জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীদের এসব সন্তানের দায়িত্ব কারা নেবে

0
144
একা হাতে সন্তানদের বড় করে তোলার সীমাহীন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে পউলিন ফিলিপ্পে মতো ভুক্তভেগী নারীদের, প্রতীকী ছবি: এএফপি

সময়টা ২০১২ সাল। মধ্য আমেরিকার দেশ হাইতির নারী পউলিন ফিলিপ্পে শারীরিক পরীক্ষার জন্য চিকিৎসাকেন্দ্রে গিয়েছিলেন। পরীক্ষার পর ২৬ বছর বয়সী ফিলিপ্পে জানতে পারেন, তিনি সন্তানসম্ভবা। তাঁর গর্ভে যমজ শিশু বেড়ে উঠছে। এ কথা শুনে খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠেছিলেন ফিলিপ্পে। পরক্ষণেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

যেই টেকনিশিয়ান ফিলিপ্পের আলট্রাসাউন্ড করেছিলেন, তিনি জিজ্ঞাসা করেন, তুমি কাঁদছো কেন? ওই ব্যক্তি ফিলিপ্পেকে খুশি করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ফিলিপ্পের কান্না যেন কিছুতেই থামছিল না। অজানা ভবিষ্যতের আশঙ্কা ফিলিপ্পের চোখ ভিজিয়ে তুলেছিল।

এই ঘটনার বছর দুয়েক আগে ২০১০ সালের ১২ জানুয়ারি শক্তিশালী ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে হাইতি। রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে দরিদ্র দেশটিতে লাখো মানুষের মৃত্যু হয়। ভূমিকম্পের পরবর্তী সময়ে রাজধানী পোট–অ–প্রিন্সসহ দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে কলেরা মহামারি। এতে মৃত্যু হয় হাজার হাজার মানুষের।

এসব দুর্যোগে জর্জরিত হাইতির পাশে দাঁড়ায় বিশ্ববাসী। দেশটিতে আন্তর্জাতিক ত্রাণসহায়তার একের পর এক কার্যক্রম শুরু হয়। ছোট্ট দেশটিতে জড়ো হন হাজার হাজার উদ্ধারকর্মী ও সহায়তাকর্মী। এসব কার্যক্রমে নিয়োগ দেওয়া হয় জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীদেরও।

দুর্যোগের পর হাইতির পুনর্গঠনে জাতিসংঘের দলের সঙ্গে পোর্ট–অ–প্রিন্সে গিয়েছিলেন এক আফ্রিকান নাগরিক। পেশায় তিনি পুলিশ সদস্য। বাড়ি নাইজারে। সেখানেই তাঁর পরিবার থাকে। পোর্ট–অ–প্রিন্সে ওই ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় হয় ফিলিপ্পের। পরে সম্পর্কে জড়ান তাঁরা। সেই সূত্রে ফিলিপ্পের গর্ভে আসে যমজ সন্তান।

ফিলিপ্পে বলছিলেন, ‘কী ঘটতে পারে, সেই সম্পর্কে আমি ভেবেছিলাম। আমি ওই ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। বলেছিলাম, আমি সন্তানসম্ভবা। আমার গর্ভে যমজ শিশু রয়েছে।’ জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘এটা কীভাবে হতে পারে? আমার কাছ থেকে? আমি দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি। এই সন্তানেরা পিতৃপরিচয় পাবে না। তুমি বাবা ছাড়া সন্তানদের বড় করতে পারবে না।’

ওই বছরের (২০১২ সাল) নভেম্বরে দুই সন্তানের জন্ম দেন ফিলিপ্পে। এর মধ্যে একটি মেয়ে, অন্যটি ছেলে শিশু। এর মাস দুয়েক পর সন্তানদের বাবা হাইতি ছেড়ে নিজ দেশে ফিরে যান।

ফিলিপ্পে একা নন

ফিলিপ্পে সেসব নারী–মেয়েদের মধ্যে একজন, যাঁরা জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্য ও কর্মীদের সঙ্গে সম্পর্কের জেরে সন্তানের মা হয়েছেন। কিন্তু তাঁদের কিংবা সন্তানের ভার ওই বাবারা নেননি। ফিলিপ্পের মতো অসহায় নারীদের কাঁধে সন্তানের দায়িত্ব চাপিয়ে ওই বাবারা নিজ নিজ দেশে ফিরেছেন।

২০১০ সাল থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্য ও কর্মীদের বিরুদ্ধে এমন ৪৬৩টি অভিযোগের কথা জানা গেছে। এর মধ্যে ৫৫টি অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। ২৯৮টি অভিযোগের তদন্ত এখনো চলছে।

তবে যেসব নারী সাহস করে সামনে এসেছেন, অভিযোগ করেছেন; এসব সংখ্যা শুধু তাঁদের। এর বাইরেও বিশ্বজুড়ে আরও অনেক ভুক্তভোগী রয়েছেন বলে ধারণা করা হয়।

স্বামী ছাড়া এসব মা ভীষণ প্রতিকূলতার মধ্যে সন্তানদের বড় করার চেষ্টা করছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সশস্ত্র সংঘাত, জাতিগত সহিংসতার জেরে উদ্বাস্তু জীবনের পাশাপাশি তাঁদের ভয়াবহ সামাজিক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। শরণার্থী শিবিরে সবাই এসব নারীদের বাঁকা চোখে দেখে।

তবে জাতিসংঘ জানে, এসব ঘটনায় কারা প্রকৃত দোষী। কেননা, সংস্থাটি এসব ঘটনাকে ‘যৌন শোষণ ও নির্যাতন’ বলে চিহ্নিত করেছে।

যা বলছে জাতিসংঘ

২০০৩ সাল। জাতিসংঘের মহাসচিব তখন কফি আনান। ওই সময় তিনি একটি বুলেটিন ইস্যু করেছিলেন। এতে জাতিসংঘের কর্মীদের কাজ করতে যাওয়া দেশের মানুষের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনে নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল। এসব সম্পর্ককে ‘স্বভাবগতভাবে অসম শক্তির’ সঙ্গে সম্পর্ক বলা হয়। জাতিসংঘের মতে, এসব সম্পর্ক সংস্থাটির বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। জাতিসংঘের কার্যক্রমের অখণ্ডতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলবে।

এ ছাড়া কফি আনান বলেন, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্য এবং সামরিক পুলিশ (ফিলিপের সন্তানদের বাবার মতো) এমন কর্মকাণ্ডে যুক্ত হলে পরবর্তী সময়ে তাঁকে বেসামরিক জনগণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আর কোনো কাজে নিয়োজিত করা হবে না।

জাতিসংঘের বর্তমান মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সংস্থাটির অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ফেরানোর অঙ্গীকার করেছেন। ২০১৭ সালে তিনি একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করেন। এর মধ্য দিয়ে এমন কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে দায়মুক্তির কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। ভুক্তভোগীদের অধিকার ও মর্যাদাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। গুতেরেস প্রথমবারের মতো জাতিসংঘে ভুক্তভোগীদের অধিকার–সংক্রান্ত পরামর্শক নিয়োগ দেন। ভুক্তভোগীদের সহায়তা দিতে একটি তহবিল গড়ে তোলেন তিনি।

ভুক্তভোগীদের তিক্ত অভিজ্ঞতা

ফিলিপ্পেসহ হাইতির ভুক্তভোগী সাতজন নারীর সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলেছে সিএনএন। তাঁরা সাংবাদিকদের বলেছেন, জাতিসংঘের এসব সহায়তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য এবং শর্তযুক্ত। তাঁরা আজও ন্যায়বিচার পাননি। আইন অনুযায়ী, বাবার কাছ থেকে সন্তানের স্বীকৃতি, সন্তানকে বড় করার খরচ, এমনকি ভুক্তভোগী হিসেবে ক্ষতিপূরণ—কিছুই জোটেনি অসহায় এসব নারীর কপালে।

একজন ভুক্তভোগী নারী বলছিলেন, ‘ওরা (জাতিসংঘ) আমাদের মানুষ বলেও মনে করে না।’

একদিকে সংঘাত–সংঘর্ষে পোর্ট–অ–প্রিন্সে হাজারো মানুষ বাস্তুহারা। অন্যদিকে খাবার ও জ্বালানির বাড়তি দাম তাঁদের জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তুলেছে। এমন পরিস্থিতিতে ভুক্তভোগী নারীদের জীবনে যেন সংকট চরম রূপ নিয়েছে। একা হাতে সন্তানদের বড় করে তোলার সীমাহীন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে তাঁদের। সংকটে–দুর্দশায় জর্জরিত অনেককে বাধ্য হয়ে দেশ ছাড়তে হয়েছে।

এতকিছুর পরও জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্য ও কর্মীদের যৌন অপকর্ম থামেনি। চলতি বছরের জুনে মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র থেকে ৬০ শান্তিরক্ষীকে নিজ দেশ তানজানিয়ায় ফেরত পাঠানো হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে দুই নারী ও দুই মেয়েশিশুর ওপর যৌন নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে।

‘জাতিসংঘের জানা উচিত’

যমজ সন্তানদের নিয়ে হাইতি ছেড়ে ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন ফিলিপ্পে। ২০২১ সালে দেশ ছাড়েন তিনি। এখন তিনি ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রের দাজাবন শহরে এক কক্ষের ছোট্ট একটি বাসায় থাকেন। ওই কক্ষে একটিমাত্র ছোট্ট বিছানা। বাচ্চারা সেখানে ঘুমায়। আর ফিলিপ্পে ঘুমান মেঝেতে। তাঁর ছেলেটা অসুস্থ। ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছে। অস্ত্রোপচার করাতে বলেছেন চিকিৎসক। কিন্তু ছেলের চিকিৎসা করানোর মতো অর্থ নেই ফিলিপ্পের কাছে। বাধ্য হয়েই সন্তানকে কষ্ট পেতে দেখতে হচ্ছে।

স্মৃতির ঝাঁপি খুলে ফিলিপ্পে বলেন, ‘২০০৯ সাল। আমি তখন পোর্ট–অ–প্রিন্সে জাতিসংঘের কার্যালয়ে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর চাকরি করি। সেখানেই প্রথম আমার সন্তানদের বাবার সঙ্গে দেখা হয়। ওই সময় তিনি আমাকে তাঁর ঘরে কাজ করতে বলেছিলেন, বাজার করতে বলেছিলেন। আমাকে তাঁর বাসায় যেতে বলেছিলেন। এভাবে আমাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা কয়েক বছর স্থায়ী হয়।’

এত বছর পরে এসে সেই সম্পর্কের কথা মনে করে ফিলিপ্পে বললেন, ‘আমি এটা কখনোই বলব না, আমরা একে অপরকে ভালোবাসতাম।’ কিন্তু সেই সম্পর্কের জের বয়ে বেড়াতে হচ্ছে ফিলিপ্পেকে। আর সেই অভিজ্ঞতা মোটেও সুখকর নয়। তাই দুই সন্তানের জন্ম এবং সন্তানদের বাবার নিজ দেশে ফেরার বছরখানেক পর তিনি জাতিসংঘকে পুরো ঘটনা জানান। ফিলিপ্পের ভাষ্য, ‘আমার সঙ্গে যা ঘটেছে, সেটা জাতিসংঘের জানা উচিত।’

সিএনএন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.