জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদের (জাকসু) নির্বাচনে সহসভাপতি (ভিপি) পদে জয়ী হয়েছেন আবদুর রশিদ জিতু। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক তিনি। ২০২৪–এর জুলাই আন্দোলন শুরু হলে তিনি ছাত্রলীগ (বর্তমানে নিষিদ্ধ) ছাড়েন। আন্দোলনের আগে তিনি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কার্যকরী সদস্য। পরে আল-বেরুনী হলের সভাপতি পদপ্রত্যাশী ছিলেন।
দীর্ঘ ৩৩ বছর পর ১১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত দশম জাকসু নির্বাচনে ৩ হাজার ৩৩৪টি ভোট পেয়ে ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন’ প্যানেলের প্রার্থী জিতু ভিপি নির্বাচিত হন। বাকি ২৪টি পদের মধ্যে ছাত্রশিবির–সমর্থিত প্যানেল ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’–এর প্রার্থীরা ২০টি পদে জয়লাভ করেন। শুরুতে আলোচনা ছিল গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের প্যানেল থেকে জিতু ভিপি পদে নির্বাচন করবেন। তবে শেষ পর্যন্ত সে আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি। পরে জিতু ১৮ জনকে নিয়ে আলাদা প্যানেলের ঘোষণা দেন। তাঁর প্যানেলে একমাত্র জয়ী প্রার্থী তিনি।
আবদুর রশিদ জিতু বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউটের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলায় তাঁর বাড়ি। আট ভাইবোনের মধ্যে তিনি পঞ্চম। জিতু জানিয়েছেন, তাঁর পরিবারের কেউ রাজনীতিতে যুক্ত নন।
ছাত্রীদের ভোট ও প্রতিপক্ষের প্রচার
ছাত্রীদের ১০টি হলের (মোট হল ২১টি) সব কটিতেই জিতু তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী শিবির–সমর্থিত আরিফ উল্লাহর থেকে বেশি ভোট পেয়েছেন। কোনো কোনো হলে এ ব্যবধান দ্বিগুণের বেশি। মোট ছাত্রী ভোটার ছিলেন ৫ হাজার ৭৪২ জন। এর মধ্যে জাকসুতে ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ৯ প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন ৩ হাজার ৪৬৭ জন। জিতুকে ভোট দিয়েছেন ১ হাজার ৫৮১ জন, যা ভিপি পদে ছাত্রীদের দেওয়া ভোটের প্রায় ৪৬ শতাংশ। আরিফ পেয়েছেন ছাত্রীদের ৯৬৪টি বা প্রায় ২৮ শতাংশ ভোট। ২৬ শতাংশ ছাত্রী ভোট পেয়েছেন বাকি ৭ প্রার্থী।
ছাত্রী হলগুলোতে জিতুর বেশি ভোট পাওয়ার কারণ জানতে তাঁর নির্বাচনী প্রচার–সংশ্লিষ্ট তিনজনসহ বিভিন্ন হলের মোট ১২ নারী শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। তাঁদের বেশির ভাগ জানিয়েছে, জুলাই আন্দোলনের পর দেশের বিভিন্ন জায়গায় সমন্বয়কদের নিয়ে যখন একের পর এক অভিযোগ সামনে আসে, তখনো জিতু ছিলেন বিতর্কমুক্ত।
রোকেয়া হলের শিক্ষার্থী তানজিলা তাবাসসুম বলেন, ছাত্রীদের অনেকে শুরু থেকেই ভিপি পদে দলীয় প্রার্থীকে ভোট না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করবেন না—এমন ধারণা থেকে তাঁরা জিতুকে ভোট দিয়েছেন।
নির্বাচনের আগে জিতুর সাবেক রাজনৈতিক পরিচয় ছাত্রলীগের বিষয়টি সামনে আসে। এ নিয়ে ফেসবুকসহ নানা মাধ্যমে সমালোচনা চলে। কিছু গণমাধ্যমে সেসব সংবাদ আকারে প্রচারও হয়, যাতে বলা হয়, জিতু নির্বাচিত হলে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের পুনর্বাসন হবে। তবে বিষয়টি শেষ পর্যন্ত ততটা কাজ দেয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১ নম্বর ছাত্র হলের সাকিব তন্ময় বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনে ছাত্রলীগের কাছে মার খাওয়া জিতু ভাইকে নিয়ে যখন প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হয়েছে, তখন ওই ন্যারেটিভ ব্যাক ফায়ার করে। তাঁকে ছাত্রলীগের ট্যাগিং শিক্ষার্থীরা ভালোভাবে নেয়নি।’
ছাত্রলীগের ভোট
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সূত্রে জানা গেছে, ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকা শিক্ষার্থীদের মধ্যে জাকসু নির্বাচনে ভোটার ছিলেন হাজারখানেক। তাঁদের অধিকাংশই জিতুকে ভোট দিয়েছেন। জিতুর নির্বাচনী কার্যক্রম শুরুর পর থেকে তাঁর প্রচারে তাঁদের অনেককে সক্রিয় থাকতে দেখা গেছে। তবে এসব শিক্ষার্থীর অনেকেই জুলাই আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন এবং ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে আবদুর রশিদ জিতু বলেন, ‘কখনো কারও সঙ্গে অন্যায় আচরণ করিনি।’ জাকসুর প্রতিনিধিদের প্রথম কাজ দলীয় লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি বন্ধ করা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এসব রাজনীতির কারণে অনেকের শিক্ষাজীবন নষ্ট হয়। জুলাই আন্দোলনে হামলায় যেসব শিক্ষক জড়িত ছিলেন, তাঁদের বিচারপ্রক্রিয়া চলছে। তাঁদের শাস্তির মুখোমুখি করতে যা কিছু করা লাগে, আমরা সেসব করতে অঙ্গীকারবদ্ধ।’
আব্দুল্লাহ আল মামুন
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়