ দিনব্যাপী (মাঝে বিরতি দিয়ে) অনুষ্ঠানসূচি পালন করছে অন্তর্বর্তী সরকার, চলবে ৫ আগস্ট পর্যন্ত। জুলাই স্মৃতি উদ্যাপন অনুষ্ঠানমালায় আজ ১৪ জুলাই ‘মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম’ স্লোগানে দেশজুড়ে পালন করা হবে ‘জুলাই উইমেন্স ডে’।
রিয়া ছাড়া শূন্য ঘর
আবু সাঈদ, মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের মতো জুলাই আন্দোলনের অন্যতম প্রতীক রিয়া গোপ। ছয় বছরের এই শিশুর মৃত্যু নাড়িয়ে দিয়ে গেছে দেশের মানুষকে। দীপক কুমার গোপ ও বিউটি ঘোষের একমাত্র সন্তান ছিল রিয়া গোপ। ১৯ জুলাই নারায়ণগঞ্জ সদরের নয়ামাটি এলাকায় চারতলা বাসার ছাদে খেলতে গিয়েছিল রিয়া। বাসার নিচে সংঘাত শুরু হলে বাবা দীপক কুমার ছাদ থেকে মেয়েকে আনতে যান। ওই সময় বাবার কোলে গুলিবিদ্ধ হয় রিয়া। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৪ জুলাই মারা যায় সে।
একমাত্র সন্তান হারানোর শোক সামলাতে পারছেন না এই দম্পতি। রিয়াকে নিয়ে সংবাদমাধ্যমে খুব সহজে কথা বলতে চান না তাঁরা। বাবা দীপক ঘোষ বলেন, ‘আপনারা তো অনেক লিখলেন! মেয়েকে নিয়ে আর কী বলব!’ মা বিউটি ঘোষ বলেন, ‘তিন বেলা খাইদাই, চলিফিরি, কিন্তু অনেক যন্ত্রণা হয়! কতটা যন্ত্রণা হয়, কাউকে বুঝিয়ে বলতে পারব না!’‘আমাদের জীবন ওলট–পালট হয়ে গেছে’
জুলাই আন্দোলনে মাকে হারিয়েছেন মুস্তাফিজুর রহমান। একমাত্র সন্তান গুরুতর আহত। তাকে নিয়ে এক বছর ধরে হাসপাতালে হাসপাতালে দিন কাটছে মুস্তাফিজুর রহমানের। ঢাকার রামপুরার মেরাদিয়া হাট এলাকায় সাততলা একটি ভবনের ছয়তলার ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকত পরিবারটি। মুস্তাফিজুর রহমান জানান, পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে ১৯ জুলাই তাঁর ছেলে বাসিত খান মুসাকে (৭) আইসক্রিম কিনে দিতে নামেন মা মায়া ইসলাম (৬০)। নিচে নেমে দেখেন, বাসার কলাপসিবল গেট ও প্রধান দরজা বন্ধ। ঠিক তখনই একটি গুলি শিশু মুসার মাথার বাঁ দিক দিয়ে ঢুকে অপর পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। সেই গুলি লাগে মায়া ইসলামেরও। তাঁর তলপেট দিয়ে ঢুকে সেটি পেছনের দেয়ালে গিয়ে লাগে। পরদিন মায়া ইসলাম মারা যান।
মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমি সন্তান হয়েও মায়ের জানাজায় থাকতে পারিনি। সংকটাপন্ন মুসাকে নিয়ে হাসপাতালে ছোটাছুটি করতে হচ্ছিল।’
মুসাকে নিয়ে প্রথম আলোয় প্রতিবেদন প্রকাশের পর সরকার চিকিৎসার জন্য মুসাকে সিঙ্গাপুরে পাঠায়। তাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যাওয়ার খরচ বহন করে চ্যানেল আই। সাড়ে পাঁচ মাস সিঙ্গাপুরে চিকিৎসার পর মুসা এখন ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন। মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আম্মু নাই। ছেলের এক পাশ পক্ষাঘাতগ্রস্ত। আমাদের জীবন ওলট–পালট হয়ে গেছে। পরবর্তী সময়ে যে সরকারই আসুক, তারা যেন শহীদ পরিবারের খোঁজ নেয়। মুসার মতো আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার ব্যয় বহন করে।’
ছাদে ভাতিজার সঙ্গে গুলিবিদ্ধ হন নাছিমা
মায়া ইসলাম ও মুসার মতো গুলি বিদ্ধ হন নাছিমা আক্তার (২৪) ও তাঁর ভাতিজা আইমান উদ্দিন (২১)। ধানমন্ডির ১ নম্বরে ১০ তলা ভবনের ছাদে ঘটনা ঘটে। পরিবারটি ওই ভবনের সাততলায় ভাড়া থাকে। ইউসুফ আলী ও সালেহা বেগমের চার মেয়ে ও তিন ছেলের মধ্যে নাছিমা ছিলেন ছোট। নাছিমা নোয়াখালী থেকে ধানমন্ডিতে বড় ভাই স্পেনপ্রবাসী হেলালউদ্দিনের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন। তিনি বেশি পড়াশোনা করেননি। গত বছরের ডিসেম্বরে তাঁর বিয়ে হওয়ার কথা ছিল।
দুই ভাতিজাকে নিয়ে ১৯ জুলাই ছাদে গিয়েছিলেন নাছিমা। সেখানে গুলিবিদ্ধ হয়ে পরদিন রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান নাছিমা। গুলিবিদ্ধ হয়ে একই হাসপাতালে ১৫ দিন চিকিৎসাধীন ছিলেন তাঁর ভাতিজা আইমান।
আইমান এখন ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, সায়েন্সল্যাবের দিক থেকে একটি হেলিকপ্টার আসা-যাওয়া করছিল। তাঁদের মাথার ওপর একটি সাদা ড্রোন ঘুরে বেড়াচ্ছিল। হঠাৎ একটি গুলি তাঁর বুকের ডান পাশ দিয়ে ঢুকে মেরুদণ্ড দিয়ে বের হয়ে যায়। সেটি পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা নাছিমার চোয়ালে আঘাত করে গলায় ঢুকে যায়।
আইমান জানান, গুরুতর আহত হলেও এখনো আহত ব্যক্তিদের তালিকায় তাঁর নাম ওঠেনি।
সুমাইয়ার মেয়ে বড় হচ্ছে নানির কাছে
বাইরে সংঘর্ষ চলছিল। আকাশে উড়ছিল র্যাবের হেলিকপ্টার। আড়াই মাস বয়সী সন্তানকে ঘুম পাড়িয়ে ছয়তলায় বাসার বারান্দায় গিয়েছিলেন হেলিকপ্টার দেখতে। সে সময় গুলি এসে লাগে সুমাইয়া আক্তারের (২০) মাথায়। ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি। ২০ জুলাই সন্ধ্যা পৌনে ছয়টার দিকে এ ঘটনা ঘটে, ঘটনাস্থল নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের পাইনাদি। সুমাইয়ার স্বামী জাহিদ হোসেন কাঁচপুরে একটি পোশাক কারখানায় অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন। সন্তান প্রসবের জন্য সুমাইয়া পাইনাদিতে মায়ের বাসায় এসেছিলেন।
সুমাইয়ার মেয়ে সোয়াইবার বয়স এক বছর পেরিয়ে গেছে। মা কী, তা সে বুঝে উঠতে পারেনি। সুমাইয়ার মা আসমা বেগম বলেন, সুমাইয়ার স্বামী জাহিদের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ নেই। সোয়াইবা তাঁর কাছেই থাকে। আধো আধো শব্দ বলে; ‘মা’ বলতে পারে। তিনি ও তাঁর সন্তানেরা সোয়াইবার মায়ের অভাব পূরণের চেষ্টা করেন উল্লেখ করে আসমা বেগম বলেন, তাঁর পাঁচ ছেলেমেয়ের মধ্যে সুমাইয়া ছিলেন তৃতীয়। করোনায় তাঁর স্বামী মারা যান। আর ঘরের ভেতর তাঁর চোখের সামনে মেয়ের মৃত্যু দেখতে হলো।
বারান্দায় গুলিবিদ্ধ হন লিজা
রাজধানীর শান্তিনগরের একটি বাসার গৃহকর্মী ছিলেন লিজা আক্তার (১৯)। ১২ তলা ভবনের ৭ তলায় থাকতেন। ১৮ জুলাই বেলা তিনটার দিকে বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই তাঁর পেটে গুলি লাগে। লিজার ভাই মো. রাকিব ঢাকায় রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। তিনি বলেন, যে পরিবারের সঙ্গে লিজা থাকতেন, তাঁরা প্রথমে তাঁকে অরোরা স্পেশালাইজড হাসপাতালে ভর্তি করে। ২১ জুলাই লিজাকে পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। পরদিন ২২ জুলাই হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) লিজা মারা যান।
লিজার বাবার নাম জয়নাল শিকদার, মা ইয়ানুর বেগম। তাঁরা ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার বাসিন্দা। লিজার বাবা বলেন, তাঁর সাত ছেলেমেয়ের মধ্যে লিজা ছিলেন পঞ্চম। ভিটেমাটি ছাড়া তাঁর কোনো সম্পদ নেই। অভাব-অনটনের কারণে বছর পাঁচেক আগে মেয়েকে ঢাকায় গৃহকর্মীর কাজে পাঠিয়েছিলেন।
‘মা-ই ছিল আমাদের সব’
২২ জুলাই সকালে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর কাজলায় হাঁটার সময় গুলিবিদ্ধ হন কর্মজীবী শাহিনুর বেগম (৫০)। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১ সেপ্টেম্বর তিনি মারা যান। শাহিনুরের তিন ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে বড় মোসাম্মৎ হাফেজা (৩০)। মায়ের কথা বলতে গিয়ে অনবরত কাঁদছিলেন তিনি। হাফেজা বললেন, তাঁদের বাড়ি কুমিল্লার মেঘনা উপজেলায়। বাবা মো. হাবিব মিয়ার দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন তাঁর মা। বাবা সংসারে খরচ দিতেন না। মা তাঁদের নিয়ে যাত্রাবাড়ীর কাছে শনির আখড়ায় চলে আসেন। যাত্রাবাড়ীর আড়তে সকাল ছয়টা থেকে আটটা পর্যন্ত মাছ বিক্রি করতেন। ডায়াবেটিস থাকায় মাছ বিক্রি শেষে তিনি নিয়মিত হাঁটতেন। ঘটনার দিন হাঁটতে বেরিয়ে গুলিবিদ্ধ হন। হাফেজা বলেন, ‘মা-ই ছিল আমাদের সব। মা আমাদের জন্য অনেক কষ্ট করতেন।’
মায়ের কষ্ট দূর করতে চেয়েছিলেন নাফিসা
৩ আগস্ট থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়কদের সঙ্গে আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন নাফিসা হোসেন মারওয়া (১৯)। ৫ আগস্ট সকালে সাভারে মামার বাসা থেকে বেরিয়ে আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। বিকেলে সাভার মডেল মসজিদ এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন। হাসপাতালে নেওয়ার পর তাঁর মৃত্যু হয়।
নাফিসার মৃত্যুর ১ মাস ১০ দিন পর ১৫ অক্টোবর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। জিপিএ–৪.২৫ পেয়ে পাস করেন তিনি। গাজীপুরের টঙ্গীর সাহাজউদ্দিন সরকার আদর্শ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পরীক্ষা দিয়েছিলেন।
নাফিসার মা কুলসুম বেগম (৪৪) কুয়েতে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করেন। নাফিসা তাঁর দ্বিতীয় সন্তান। প্রথম সন্তান ছেলে, জন্মের পরপরই মারা যায়। নাফিসার ছোট বোন সাফা হোসেন রাইসা সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে।
১ জুলাই হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয় কুলসুম বেগমের সঙ্গে। তিনি জানান, নাফিসার বাবা আবুল হোসেন (৫৪) ও তিনি আলাদা থাকতেন। নাফিসার বাবা আরেক স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে টঙ্গীতে থাকেন। ছোট বোন সাফা মামার বাড়িতে থাকলেও নাফিসা মামা ও বাবা দুজনের বাড়িতেই আসা-যাওয়া করতেন। মেয়ের কথা বলতে গিয়ে অঝোরে কাঁদছিলেন মা কুলসুম। বলেন, ‘প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে দেখতাম মেয়ে মুঠোফোনে মেসেজ দিয়ে রাখছে। দুপুরে কল দিত। এখন সেই সময়গুলোতে হাহাকার লাগে। মেয়েটা বলত, “মা, আমি বড় হয়ে তোমার সব কষ্ট দূর করব।”’
রিতা ডাক্তার হতে চেয়েছিল
জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার আশরাফ আলী ও রেহানা বিবির তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে দ্বিতীয় ছিল রিতা আক্তার (১৭)। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাল্যবিবাহের চাপের মধ্যে রিতা মা–বাবাকে বলেছিল, ‘ডাক্তার হব। মা–বাবাকে কামাই করে না খাওয়ানো পর্যন্ত বিয়ে করব না।’ পড়ার প্রতি রিতার আগ্রহ দেখে পরিবারটি গ্রাম থেকে ঢাকার মিরপুরে চলে আসে।
রিতার বড় ভাই মো. রাশেদুল ইসলাম বলেন, তাঁরা আগেও একবার ঢাকায় ছিলেন। এবার রিতার কারণে গত বছরের মার্চের দিকে তাঁরা আবার ঢাকায় আসেন। মা–বাবা, তিনি কাজ খুঁজে নেন। জুন মাসে ঢাকায় আসে রিতা। তাকে ভর্তি করে দেওয়া হয় দুয়ারীপাড়া সরকারি কলেজে। ৫ আগস্ট বেলা দেড়টায় তাঁরা খবর পান, আন্দোলনে থাকার সময় মিরপুর ১০ নম্বরে পদচারী–সেতুর সামনে রিতা মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়েছে। চার হাসপাতালে ছোটাছুটি করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মর্গে মেয়ের মরদেহ পান। মা রেহানা বিবি মেয়ের পা দেখে মরদেহ শনাক্ত করেন।
বিজয় মিছিল থেকে ফিরে শহীদ হন মেহেরুন
শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর ছেলেমেয়ে দুজনই বিজয় মিছিলে গেছেন। বাসার নিচে উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষায় বাবা মোশাররফ হোসেন। কেননা তখনো পুলিশের এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ার শব্দ আসছে। ‘জলদি বাসায় আসো’—মুঠোফোনে তাগাদা দিচ্ছিলেন ছেলেমেয়েদের। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে মেয়ে মেহেরুন নেছা বলেন, ‘আব্বু, এক্ষুনি আসছি।’ মেয়ে বাসায় ঢোকে। ছেলে তখনো বাইরে। মিনিট বিশেক পর মোশাররফ হোসেন নিচ থেকেই জানতে পারেন, বাসায় ফিরে নিজ কক্ষেই গুলিবিদ্ধ হয়েছে তাঁর মেয়ে। জানালা দিয়ে ঢোকা গুলি মেহেরুনের চোয়াল ও বুকের পাশে বিদ্ধ হয়।
২ জুলাই কাফরুল থানাধীন মিরপুর ১৩ নম্বরে মেহেরুন নেছাদের বাসায় গেলে জানালাটি দেখালেন মা আসমা আক্তার। তিনি বললেন, ‘তখন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। ঘরে ঢুকেই এখানে দাঁড়িয়ে ভাইকে ফোন দিয়েছিল আমার মেয়ে। আমি কাছেই ছিলাম। হঠাৎ দেখি মেয়ে ফোনে কথা বলা অবস্থায় কাত হয়ে ঢোলে পড়ল।’ যে পাশে মেহেরুন নেছা কাত হয়ে পড়েছিলেন, সেই দেয়ালে রক্তের অস্পষ্ট দাগ এখনো লেগে রয়েছে। যে পোশাক পাল্টে বের হয়েছিলেন মেহেরুন, সেটা সেভাবেই রেখেছেন মা। সেদিন মায়ের জন্য ফুল নিয়ে ফিরেছিলেন মেহেরুন, ফুলগুলো শুকিয়ে ফুলদানির তলানিতে পড়ে গেছে। সেভাবেই রেখে দিয়েছেন।
মোশাররফ হোসেন ও আসমা আক্তারের দুই ছেলেমেয়ের মধ্যে মেহেরুন নেছা ছিলেন বড়। ডাক নাম তান্হা। তিনি মিরপুর শাহ আলী কলেজে হিসাববিজ্ঞান বিভাগে তৃতীয় বর্ষে পড়তেন।
মেহেরুনের নানার জমিতে মামা-খালারা মিলে ছয়তলা বাড়ি করেছেন। একেক পরিবার একেক ফ্ল্যাটে থাকেন। মেহেরুনের পরিবার থাকে তৃতীয় তলায়। চতুর্থ তলায় থাকেন বড় মামা ফারুক খান। ১৯ জুলাই তাঁর ছেলে আকরাম খান রাব্বি শহীদ হন। ভাই হত্যার বিচার চেয়ে প্ল্যাকার্ড হাতে সড়কে দাঁড়িয়েছিলেন মেহেরুন। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর মেহেরুন বলেছিলেন, ‘ভাই হত্যার বিচার পেলাম।’
মেহেরুনের ছোট ভাই আবদুর রহমান তারিফ বলেন, তাঁর বড় বোন সেদিন বাড়ি ফিরে তাঁর সঙ্গেই ফোনে কথা বলছিলেন। ওই সময় গুলিবিদ্ধ হন। বোনের চিৎকার তিনি ফোনে শুনতে পেয়েছিলেন।
পেশায় গাড়িচালক বাবা মোশাররফ হোসেন বলেন, তিনি বাসায় ছুটে এসে দেখেন, মেয়ে রক্তে ভেসে যাচ্ছে! স্থানীয় একটি ক্লিনিকে নেওয়ার পর মেহেরুনকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
মেহেরুনের পরিবারের মতো প্রত্যেক নারী শহীদ পরিবারের সদস্যরা তাঁদের প্রিয়জনের হত্যার বিচার দেখতে চান। পরিবারগুলো সরকারের আর্থিক সহায়তা পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু স্বজন হারানোর বেদনা কিছুতে ভুলতে পারছে না। তাঁদের প্রত্যাশা, শহীদ নারীদের যেন দেশবাসী স্মরণে রাখেন। যে সরকারই আসুক, তারা যেন শহীদদের যথাযথ মর্যাদা দেয়।
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভিন হক বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নারীদের সাহসী ভূমিকা ছিল। গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম শক্তি ছিলেন নারীরা। আন্দোলনে ব্যাপকভাবে নারীদের অংশগ্রহণ সবাইকে উদ্দীপ্ত করেছে, শক্তি জুগিয়েছে।
নাজনীন আখতার
ঢাকা